হ্যালোইন রাতে অতৃপ্ত আত্মার প্রতিশোধ

দূর পরবাস-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

কার্ভড পামকিন ও অতৃপ্ত আত্মার আহাজারিছবি সংগৃহীত

প্রাচীন যুগ থেকে ইউরোপের কেল্টিক জাতির মানুষেরা ধারণা করত, অক্টোবর মাসের শেষ দিনের রাতটি সব চাইতে খারাপ ও ভয়ংকর একটি রাত, যা হালোইনের রাত নামে পরিচিত। এই রাতে নাকি সব মৃত মানুষের প্রেতাত্মা ও অতৃপ্ত আত্মারা পৃথিবীতে বেঁচে থাকা দুষ্ট চরিত্রের ও শয়তান মানুষদের ওপর প্রতিশোধ নিতে মহাকাশ থেকে নেমে আসে ধরার বুকে, ঠিক মধ্যরাতের অন্ধকারে। তাই কেল্টিকরা এই রাতে বিভিন্ন ধরনের ভূতের পোশাক ও কাপড় পরত সেই সব প্রেতাত্মার মুখোমুখি হতে। তারা নির্ঘুম রাত কাটাতে আগুন জ্বালিয়ে রাখত। ভূত তাড়াতে তাঁরা মুখোশ পরে গোল করে একসঙ্গে ঘুরত, নেচে বেড়াত ও মন্ত্র জপত। তাদের এক প্রচলিত মিথ হলো, এই রাতে দেবতা ‘সামান’ যে নাকি ‘লর্ড অব দ্য ডেড’ নামেও খ্যাত, সে সব মৃত মানুষের আত্মাদের পৃথিবীতে নামার এক উদাত্ত আহ্বান জানাত। সেই আহ্বানে সাড়া দিতে অতৃপ্ত ও অসুখী আত্মারা উড়ন্ত ঝাড়ুতে করে হ্যালোইনের ডাইনির সঙ্গে উড়ে বেড়াত আকাশজুড়ে এবং পৃথিবীতে সমাবেশ ঘটাত ঘন গাছগাছালির গহিন অন্ধকার ছায়ায়।

কানাডা একটি মাল্টি কালচারাল কান্ট্রি। স্বভাবতই এখানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আগত মানুষের সমাগম। তাই অনেকেই মনে করে যে এটা একটি বারো ভূতের দেশ। এখানকার অসুখী মৃত মানুষের অতৃপ্ত আত্মারা ভীষণ প্রতিশোধপরায়ণ।

আইরিশ ও স্কটিশ অভিবাসীরা কানাডায় অভিবাসিত হয়ে এলে সঙ্গে করে হালোইনের নানান রীতিনীতিও নিয়ে আসে। কানাডিয়ানরা তাই জ্যাক-ও-লন্ঠন খোদাই করা মিষ্টিকুমড়ার ভেতরে আলোর সলতে জ্বালিয়ে ঘরের প্রবেশদ্বারের সুম্মুখে রাখে এবং দল বেঁধে শিশু-কিশোরেরা মাস্ক পরে ভুতুড়ে সাজসজ্জায় সেজে কড়া নাড়ে বিভিন্ন বাড়ির দরজায়। ‘ট্রিক অর ট্রিটার’ বলে ক্যান্ডি চায়। বাড়ির সামনে কুমড়া খোদাই করে রাখা, ভুতুড়ে বাড়ি বানানোর প্রয়াসে নরকঙ্কাল টাঙিয়ে ও মাকড়শার জাল ঝুলিয়ে রাখার মাধ্যমে হালোইন উদ্‌যাপন করে অক্টোবর মাসের শেষ রাতে।

কানাডার সব প্রদেশের মধ্যে অন্টারিও হচ্ছে সর্ববৃহৎ এক প্রদেশ। এই প্রদেশের সাদবাড়ি ডিসট্রিক্টটির কোল ঘেঁষে জর্জজিয়ান বে। অসংখ্য লেকের মিলনস্থলের সে এক বিশাল জলাধার। এই জলাধারের ঠিক উত্তর উপকূলে অবস্থিত কিলার্নে মিউনিসিপ্যালিটি। ছোট্ট এই মিউনিসিপ্যালিটির বিশাল এলাকাজুড়ে রয়েছে কিলার্নি প্রভিন্সিয়াল পার্ক। পরিত্যাক্ত বিশাল এলাকায় শুধু গাছগাছালির বনাঞ্চল আর উঁচু সাদা সাদা পাথরের ঢিবি, যা টার্টল রক নামে খ্যাত।

