বারবার দেখার মতো ছবি ‘তুফান’
পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে গত ১৭ জুন দেশের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় ‘তুফান’। মুক্তির পরপরই সিনেমাটি দেখতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন দর্শক। স্টার সিনেপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে, জুন-জুলাইয়ে টিকিট বিক্রির হিসাবে প্রথমে ছিল ‘তুফান’। দর্শকচাহিদার কারণে মুক্তির আড়াই মাস পরও সিনেপ্লেক্সে প্রদর্শিত হচ্ছে সিনেমাটি। শুধু দেশেই নয়, দেশের বাইরেও ‘তুফান’ সাড়া ফেলেছে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, সুইডেন, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, স্পেন, পর্তুগাল, আবুধাবি, বাহরাইন, কাতার, ওমানের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় সিনেমাটি। ২৩ আগস্ট সিনেমাটি মুক্তি পায় মালয়েশিয়ায়। সিনেমার ‘লাগে উরাধুরা’, ‘দুষ্টু কোকিল’সহ কয়েকটি গান শ্রোতাদের মধ্যে সাড়া ফেলেছিল।
২৮ জুন থেকে অস্ট্রেলিয়ার প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় ‘তুফান’। সিডনির ব্যাংকসটাউন, ব্ল্যাকটাউন, ইস্টগার্ডেন, মাউন্ট ড্রুইট, ক্যাম্বেলটাউন, ওয়ারাওংসহ দেশটির অন্যান্য রাজ্যের প্রধান শহরেও হাউসফুল চলে সিনেমাটি। আমরা সপরিবার দেখি দুইবার। প্রথমে ২৮ জুলাই ও পরবর্তী সময় ২৫ আগস্ট। দুটি শো–ই ছিল হাউসফুল। ছোটবেলায় দেখতাম, হলে কোনো ভালো সিনেমা এলে মানুষ একের অধিকবার দেখতেন এবং অন্যের কাছে গল্প করতেন, কে কতবার দেখেছেন। ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ ও ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ সিনেমা মুক্তির পর এমন প্রবণতা দেখেছিলাম প্রকটভাবে। আমাদেরও খুব ভালো লেগে যাওয়ায় দ্বিতীয়বারের টিকিট কিনেছিলাম।
শুরুতেই এল ‘তুফান’ সিনেমার টিজ। মাত্র দেড় মিনিট দৈর্ঘ্যের সেটা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, বাংলা সিনেমা তার চিরায়ত আগল ভেঙে বের হওয়ার পথ খুঁজছে। আমি কোনো চলচ্চিত্রবোদ্ধা নই; কিন্তু বাংলা সিনেমার এমন মাপের টিজ বা টিজার এর আগে দেখিনি। সেই টিজে ঢালিউডের ‘নাম্বার ওয়ান শাকিব খান’ ছাড়াও দেখা গেল একঝাঁক পাকা অভিনেতার ঝলক। তবে শেষের দিকে গিয়ে চঞ্চল চৌধুরীকে দেখে মনে হলো এই সিনেমা দেখে পয়সা উশুল হবে। আমাদের দেশের মধ্যবিত্তরা অনেক দিন আগে থেকেই হলবিমুখ। বাংলা সিনেমা মূলত টিকে আছে নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষদের কারণে। চঞ্চল চৌধুরীর উপস্থিতির কারণে মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেকেই প্রথমবারের মতো হলে এসে বাংলা সিনেমা দেখবে বলে ধারণা করছিলাম। সিনেমা মুক্তি পাওয়ার পর দেখা গেল, আসলেই সব শ্রেণি–পেশার মানুষ ‘তুফান’ দেখতে হলে যাচ্ছেন।
দেশে থাকতে আমাদের সপ্তাহান্তের শুরুটা হতো বাংলাদেশের শিল্পীদের গান দিয়ে। প্রবাসেও সেই অভ্যাস রয়ে গেছে। সমসাময়িক শিল্পীদের গানই বেশি শোনা হয়। সেভাবেই পরিচয় প্রীতম হাসানের সঙ্গে। আমাদের ছেলের যখন তিন বছর বয়স, তখন থেকেই তাঁর গান দেখে ইউটিউবে। হয়তোবা তাঁর গানের ঝংকার ওর ছোট হৃদয়ে আলোড়ন তোলে। এভাবেই একদিন মুক্তি পেল ‘তুফান’ সিনেমার প্রথম গান ‘লাগে উরাধুরা’। এর পর থেকে এটা হয়ে গেল আমাদের বাড়ির নিত্যসংগীত। বেলায়–অবেলায় এই গান বেজে চলল। কখনো টিভির পর্দায় আবার কখনো মুঠোফোনের পর্দায়। আমার মনে হয় এই গান দিয়েই যেন জানান দেওয়া হয়ে গেল, ‘তুফান’ আসছে এযাবৎকালের সব রেকর্ড ভেঙে দিতে।
এরপর এল ‘তুফান’–এর কাঙ্ক্ষিত ট্রেইলার। ট্রেইলার দেখে আমাদের বোদ্ধা জনগোষ্ঠী ‘তুফান’–এর গল্প ও অভিনয় নিয়ে মনগড়া সব গল্প ফাঁদতে লাগলেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই একে সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া একটি হিন্দি সিনেমার নকল বলে জাহির করলেন। আবার অনেকেই এই সিনেমার মধ্যে দক্ষিণ ভারতের একটি সিনেমার ছায়া দেখতে পেলেন। এর থেকে বোঝা যায় যে এসব মানুষ বাংলা সিনেমা না দেখলেও পাশের দেশের সংস্কৃতির নিয়মিত চর্চা করেন। এটি আমাদের একধরনের হীনম্মন্যতা। এ নিয়ে আলাদাভাবে লিখব একসময়। ‘তুফান’–এর ট্রেইলারের পর এল এর দ্বিতীয় গান ‘দুষ্টু কোকিল’, সেটাও বাংলা সিনেমার গানের এখন একটি মাইলফলক। এরপর ‘তুফান’ আন্তর্জাতিকভাবে মুক্তি পেল ২৮ জুন।
