সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কী করছি আমরা
বর্তমান ডিজিটাল পৃথিবীতে হারিয়ে গেছে ভৌগোলিক সীমারেখা। সেই সঙ্গে হারিয়ে গেছে মানুষের ভদ্রতা, সৌজন্য, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা। এই অনলাইন জার্নিতে আমরা মুক্ত, স্বাধীন হলেও সেই মুক্তির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় নারীরা পাচ্ছেন ভয় আর হয়রানির ছায়া।
একটা সময় ছিল, যখন বিদেশে বসে দেশের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পরিবারের সব খবর রাখতে একটু সময় পেলেই স্যোশাল মিডিয়ায় ঢুঁ মারতাম। ছোটবেলার অনেক বন্ধুকে বহু বছর পর খুঁজে পেয়েছি অনলাইনে। লন্ডনে জন্ম নেওয়া আমার ছেলে বাংলাদেশ চিনেছে ফেসবুকে ছবি দেখে। দেশে থাকা আত্মীয়স্বজন ওর বেড়ে ওঠার প্রতিটা ধাপ দেখেছে ফেসবুক স্টোরির মাধ্যমে। এখনো যেকোনো অনুষ্ঠানের পর সবার আগে তাড়াতাড়ি করে ছবি আপলোড দিই। নিরানন্দ প্রবাসজীবনের বিন্দু পরিমাণ আনন্দ ভাগাভাগি করতে চাই আমার পরিবারের সঙ্গে। সারা সপ্তাহ কথা না হলেও আমার মা এই ছবিগুলো দেখে মনকে সান্ত্বনা দেন।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, কিছু দিন হলো ফেসবুক একটি বিষাক্ত প্ল্যাটফর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্যোশাল মিডিয়াতে ১০ মিনিটের বেশি থাকা যায় না। কাউকে পছন্দ হচ্ছে না, তো দাও তার একান্ত গোপন কিছু ফাঁস করে। কারণে–অকারণে কেউ কেউ শুধু নিজের লালসা চরিতার্থ না করতে পেরে কুৎসিত সব মন্তব্য করে বসে। বিশেষত নারীরা তাদের প্রধান টার্গেট। এ ক্ষেত্রে কোনো বয়সের নারীরাই রেহাই পাচ্ছেন না। আমরা যেমন দেখছি চিত্রনায়িকা অঞ্জনা, নুতনদের মতো বয়োজ্যেষ্ঠ নায়িকাদের মেকআপ, পোশাক, বয়স নিয়ে নির্দ্বিধায় ট্রল করছে, বডি শেইমিং করছে। ঠিক তেমনি বুবলী, অপু, পরীমনিকে নিয়েও বুলিং করছে। করছে চরিত্র হনন। এমনকি তাদের হয়রানির শিকার হচ্ছেন সাধারণ গৃহবধূ থেকে শুরু করে শিল্পী, মডেল, কর্মজীবী নারী, ছাত্রী, শিক্ষক, নারী খেলোয়াড়, রাজনীতিবিদ—সবাই।
সম্প্রতি ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই অনলাইন শেমিংয়ের বিষয়টি একেবারে মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। ডাকসু নির্বাচনের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের পোশাক, মেকআপ নিয়ে অবাঞ্ছিত মন্তব্য আমরা দেখেছি। এমনকি তাঁর সৌন্দর্য নিয়েও অশালীন মন্তব্য করতে ছাড়েনি কিছু মানুষ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনের পর দুই নারী শিক্ষককে নিয়ে যে বাড়াবাড়ি অনলাইন কদর্যতা হয়েছে, তা ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের নারীদের জন্য এক অশনিসংকেত। শিক্ষকদের ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকতে পারে। নিজস্ব পছন্দ–অপছন্দ থাকতে পারে, কিন্তু তাই বলে তাঁদের ট্যাগিং ব্যাশিং করতে পারি না; অপমান, দেখে নেওয়ার হুমকি দিতে পারি না। তাঁদের নামে চটকদার বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে কুৎসিত অপপ্রচার চালাতে পারি না। আমি উদাহরণ হিসেবে এই তিনজনের কথা উল্লেখ করলাম, কারণ, তাঁরা ভিন্ন ভিন্ন ধারার রাজনীতির সমর্থক এবং এই তিনজনই দেশের প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। এই সম্মানিত শিক্ষকদের সম্মানহানি শুধু তাঁদের নয়, গোটা দেশের নারী সমাজের সম্মানহানি।