কিলার্নের চারপাশে বেশ কয়েকটি কমিউনিটি রয়েছে। আরও রয়েছে সেগল হার্টলে বে ও বিগ উড, গোস্ট টাউন অব ফ্রেঞ্চ রিভার। কিলার্নেতে অভিবাসী জনবসতির গোড়াপত্তন হয় ১৮২০ সালে। এর বহু আগে থেকেই সেখানে বাস করত অনেক আদিবাসী বা ‘ইনডেজিনাস পিপল’। অভিবাসনপ্রক্রিয়ায় ১৯০০ শতকের প্রথম দিকে এই কিলার্নেতে এক স্কটিশ ব্যবসায়ী, নাম ডেভিড অ্যান্ডারসন, তাঁর পরিবার অভিবাসিত হয়ে বসতি গড়ে। মূলত এই পরিবারের লক্ষ্য ছিল প্রাণীর লোমশ চামড়া (ফার) ব্যবসার। কিলার্নের পুরো এলাকাজুড়ে ছিল বনজ গাছগাছালি এবং বিশাল জলাধার। সেই জলাধারে ও বনে পাওয়া যেত বিভার, এরমাইন, ও স্যাবল নামের স্তন্যপায়ী প্রাণিকূল। সেসব প্রাণীদের হত্যা করে সেগুলোর লোমশ চামড়া ইউরোপের বিভিন্ন বাজারে চালান হতো।

ডেভিড অ্যান্ডারসন ছিলেন জাতিগতভাবে কেল্টিক বংশোদ্ভূত। ১৯০০ শতকের শেষ ভাগে অ্যান্ডারসন পরিবারের থার্ড জেনারেশনের কয়েকজন সন্তানসন্ততি ছিল। আংকেল, কাজিন ও ফার্স্ট কাজিন মিলে ছিল বিশাল এক পরিবার। তাদেরই এক সন্তান কলিন অ্যান্ডারসন। কলিনের চাচা জো অ্যান্ডারসন, তিনিও পরিবার নিয়ে থাকতেন কলিনদের বাড়ির একদমই কাছাকাছি। কলিন ও তার সমবয়সী চাচাতো ভাই এরিক একই স্কুলে এবং একই ক্লাসে লেখাপড়া করত।

কিলার্নেতে জন্ম নেওয়া কলিন ও এরিক বড় হয়েছে ওই লোকালয়ের আবহাওয়ায়। সেখানকার কিন্ডারগার্টেন ও পরবর্তী সময়ে স্থানীয় পাবলিক স্কুলে তাদের লেখাপড়ার গোরাপত্তন হয়। স্কুলে তাদের সঙ্গীরা ছিল বেশির ভাগ অভিবাসী সাদা চামড়ার ইউরোপিয়ান আর ছিল কিছু আদিবাসী।

আদিবাসী এক পরিবারের মেয়ে কিয়োনা। সে, কলিন ও এরিক একসঙ্গে একই ক্লাসে পড়ত। গত বছরই তারা হাইস্কুল শুরু করেছে। তাদের মধ্যে লোকদেখানো সহমর্মিতা ও সৌহার্দ্যের সম্পর্ক ছিল। কিন্তু অন্তরে ছিল বিষমেশানো ঘৃণা আর বর্ণবিদ্বেষ। তারা ‘ইনডিজেনাস পিপল’ বা আদিবাসীদেরকে মন থেকে গ্রহণ করত না। মুখে কৃত্রিম হাসি কিন্তু অন্তরে থাকত ঘৃণা।

