সময় ও স্মৃতির অদ্বিতীয় যাত্রায় স্বপ্নময় পরিচালক ক্রিস্টোফার নোলানের গল্প
বিশ্বজুড়ে ঝড় তুলেছে সদ্য মুক্তি পাওয়া ইংরেজি সিনেমা ‘ওপেনহাইমার’। তাই এ মুহূর্তে বলতে গেলে রীতিমতো ‘ওপেনহাইমার’–জ্বরে ভুগছেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা চলচ্চিত্রপ্রেমীরা। বিখ্যাত মার্কিন পদার্থবিজ্ঞানী রবার্ট জে ওপেনহাইমারের জীবনীর ওপর ভিত্তি করে নির্মাণ করা হয় এ চলচ্চিত্র। ১৯০৪ সালের ২২ এপ্রিল নিউইয়র্ক শহরে এক ইহুদি পরিবারে ওপেনহাইমারের জন্ম হয়। তাঁর বাবা ছিলেন জার্মানি থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমানো এক অভিবাসী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে নিউ মেক্সিকোর লস অ্যালামোস ল্যাবরেটরিতে ম্যানহাটন প্রজেক্ট নামক এক গোপন রিসার্চ প্রোগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রবার্ট জে ওপেনহাইমার। এ রিসার্চ প্রোগ্রামের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র মানবসভ্যতার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো পারমাণবিক বোমা তৈরির পাশাপাশি এর সফল পরীক্ষা চালায়। যেহেতু রবার্ট জে ওপেনহাইমার ম্যানহাটন প্রজেক্টের নেতৃত্বে ছিলেন, তাই পারমাণবিক বোমার জনক হিসেবে তাঁর নাম উঠে আসে। বলা বাহুল্য, ওই সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও জার্মানি পৃথকভাবে পারমাণবিক বোমা তৈরির চেষ্টা চালিয়েছিল। জার্মানি এ ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত সফলতা পায়নি। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের পর দ্বিতীয় রাষ্ট্র হিসেবে ১৯৪৯ সালে পারমাণবিক বোমার সফল পরীক্ষা চালায় তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন।
ওপেনহাইমারের ঘটনাবহুল জীবনকে ক্যামেরায় বন্দী করে আবারও আলোচনায় এসেছেন বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ক্রিস্টোফার নোলান। সত্যি কথা বলতে গেলে, ক্রিস্টোফার নোলানের নাম শোনেননি, এমন মানুষ খুব একটা খুঁজে পাওয়া যাবে না। সিনেমাপ্রেমীদের একটি বড় অংশের মতে, একবিংশ শতাব্দীর সেরা চলচ্চিত্র নির্মাতা হচ্ছেন ক্রিস্টোফার নোলান। মানুষের সৃজনশীলতা ও চিন্তাশক্তিকে সাধারণের বাইরে সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে প্রকাশ করার একটি মাধ্যম হলো সিনেমা। শুধু বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে আমরা সিনেমাকে বেছে নিই, তেমনটি বলা যাবে না। আনন্দ লাভের পাশাপাশি আমাদের অন্তর্নিহিত অনুভূতিকে তীক্ষ্ণ করা এবং একই সঙ্গে চিন্তা, চেতনা ও মনশীলতার ক্ষেত্রকে প্রসারিত করার জন্য সিনেমার ভূমিকা অপরিহার্য। এ কারণে আমাদের চিন্তাধারা কিংবা কথাবার্তা, এমনকি দৈনন্দিন আচার-আচরণেও অনেক সময় সিনেমা বা বিভিন্ন টেলিভিশন সিরিয়ালের প্রভাব লক্ষ করা যায়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এ যুগে সাহিত্যের সঙ্গে সিনেমা ও টেলিভিশন সিরিয়ালকে সমাজের দর্পণ হিসেবে আখ্যা দিলে ভুল কিছু বলা হবে না। সিনেমা হতে পারে দর্শনের প্রতিবিম্ব।