কয়েক দিন আগে এক মডেল ও নৃত্যশিল্পীকে দেখলাম ক্ষোভ প্রকাশ করতে। তাঁর ১৩ বছর বয়সী ছেলের সঙ্গে ছবি নিয়ে করা কুৎসিত মন্তব্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে। এখানে শুধু নারী একা নন, সঙ্গে একটি অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানকেও অনলাইন অ্যাবিউজ থেকে রেহাই দেওয়া হয়নি। শুধু ভিকটিম একা প্রতিবাদ করলে হবে না। এখন সময় এসেছে দল বেঁধে অনলাইন আক্রমণের এই সাইবার মব কালচারের বিরুদ্ধে সম্মলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলার।
সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, যে বা যারা নারীদের নিয়ে বাজে মন্তব্য করে, তাদের অধিকাংশই ফেক আইডি ব্যবহার করে। এসব সোশিওপ্যাথগুলো নিজের প্রোফাইলে রাখে ফুল, পাখি, চাঁদ, তারা, বিড়াল, শিশু ও কালেমার ছবি আর নায়িকাদের প্রোফাইলে গিয়ে গিয়ে নোংরা কমেন্টস করে। ঢালাওভাবে নারীকে হয়রানি এবং অশ্লীল ও যৌনতামূলক রসালো মন্তব্য তো আছেই, আবার বিশেষ ক্ষেত্রে তারা এসব অপকর্ম করে জোটবদ্ধ হয়ে অনলাইন মব তৈরির মাধ্যমে।
কিন্তু যে বিষয়টা সবচেয়ে ভয়াবহ, তা হল, তারা আধুনিক প্রগতিশীল নারীদের মধ্যে একটা ভীতির সঞ্চার করতে চেষ্টা করে। তাদের প্রধান টার্গেট সমাজের এগিয়ে থাকা নারীরা। তাঁদের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রক্রিয়াটি আর স্বাভাবিক পর্যায়ে নেই, যা নারীদের মানসিক ও সামাজিক নিরাপত্তার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে।
বাংলাদেশে সাইবার বুলিং বা অনলাইন হয়রানি বন্ধে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন, ২০১৮ (The Digital Security Act, 2018) করা হলেও এই আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে নেই তেমন কার্যকর পদক্ষেপ। কোনো রকম গাইডলাইন ও নিয়ন্ত্রণ না থাকার কারণে এ ধরনের অনলাইন অপরাধ থামছে না। কিছু কিছু মানুষ তাদের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে স্যোশাল মিডিয়া থেকে ছবি, ভিডিও নিয়ে, এডিট করে চরিত্র হননের মতো ঘৃনিত কাজটি অবলীলায় করে যাচ্ছে।
এই সাইবার মব বা জোটবদ্ধ অনলাইন বুলিংয়ের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এ ক্ষেত্রে নারীর প্রতি সম্মান বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। ডিজিটাল–দুনিয়াকে নারীবান্ধব করতে হবে। সচেতন প্রত্যেক নাগরিককে হতে হবে অনলাইন হেল্পার। যেখানেই নারীর প্রতি অশ্লীল কমেন্ট বা হয়রানিমূলক কনটেন্ট হবে, সেখানেই চুপ না থেকে প্রতিবাদ করতে হবে। এই সংগ্রাম হবে মানসিকতা বদলের লড়াই। সবার মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা এমন একটা বাংলাদেশ গড়তে চাই, যেখানে নারী থাকবে নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ, অনলাইন-অফলাইনে। মনে রাখতে হবে, সাহসই হলো সেরা সুরক্ষা।
*লেখক: মাহবুবা জেবিন, সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রেসক্লাব, ইউকে।
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]