এরপরও ক্লাসমেট হিসেবে কলিন ও কিয়োনার মধ্যে স্থাপিত হয়েছিল অন্তরঙ্গতা। এক বন্ধুসুলভ টানও ছিল দুজনার মধ্যে। টিফিন পিরিয়ডে ওরা দুজন লাঞ্চ সারত একত্রে। মাঝেমধ্যে দুজনে মিলে বেড়াতে যেত স্কুলেরই পাশের বিশাল প্রভিন্সিয়াল পার্কের বনে। স্কুল শেষে বাড়ি ফিরত একই পথে এবং একই সঙ্গে। উইকএন্ডে তারা পরিবারের সঙ্গেই চার্চে যেত এবং উপাসনা শেষ হলে দল বেঁধে ফরেস্ট ট্রেইলে হাইকিংয়ে বের হতো। এরিকও ওদের সঙ্গে যোগ দিত কোনো কোনো দিন। কলিন হাইকিং বুট পরে এবং ব্যাকপ্যাক পিঠে নিয়ে কিয়োনার হাত ধরে ট্রেইলের আঁকাবাঁকা দুর্গম পথ ধরে হাঁটত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফিরত ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে।

কিলার্নে মিউনিসিপালিটি
ছবি সংগৃহীত

কিয়োনার মা উইনোনা এই সাদা ছেলের সঙ্গে এ রকম ঘোরাফেরা করতে দেখে মাঝেমধ্যে কিয়োনাকে ভর্ৎসনা করতেন। সাবধান করে একদিন বললেন, দেখো মেয়ে, ওরা আমাদের জাত না। ওদের রক্তে আছে রেসিজম, ঘৃণা, ও বর্ণবিদ্বেষ। মানুষকে অবজ্ঞা ও হেয় করা ওদের প্রধান ধর্ম। তাই সাবধান হয়ে মেলামেশা কোরো কিন্তু। কিয়োনা বলত মা, ও তো আমার ক্লাসমেটমাত্র। শুধু প্রিয় একজন বন্ধু। আর কিছুই না মা।

কলিন ও কিয়োনার এই কাছাকাছি আসা ও মেলামেশাকে এরিক ভালো নজরে দেখতে লাগল না। তার অনেক রাগ ও হিংসা হতে লাগল। তাই সে কলিনের বাবা ও বদমেজাজি ছোট চাচার কাছে নালিশ করে বসল। সে নালিশের পরিপ্রেক্ষিতে অ্যান্ডারসন পরিবারের বয়স্ক ব্যক্তিরা, অর্থাৎ চাচা, ফুফুরা মিলে এক ফ্যামিলি মিটিংয়ের আয়োজন করল। সেখানে সিদ্ধান্ত হলো, এর একটা বিহিত করতেই হবে এবং ব্যবস্থা নিতে এরিককেই দায়িত্ব দেওয়া হলো।

জুলাই মাসের একদিন। সামার ভ্যাকেশন উপলক্ষে হাইস্কুল বন্ধ। কলিনকে পাঠানো হলো ব্যবসার এক কাজে সাদবাড়ি ডিসট্রিক্ট শহরে। দুপুরের পর এরিক কিয়োনার সঙ্গে যোগাযোগ করে বলল, ও হাইকিংয়ে বের হচ্ছে, সে যাবে কি না। কলিনও যাবে।

কিয়োনা রাজি হলো কিন্তু এসে দেখে যে কলিন যাচ্ছে না। কারণ, বাবার আদেশে ব্যবসার কাজে তাকে সাদবাড়ি যেতে হয়েছে হটাৎ করেই। কিয়োনার মনটা খারাপ হয়ে গেল এবং একরকম অনিচ্ছা সত্ত্বেও মনের বিরুদ্ধে যেতে হলো এরিকের সঙ্গে। তার জীবনের শেষ হাইকিংয়ে।

সন্ধ্যার একটু পরই এরিক তার বাড়িতে ফিরে এল। ছোট চাচাকে ইশারা করে জানান দিল, দ্য গেম ইজ ওভার। ছোট চাচা ভ্রু কুঁচকিয়ে শয়তানের এক মুচকি হাসি হেসে নিল।

২.

সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে এল। কিয়োনা এখনো বাড়িতে ফিরল না। মা ইউনোনা উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। মা তাঁদের পাশের সব জায়গায় পাগলের মতো দৌড়াদৌড়ি করে খোঁজ করতে লাগল। অ্যান্ডারসন ফ্যামিলিদের কাছেও জিজ্ঞাসা করল। কোনো সদুত্তর পেল না।

আত্মীয়স্বজনের বাড়ি বাড়িও গেল। কিন্তু কোথাও মিলল না। রাত শেষে ভোর হলো। সকালের সূর্যের প্রথম আলো পূর্ব দিগন্তে উদ্ভাসিত হয়ে দিনের যাত্রা শুরু করল কিন্তু কিয়োনার দেখা নেই।