ক্রিস্টোফার নোলান হয়তো সিনেমাকে গতানুগতিক ধারার বাইরে নিয়ে সম্পূর্ণ এক আলাদা সত্তা হিসেবে আমাদের সামনে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। আর তাই সিনেমা নির্মাণের ক্ষেত্রে তিনি বেছে নিয়েছেন ভিন্নধারা। দর্শকের চোখের সস্তা মনোরঞ্জন অথবা নিম্নস্তরের চিত্তবিনোদন নয়, তিনি চান তাঁর নির্মাণ দর্শকদের মনে চিন্তার ঝড় তুলুক, অনুসন্ধিৎসু করে তুলুক এবং মনে সঞ্চার করুক অজস্র ভাবনার। তবে তাঁর পরিচয় শুধু চলচ্চিত্র নির্মাতাই নয়, তিনি একাধারে চিত্রনাট্যকার, প্রযোজক ও পরিচালক। সাধারণত প্রতি দুই কিংবা তিন বছর পরপর বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে ক্রিস্টোফার নোলানের সিনেমা মুক্তি পায়। সিনেমার জন্য স্ক্রিপ্ট করা থেকে শুরু করে শুটিং স্পট নির্ধারণ, সিনেমার বিভিন্ন চরিত্রের জন্য অভিনেতা ও অভিনেত্রী নির্ধারণ ও পোস্টপ্রোডাকশন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন বিষয়, যেমন এডিটিং, ভিজ্যুয়াল ইফেক্ট বা সাউন্ড ডিজাইনিংসহ যাবতীয় বিষয়ে বাড়তি মনোযোগ দেন। সিনেমার পর্দা ও বাস্তব—এ দুইয়ের মাঝে চোখে পড়ার মতো পার্থক্য বিদ্যমান। বিষয়টি নিয়ে আমরা সবাই একমত। নোলান তাঁর সিনেমার সব দৃশ্যকে বাস্তবের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেন। পুঁজিবাদের এ যুগে যেখানে বেশির ভাগ স্টুডিও ও চলচ্চিত্র নির্মাতা সিনেমার গুণগত মানের দিকের চেয়ে অর্থ উপার্জনকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন, সেখানে নোলান স্রোতের বিপরীতে গিয়ে এখনো সিনেমার শিল্পগুণের দিকে মনোযোগ দিচ্ছেন। প্রায় দুই দশক ধরে তিনি ওয়ার্নার ব্রোস স্টুডিওয়ের মাধ্যমে তাঁর সিনেমা মুক্তি দিয়েছেন। ওয়ার্নার ব্রোসের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের ছেদ ঘটেছে, তবু কোয়ালিটির সঙ্গে আপস করেননি। এ ছাড়া নোলান তাঁর সিনেমার শুটিংয়ে আধুনিক ও পুরোনো—দুই ভিন্ন সময়ের প্রযুক্তি ব্যবহার করেন। ডিজিটাল ফিল্মের পরিবর্তে ফিল্ম স্টক তাঁর বেশি পছন্দ। ২০০৮ সালে ‘ব্যাটম্যান’ সিরিজের দ্বিতীয় সিনেমা ‘দ্য ডার্ক নাইট’–এর শুটিং করা হয়েছিল আইম্যাক্স ক্যামেরা ব্যবহার করে। ক্রিস্টোফার নোলান বর্তমানে তাঁর প্রায় সব সিনেমার শুটিং করেন এ আইম্যাক্স ক্যামেরার সাহায্যে। ওই সময় আইম্যাক্স ক্যামেরার সংখ্যা পুরো পৃথিবীতে ছিল হাতে গোনা কয়েকটি। একটি আইম্যাক্স ক্যামেরা কিনতে সে সময় প্রায় হাফ মিলিয়ন পাউন্ড ব্যয় করতে হতো।