‘তুফান’ বাংলাদেশে খুবই পরিচিত শব্দ। বাংলা একাডেমির বাংলা অভিধানে এর অর্থ লেখা আছে, বায়ুমণ্ডলের চাপ ও তাপমাত্রার আকস্মিক পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট প্রবল ঝড়। আমার যত দূর মনে পড়ে, বাংলাদেশে একসময় ‘তুফান মেইল’ নামের একটি ট্রেনও চলত। ‘তুফান’ সিনেমাও বাংলা একাডেমির এই সংজ্ঞার মতো যেন বাংলা চলচ্চিত্রজগতে প্রবল ঝড় বইয়ে দিল। সেই ঝড়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসরত বাংলাদেশিরা যেন আক্রান্ত হলেন। সত্যি কথা বলতে, এখনো আক্রান্ত হয়ে আছেন। অস্ট্রেলিয়ায় শেষ শো হয়েছে ২৫ আগস্ট। ‘তুফান’–এর অনেকগুলো অর্জনের মধ্যে যে অর্জনে আমি সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছি, সেটা হলো, ‘তুফান’ হিন্দিতে ডাবিং করে সারা ভারতবর্ষে মুক্তি পেয়েছিল। যদিও তেমন সাড়া তুলতে পারেনি; কিন্তু বাংলা সিনেমার জন্য এটি অতি অবশ্যই একটি গৌরবের বিষয়।
‘তুফান’ মুক্তির পর থেকেই প্রহর গুনছিলাম, কবে দেখব। অবশেষে ছেলে–মেয়েসহ প্রথমবার দেখলাম ২৮ জুলাই। দেখলাম দেখার জন্য। কারণ, তখন দেশে সংঘটিত হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম হত্যা। তাই ছবির পর্দার চেয়ে মন পড়ে ছিল দেশের তরুণসমাজের দিকে। এরপর আবারও দেখার সুযোগ হলো ২৫ আগস্ট। আগেই বলেছি, বাংলা সিনেমা ও এর অভিনেতা–অভিনেত্রীদের নিয়ে আমাদের বোদ্ধা জনগোষ্ঠীর নাক সিটকানো ভাব আছে। কিন্তু এই সিনেমাতে অভিনেতা–অভিনেত্রীরা যেন তাঁদের সাধ্যের পুরোটুকু ঢেলে দিয়ে অভিনয় করেছেন। সবার কথা বাদ দিলেও, শাকিব খান যেন তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিনয় করেছেন। তাঁর অভিব্যক্তিগুলো ছিল খুবই বাস্তবসম্মত।
সিনেমার সেটগুলো মুগ্ধতা ছড়িয়েছে। দৃশ্য অনুযায়ী আলোক নিয়ন্ত্রণটাও ছিল দুর্দান্ত। সিনেমাটির ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরের কথা আলাদাভাবে বলতেই হয়। সিনেমার আবহ সংগীতের তালে তালে আপনার হৃদয় দুলে উঠবেই। পুরো হলের দর্শকদের পাশাপাশি হলের দেয়াল, দরজা, চেয়ারগুলোও যেন এই সংগীতে নেচেছে। আর মারামারির দৃশ্যগুলো ছিল অসাধারণ। আমাদের ছোটবেলায় বাংলা সিনেমার মারামারি মানেই ছিল একধরনের ‘ঢিসটিং ঢিসটিং’ শব্দ। সেখান থেকে বাংলা সিনেমা বেরিয়ে এসেছে। অনেকেই ‘তুফান’–এর গল্পকে দুর্বল বলছেন, কিন্তু আমার সেটা মনে হয়নি। থ্রিলারধর্মী সিনেমাতে গল্পের এমন আগে–পরে যাওয়াটা খুবই সাধারণ ব্যাপার। সিনেমাটি যখন দ্বিতীয়বার দেখতে গেছি, তখন পাশে বসা একজন নারী আমাদের ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আর ইউ এনজয়িং।’ সে উত্তর করেছিল, ‘আই নো দ্য স্টোরিলাইন।’
টান টান উত্তেজনা নিয়ে ‘তুফান’ শেষ হয়। এরপরই আসে আসল চমক। এটা এখনকার বিশ্বের সিনেমাগুলোর একটি ধর্ম, বিশেষ করে থ্রিলারধর্মী সিনেমায় পরের ঘটনার একটি পূর্বাভাস দেওয়া হয়। তুফানেও পরিচালক অত্যন্ত সুন্দরভাবে সেটি আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন। আশা করি ‘তুফান ২’ হবে আরও বেশি পরাক্রমশালী। সেটি নিশ্চয়ই তুফানের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়ে গড়বে নতুন ইতিহাস। এখন পর্দায় ‘তুফান ২’ দেখার অপেক্ষায় আছি এবং আমি নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি, ‘তুফান ২’–ও আমরা একাধিকবার দেখব। ঠিক যেমন বাংলা সিনেমার সোনালি অতীতে আমরা ভালো লাগার সিনেমা অনেকবার দেখতাম। পরিশেষে সিনেমার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ। ধন্যবাদ ‘তুফান’–এর অস্ট্রেলিয়া পরিবেশক বঙ্গজ ফিল্মসকে।
দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]