পাগলপ্রায় মা ইউনোনা ও ছোট বোন এলিনা আদিবাসীদের গোত্রপ্রধানের কাছে গেল এবং সব খুলে বলল। গোত্রের সব লোকজন দল বেঁধে বিশাল প্রভিন্সিয়াল পার্কের আনাচকানাচে তন্ন তন্ন করে সার্চ করেও কিয়োনার হদিস পেল না। অবশেষে দলপ্রধান তাঁর গোত্রের কিছু লোকজন নিয়ে থানায় এজাহার দিলেন। এফআইআর–এ লেখা হলো, একজন ১৬ বছর বয়সী ইনডিজেনাস গার্ল মিসিং। পুলিশ খুব তৎপরতা দেখাল কিন্তু লেকের পাড়ে পরে থাকা কিয়োনার হাইকিং বুট ছাড়া তারা আর কিছু উদ্ধার করতে ব্যর্থ হলো। পুলিশের পক্ষে কোনো গাফিলতিও ছিল না। তারা সর্বাত্মক চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু কোনো ক্লু পুলিশ পেল না বিধায় এই মিসিং ইয়ং গার্ল কিয়োনার ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারল না। দুই মাস পার হয়ে গেলেও পুলিশ জানাল যে তারা এখনো আশাবাদী, এই মিসিং কেসের সুরাহার বিষয়ে।

দেখতে দেখতে তিন মাস অতিক্রম করল। এল অক্টোবর মাস। ৩১ সে অক্টোবরের শেষ রাত। হ্যালোইনের রাত। কিয়োনার মা ঘরে প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখল। এই বিশ্বাসে যে তাঁর মেয়ে যদিবা এই রাতের অন্ধকারে ফিরে আসে।

অ্যান্ডারসন ফ্যামিলির সব কয়টা হাউসের সামনে পামকিন কার্ভড করে সাজিয়ে রাখল হ্যালোইন রাত উদ্‌যাপন উপলক্ষে। ভূতের মুখমণ্ডলে কার্ভড করা পামকিনগুলোকে দেখে মনে হচ্ছিল, তারা দাঁত খিঁচিয়ে হাসছে। নেইবারহুডের অন্য সব হাউসগুলো উজ্জ্বল আলোয় সাজানো। ভূতপ্রেতের প্রতিকৃতি সাঁটানো। সন্ধ্যা হতে হতেই যথারীতি মহল্লার কিশোর–কিশোরীরা দল বেঁধে ক্যান্ডি সংগ্রহে বেড়িয়ে পড়েছে। বাড়িগুলোর ডোরে ডোরে গিয়ে ‘ট্রিক অর ট্রিটার’ করছে।

ক্যান্ডি বিলানো প্রায় শেষ। কলিন ও এরিক একসঙ্গে ডিনার সেরে ড্রিংক করতে বসে এরিকের বাসার লিভিং রুমে। অতিরিক্ত ড্রিংক করে কলিন হেলেদুলে নিজ বাড়িতে রাত্রির দ্বিপ্রহরে চলে গেলেও এরিক আরও কয়েক পেগ পান করতেই থাকে।

অক্টোবরের শেষ থেকেই তাপমাত্রা নিচের দিকে নামতে শুরু করে এবং ঠান্ডা পড়া শুরু হয়। আজ আবার সন্ধ্যার পর থেকই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। অদ্ভুত সুন্দর এক পরিবেশ। এই পরিবেশ হ্যালোইনের রাতটিকে আরও যেন আকর্ষণীয় করে তুলেছে।

বাড়ির সামনে অতৃপ্ত আত্মার সমাবেশ
ছবি সংগৃহীত

এর আগে কিয়োনা তাঁর সতীর্থ আত্মাদেরকে নিজের প্রাণ বধের কাহিনি শুনিয়েছে। সেই করুণ ও লোমহর্ষক গল্প শুনে মরজগতের আত্মারা শিহরিত হয়ে অনেক কেঁদেছে। সব আত্মা সেই জিঘাংসার প্রতিশোধ নিতে বদ্ধপরিকর। তারা জোট বেঁধে ওই হত্যার প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে এবং পরিকল্পনা করে।