‘ডার্ক নাইট’ সিনেমায় বিস্ফোরণের মাধ্যমে গোথাম জেনারেল হাসপাতাল ধ্বংসের যে দৃশ্য দেখানো হয়েছে, সেটি পুরোপুরি একটি বাস্তব চিত্র। নোলান নিজে একটি বিল্ডিং কিনে সেটাকে হাসপাতালের মতো সাজিয়েছিলেন। এরপর তাঁর নির্দেশে বিস্ফোরণের মাধ্যমে বিল্ডিংটিকে ধ্বংস করা হয়। সাধারণত সুপারহিরো সিনেমা মানে সিজিআই ইফেক্ট, ভিএফএক্স আর ক্যামেরার কারসাজি। নোলান এ ধারা থেকে বের হয়ে আসতে চেয়েছিলেন। এ জন্য বাস্তবতার সঙ্গে মিল রাখতে তিনি এ ধরনের একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সিনেমার শুটিং চলাকালে একটি আইম্যাক্স ক্যামেরাও বিস্ফোরণের ফলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। নন–লিনিয়ার স্টোরি টেলিং তাঁর সিনেমার সঙ্গে দর্শকদের এক ফ্রেমে আটকে রাখার চেষ্টা করে। এসব কারণে নোলানের একটি সিনেমা মুক্তি পেতে বেশ লম্বা সময় অপেক্ষা করতে হয়। তাই তাঁর সিনেমাকে ঘিরে সব সময় মানুষের মধ্যে বাড়তি উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। নোলানের সৃষ্টিশীল কর্মের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে ২০১২ সালে। তখন আমি দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। ওই বছর প্রায় কাছাকাছি সময় দুটি সুপারহিরো সিনেমা মুক্তি পায়—‘দ্য অ্যাভেঞ্জারস’ ও ‘দ্য ডার্ক নাইট রাইজেস’।
বলা বাহুল্য, ২০০৮ সালে মুক্তি পাওয়া ‘আয়রনম্যান’ সিনেমার মার্ভেল আলাদা ইউনিভার্স তৈরি করে। মার্ভেল সিনেমাটিক ইউনিভার্সের অধীন থাকা সুপারহিরোদের গল্প ইতিমধ্যে সবার মুখে মুখে প্রচলিত। পুরো পৃথিবীতে মার্ভেলের একটি আলাদা ফ্যান বেজ তৈরি হয়েছে এবং ‘দ্য অ্যাভেঞ্জারস’ সিনেমার ট্রেইলারে যখন ‘আয়রনম্যান’, ‘দ্য ইনক্রেডিবল হাল্ক’, ‘ব্ল্যাক উইডো’, ‘হক আই’, ‘ক্যাপ্টেন আমেরিকা’ ও ‘থর’কে একসঙ্গে দেখা গেল, তখন বেশির ভাগ মানুষের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল এ সিনেমা। মার্ভেলের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ডিসি কমিকের নাম অনেকে ভুলতে বসেছিল। ঠিক এমন সময় নোলানের ম্যাজিকে সারা পৃথিবীতে ‘দ্য অ্যাভেঞ্জারস’–এর সঙ্গে সমানে পাল্লা দিয়ে দর্শকদের মধ্যে আলাদা স্থান তৈরি করে ‘ব্যাটম্যান’ সিরিজের শেষ সিনেমা ‘দ্য ডার্ক নাইট রাইজেস’। এটাও ঠিক, এ সিনেমাকে নিয়ে সমালোচনাও হয়েছে। তবে মার্ভেলভক্তদের অনেকে আজও স্বীকার করতে বাধ্য হন যে সুপারহিরো সিনেমার মধ্য দিয়ে ‘মার্ভেল’ সিরিজ ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে সেরা হলেও শিল্প ও সৌন্দর্যের দিক থেকে নোলানের ‘ব্যাটম্যান’ ট্রিলজি সবার ওপরে। ‘ডার্ক নাইট রাইজেস’ সিনেমার শেষ দৃশ্য আমার মনে বিশেষভাবে ঠাঁই করে নিয়েছিল। আমরা সবাই সিনেমার হ্যাপি এন্ডিং দেখতে চাই, ‘ডার্ক নাইট রাইজেস’ সিনেমাতেও তেমনটি হয়েছে। তবে এ হ্যাপি এন্ডিংয়ের ভেতরেও সাহিত্যের সৌন্দর্য রয়েছে। আর ক্রিশ্চিয়ান বেল, মাইকেল কেন, গ্যারি ওল্ড ম্যান, মরগান ফ্রিম্যান, টম হার্ডি, মারিওন কোটিলার্ড, আনা হাথাওয়ে আর জোসেফ গর্ডন লেভিট প্রত্যেকে নিপুণ অভিনয়শৈলীর মাধ্যমে ‘ডার্ক নাইট রাইজেস’ সিনেমাকে অন্য এক স্তরে নিয়ে গিয়েছেন। আইএমডিবিতে এ সিনেমার রেটিং ৮.৪। ক্রিস্টোফার নোলানের আগে টিম বার্টনও ‘ব্যাটম্যান’ সিনেমা নির্মাণ করে প্রশংসিত হয়েছেন। ম্যাট রিবসও রবার্ট প্যাটিনসনকে সঙ্গে নিয়ে নতুন করে ‘ব্যাটম্যান’ সিনেমা নির্মাণের কাজ করছেন। টিম বার্টনের ‘ব্যাটম্যান’ সিনেমা ছিল অনেকটা সরলরৈখিক, ফ্যান্টাসি আর সাররিয়েল–নির্ভর। সেখানে নোলানের ‘ব্যাটম্যান’ ছিল একেবারে রিয়েলিস্টিক ও ক্ল্যাসিক্যাল ঘরানার। ২০০৫ সালে নোলান যখন ‘ব্যাটম্যান’ সিরিজ নিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন ডিসিভক্তদের অনেকে তাঁর বিরোধিতায় নেমেছিলেন। কেননা, ক্রিস্টোফার নোলান কমিকের বাইরে গিয়ে একেবারে ভিন্ন আবহে বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পর্দায় ‘ব্যাটম্যান’কে ফুটিয়ে ধরার পরিকল্পনা সাজিয়েছিলেন। ‘ব্যাটম্যান’কে নিয়ে অতীতে অনেক সিনেমা তৈরি হয়েছে, তবে নোলানের ‘দ্য ডার্ক নাইট ট্রিলজি’ ‘ব্যাটম্যান’ সিরিজের অন্য সব সিনেমা থেকে একেবারেই আলাদা। আর আলাদা হবে না কেন? ক্রিস্টোফার নোলানের চিন্তাধারা আমাদের মতো কখনো সরলরৈখিক নয়। তাই যাঁরা শুরুতে তাঁর বিরোধিতায় নেমেছিলেন, শেষ পর্যন্ত তাঁরা স্বীকার করতে বাধ্য হন, নোলানের ‘দ্য ডার্ক নাইট ট্রিলজি’ নিছক কোনো সুপারহিরো ফিল্ম সিরিজ নয়, বরং এক অনন্যসাধারণ শিল্প হিসেবে আখ্যা দিলেও ভুল কিছু বলা হবে না। ‘ডার্ক নাইট’ সিরিজের প্রথম সিনেমা ‘ব্যাটম্যান বিগিন্স’–এর আইএমডিবি রেটিং ছিল ৮.৩। আর এ সিরিজের দ্বিতীয় সিনেমা ‘দ্য ডার্ক নাইট’ নিয়ে আলাদাভাবে কিছু বলার নেই। একটা সুপারহিরো সিনেমার আইএমডিবি রেটিং ৯.০, এমনটি কখনো কল্পনা করা যায়? নায়কের চেয়ে ভিলেন বড়। কখনো কি এমনটি ভাবা যায়? সাধারণত আমরা যেকোনো সিনেমায় কী দেখি? বিশেষ করে সুপারহিরো সিনেমায়। নায়ক হচ্ছেন সত্য, ন্যায় ও মানবতার প্রতীক। সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের কাছে তিনি বিশেষভাবে সম্মানিত। অন্যদিকে ভিলেন সমাজের শান্তি ও শৃঙ্খলাকে নষ্ট করতে চায়। পৃথিবীতে নৈরাজ্য সৃষ্টি করা তার কাজ। নায়ক আর ভিলেনের লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত নায়ক জয়লাভ করে এবং মানুষ তাঁকে ঘিরে অনুপ্রেরণা খুঁজতে চায়। সিনেমার শেষে ভিলেনকে নিয়ে যতটা না আলোচনা হয়, তার চেয়ে বেশি আলোচনা হয় নায়ককে নিয়ে। তবে এমন একটি ভিলেন চরিত্র রয়েছে, যা গতানুগতিক সব ধরনের ভিলেন চরিত্র থেকে আলাদা। এ চরিত্রে যিনি অভিনয় করেছেন, তিনি রুপালি পর্দায় চরিত্রটিকে এক অনবদ্য রূপে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। সমাজের রূঢ় বাস্তবতা প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর অভিনীত এ চরিত্রের মধ্য দিয়ে। বদলে দিয়েছেন অতীতের অনেক ইতিহাসকে। তাই এ সিনেমায় কাজ করা নায়কের চরিত্রের চেয়ে শেষ পর্যন্ত ভিলেনের চরিত্র অধিক মাত্রায় ঠাঁই পেয়েছে দর্শকদের মনে। বলছিলাম জোকারের কথা। ক্রিস্টোফার নোলান প্রচলিত সুপারহিরো সিনেমার সংজ্ঞা বদলে দিয়ে দুর্নীতি, রাজনীতি, নৈরাজ্য, ভালোবাসা, আত্মত্যাগ—সবকিছু মিলিয়ে ‘দ্য ডার্ক নাইট’ সিনেমার মধ্য দিয়ে এক অসাধারণ মনস্তত্ত্বের অবতারণা ঘটিয়েছেন, যার প্রতিফলন আমরা দেখতে পেয়েছি জোকার নামক চরিত্রটির মধ্য দিয়ে। ফলস্বরূপ চলচ্চিত্রপ্রেমীদের মনে আজীবন জায়গা দখল করে নিয়েছেন অভিনেতা হিথ লেজার।
দর্শক ও সমালোচকদের দৃষ্টিতে সর্বকালের সেরা ভিলেনের তকমা জোটে ‘দ্য ডার্ক নাইট’–এর জোকারের। আমেরিকান ফিল্ম ইনস্টিটিউটের সর্বকালের সেরা খলনায়কদের তালিকায় সবাইকে পেছনে ফেলে এক নম্বরে অবস্থান করছে হিথ লেজারের জোকার চরিত্রটি। এ তো গেল সুপারহিরো সিনেমার গল্প; সায়েন্স ফিকশন, ঐতিহাসিক, থ্রিলার কিংবা সাইকোলজি—সব ধরনের সিনেমা নির্মাণে নোলান সমানভাবে পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। খুব অল্পসংখ্যক ডিরেক্টর আছেন, যাঁরা একই সঙ্গে বিবিধ বিষয় নিয়ে সিনেমা বানাতে পারেন। ২০১০ সালে মুক্তি পাওয়া ইনসেপশন সিনেমার কথা আলোচনা করা যাক। বলা হয়ে থাকে, এ সিনেমার স্ক্রিপ্ট লিখতে তিনি প্রায় ১০ বছর সময় ব্যয় করেছিলেন। মানুষের স্বপ্ন যেন বিভিন্ন তথ্যের ভান্ডার।
মানুষের চিন্তাধারা অনেক সময় তাঁর স্বপ্নের মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়। আর কোনোভাবে সে স্বপ্নের মধ্যে প্রবেশ করা সম্ভব হলে তাঁর মনের গতিবিধিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়। আবার স্বপ্নের মধ্যেও কয়েকটি স্তর রয়েছে। অনেক সময় মানুষ স্বপ্নের সঙ্গে বাস্তবের পার্থক্য নিরূপণ করতে পারেন না। স্বপ্ন ও বাস্তবের পার্থক্যের জন্য তাই রয়েছে একধরনের লাটিম, যার নাম ‘টোটেম’। একটি লাটিম ঘোরানো হলে তা ধীরে ধীরে কিছু সময় পর স্থির হয়ে যায়। বাতাসের প্রভাব ও ঘর্ষণের ফলে এমনটি হয়, তবে স্বপ্নের জগতে লাটিমটি কখনো তার ঘূর্ণন বন্ধ করবে না। এভাবে স্বপ্নের জগতের সঙ্গে বাস্তব জগতের একটা পার্থক্য দেখানো হয়েছে। আপাতদৃষ্টে এ ধরনের বিষয়গুলোকে সরল মনে হতে পারে। তবে যাঁরা এ সিনেমা দেখেছেন, তাঁরা এক বাক্যে স্বীকার করবেন, এ সিনেমার মধ্য দিয়ে স্বপ্নকে বনিয়াদ করে নোলান তাঁর লেখা চিত্রনাট্যকে চলচ্চিত্রে রূপ দিয়ে নিজের চিন্তার গভীরতা, অতুলনীয় সৃষ্টিশীলতা ও শিল্পীসত্তাকে অনন্য উপায়ে উপস্থাপন করেছেন। আধুনিক প্রযুক্তির এ যুগে নোলান তাঁর এ সিনেমায় ব্যবহার করেন হাল আমলে ব্যবহৃত ফটো কেমিক্যাল টাইমিং, যা দর্শকদের বাড়তি আগ্রহের জন্ম দেয়। একই কথা প্রযোজ্য ২০১৪ সালে মুক্তি পাওয়া ‘ইন্টারস্টেলার’-কে ঘিরে। বলা বাহুল্য, আমার মধ্যে ফিজিকস আর অ্যাস্ট্রোফিজিকসের উচ্চশিক্ষা নেওয়ার আগ্রহ জন্মেছিল এ সিনেমা দেখার পর থেকে। সিনেমার চিত্রনাট্য লিখতে নোলান সাহায্য নিয়েছেন তাত্ত্বিক পদার্থবিদ কিপ স্টেফান থোর্নের। এই সিনেমা নিয়ে নোলান নিজেও অকপটে স্বীকার করেছেন, ‘“ইন্টারস্টেলার”–কে পুরোপুরি বুঝতে হলে একবার দেখলে হবে না। অন্তত তিনবার কিংবা চারবার দেখে এর প্রতিটি বিষয় হয়তো বিশ্লেষণ করা সম্ভব।’ এ সিনেমায় ওয়ার্মহোল, ব্ল্যাকহোল, স্পেস টাইম রিপ্রেজেন্টেশন ভিজ্যুয়ালি যতটা সম্ভব নির্ভুলভাবে চিত্রায়ণের চেষ্টা করেন নোলান। আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের অনেক প্যারাডক্স এ সিনেমার মধ্য দিয়ে সাধারণ দর্শকদের মাঝে উঠে এসেছে। যেমন ছোটবেলায় আমরা অনেকে একটা প্রশ্ন করতাম যে ছেলে বা মেয়ের বয়স কি মা–বাবার বয়সের চেয়ে বড় হতে পারে? তত্ত্বীয়ভাবে বলতে গেলে পারে। এই প্রশ্নের উত্তর এ সিনেমায় সূক্ষ্মভাবে দেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতের পৃথিবী, যেখানে মানুষের বসবাসের পরিবেশ নেই, সে রকম একটি সময়ে কীভাবে আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা যায়, তা নিয়েও একটি ধারণা এ সিনেমায় দেওয়া হয়েছে। এ সিনেমায় দেখানো ব্ল্যাকহোলটি এখন পর্যন্ত রুপালি পর্দায় প্রদর্শিত সবচেয়ে নিখুঁত ব্ল্যাকহোলের ছবি। ১০০ জনের বেশি গ্রাফিক ডিজাইনার ও ১ হাজারের বেশি কম্পিউটারের সাহায্যে পুরো এক বছর পরিশ্রমের পর প্রাপ্ত প্রায় ৭৮ টেরাবাইট ডেটার ফলাফল হচ্ছে এই ব্ল্যাকহোল। এ ছাড়া এ সিনেমার জন্য ৫০০ একর জমিতে ভুট্টা বুনে খেত বানিয়েছিলেন। তবে একটা কথা উল্লেখ করে নিই, সায়েন্স আর সায়েন্স ফিকশন—এ দুই বিষয়কে আলাদাভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। ৮৭তম একাডেমি অ্যাওয়ার্ডে সর্বোচ্চ ২৬টি বিভাগে মনোনয়ন লাভ করার পাশাপাশি সে বছর সর্বোচ্চ সাতটি বিভাগে অস্কার লাভ করে ‘ইন্টারস্টেলার’ নামের এ সায়েন্স ফিকশন সিনেমা। ‘টেনেট’–এর কাহিনিও অত্যন্ত জটিল। পুরো দৃশ্যপট ভালোমতো বুঝতে আমাকে তিন থেকে চারবার এ সিনেমা দেখতে হয়েছে। এ সিনেমায় নোলান টাইম ট্রাভেলিংকে নতুনভাবে তুলে ধরেছেন, যা আমার দেখা অন্যান্য সায়েন্স ফিকশন সিনেমা থেকে একেবারে আলাদা।
২০১৭ সালে নোলান মুক্তি দেন তাঁর বহুল প্রতীক্ষিত ঐতিহাসিক সিনেমা ‘ডানকার্ক’। প্রকৃতপক্ষে ডানকার্ক হচ্ছে উত্তর ফ্রান্সের একটি সমুদ্রবন্দর। জার্মান সেনাদের ক্রমাগত আক্রমণের ফল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সেখানে তিন লক্ষাধিক ইংরেজ ও ফরাসি সৈনিক আটকা পড়ে ডানকার্কে। প্রতিমুহূর্তে আক্রমণ চালাচ্ছে জার্মানরা, একে একে নিক্ষেপ করছে বোমা। নিজেদের জীবন বাঁচানোর জন্য প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করছে আটকে পড়া সবাই। সাধারণত, আমরা যুদ্ধে অংশ নেওয়াকে গৌরবের বিষয় হিসেবে দেখি, তবে যুদ্ধস্থল থেকে প্রাণ রক্ষা করে নিরাপদে ফিরে আসাটাও সমানভাবে গৌরবের বিষয়, যা নোলান এ সিনেমার মধ্য দিয়ে তুলে ধরেছেন। নোলানের সিনেমা একদিকে যে রকম দর্শনকে তুলে ধরে, ঠিক তেমনিভাবে আমাদের মধ্যে বিভিন্ন প্রশ্নের জন্ম দেয়। কোনো কোনো সময় আবার তিনি সিনেমার শেষটা ছোটগল্পের মতো দর্শকদের নিকট তুলে দেন। যেমন ‘ডার্ক নাইট রাইজেস’ সিনেমার শেষাংশে আমরা দেখি ব্রুস ওয়েন বা ব্যাটম্যান পুরো শহরকে বাঁচাতে নিজেই বিশাল আকৃতির এটমিক বোম নিয়ে এমন একটি নিরাপদ স্থানে পাড়ি জমায়, যেখান থেকে বোমা বিস্ফোরিত হলেও শহরের কোনো ক্ষতি হবে না। প্রথম দিকে মনে হয়, বোমা বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাটম্যানের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু সিনেমার এন্ড ক্রেডিট দৃশ্যে ওয়েন পরিবারের পরিচারক আলফ্রেডকে ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে একটি ক্যাফেতে দেখানো হয়। আলফ্রেড যখন এ ক্যাফেতে আসেন, তখন তিনি সব সময় তাঁর প্রিয় ড্রিংক ফেরনেত ব্রাঙ্কার অর্ডার করেন।
কিন্তু ওই দিন ফেরনেত ব্রাঙ্কা পান করার পর যখন তিনি তাঁর কার্ডের মাধ্যমে বিল পরিশোধ করতে যান, তখন তিনি ওই ক্যাফেতে ব্রুসকে দেখতে পান। এ সময় ব্রুসের সঙ্গে তাঁর বান্ধবী সেলিনা কাইলও ছিল। এখানে সিনেমার সবচেয়ে বড় টুইস্ট, সত্যি কি বোমা ব্লাস্টের ফলে ব্রুসের মৃত্যু হয়েছিল? নাকি পুরো দৃশ্য ছিল আলফ্রেডের কল্পনা? আবার ‘ইনসেপশন’ সিনেমার শেষ দৃশ্য এসেও একই পরিস্থিতি লক্ষ করি। সত্যি কি তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ থেকে মুক্তি পেয়ে নিজের সন্তানদের কাছে ফিরে গিয়েছিলেন? নাকি এ দৃশ্যও স্বপ্নের মধ্যে ঘটেছে? বিশাল সাগরের তুলনায় এক বালতি পানি নিতান্তই যৎসামান্য। ঠিক একইভাবে এখন পর্যন্ত পাঁচবার একাডেমিক অ্যাওয়ার্ডের মনোনয়ন পাওয়া এ চলচ্চিত্র নির্মাতাকে নিয়ে আলোচনা করার জন্য এতটুকু লেখা একটি বিন্দুর মতো সামান্য। ব্যক্তিজীবনে নোলান প্রচণ্ড কর্মঠ এবং রাশভারী প্রকৃতির মানুষ। আধুনিক যুগের পরিচালক হয়েও তিনি কোনো ধরনের স্মার্টফোন ব্যবহার করেন না।
১৯৭০ সালে আজকের দিনে যুক্তরাজ্যের ওয়েস্টমিনস্টারে তাঁর জন্ম হয়। ৫২তম জন্মদিনে এ গুণী চলচ্চিত্র নির্মাতার প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। আগামী দিনগুলোয় তাঁর কাছ থেকে আরও অনেক মাস্টারপিস সিনেমা উপহার পাব, সে প্রত্যাশা রইল।
*লেখক: রাকিব হাসান রাফি, শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া