আজ এই হ্যালোইনের রাতের পরিবেশটা খুবই উপযোগী, তাই অতৃপ্ত আত্মারা শয়তান এরিকের ওপর প্রতিশোধ নিতে বেড়িয়ে পড়ে রাতের অন্ধকারে। কিয়োনার অশান্ত ও অতৃপ্ত আত্মা উড়ন্ত ঝাড়ুতে করে হ্যালোইনের সতীর্থ ডাকিনীরদের সঙ্গে দল বেঁধে উড়ে আসে কিলার্নের সেই নেইবারহুডে। বিশাল প্রভিন্সিয়াল পার্কে সমাবেত হয় ঘন গাছগাছালির গহিন অন্ধকার ছায়ায়। প্রভুর নামে শপথ নিয়ে দৃঢ়চিত্তে বলীয়ান হয় অপূর্ব এক প্রতিশোধ নিতে। কিয়োনার সব সঙ্গী আত্মারা হাতে তুলে নেয় ধারালো অস্ত্র। কিয়োনা একটা কালো রঙের হুডিওয়ালা আলখাল্লা পড়ে হাতে নেয় দুধারি শার্প সাইদ নামক অস্ত্র। অন্য হাতে থাকে ক্যান্ডির ছোট্ট থলে।

সদলবলে এগিয়ে যায় এরিকের বাড়ির সামনে। দরজায় করে নক নক। মদ্যপানে চুর হয়ে থাকা মাতাল এরিক কিছু না বুঝেই বলে ওঠে, হু ইস দিস? জবাবে সে শুনতে পায়, ট্রিক অর ট্রিটার।

এরিক দরজা খুলে কয়েকটা ক্যান্ডি দিতে বের হয়। মুহূর্তেই কিয়োনা এরিকের শার্টের কলার ধরে। নিচে নামিয়ে মাটিতে নুইয়ে ফেলে। এরপর সঙ্গী প্রেতাত্মারা তাকে নিয়ে তোলে হাইকিংয়ে যাওয়ার সেই পথে। দুই মাইল পথ টেনেহিঁচড়ে নিয়ে আসে লেকের পাড়ের ওই সাদা পাথরের ঢিবিতে। যেখানে কিয়োনাকে গলায় ফাঁস দিয়ে ও পাথরের আঘাতে মেরে ফেলেছিল।

তারপর অতৃপ্ত আত্মারা একসঙ্গে এরিককে খোঁচাতে থাকে ধারালো সব অস্ত্র দিয়ে। মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আঘাতের পর আঘাত করতেই থাকে। অবশেষে এরিকের রক্তমাখা নিথর মৃতদেহ সাদা পাথরসংলঘ্ন জর্জজিয়ান বে লেকের পানিতে ফেলে দেয়। উপুর হওয়া এরিকের ডেড বডি লেকের স্বচ্ছ জলে ভাসতে থাকে।

এরপর অতৃপ্ত আত্মার সঙ্গীরা চলে গিয়ে হাওয়ায় মিলে গেলে কিয়োনা একা ক্ষণিক বিশ্রামের জন্য একটা সাদা পাথরের ওপর বসে পড়ে। আজ সে অনেক ক্লান্ত ও শ্রান্ত কিন্তু তৃপ্ত। অপূর্ব এক প্রতিশোধ নিতে পেরে সে অনেক খুশি আজ।

কিয়োনা বসে বসে অনুভব করে তার পাশে কয়েকটি বিভার, এরমাইন, স্যাবল প্রাণী ঘুরছে–ফিরছে আর কথা বলছে। বলছে, জান, তোমাকে ওরা মেরে ফেলল কেন। তুমি যে তাদের থেকে ভিন্ন। তারা ছিল প্রবাসী অভিবাসী আর তুমি আমাদের এই বনের গাছগাছালির মানুষ। এই বিশাল জলাধারের রাজকন্যা তুমি। তুমি আদিম ও অকৃত্রিম। আমাদের আদিবাসী। সে জন্যই তোমাকে অকালে প্রাণ দিতে হলো। তুমি যখন মরে পানিতে ভাসছিলে, তখন আমরা গাছের ডালপালা দিয়ে শক্ত একটা র‍্যাফটের মতো ভেলা বানিয়ে আমাদের মুখ দিয়ে তোমাকে ঠেলে ঠেলে তার উপর উঠিয়ে ভাসিয়ে দিই ‘জর্জজিয়ান বের বিশাল জলরাশির স্রোতে। যেন তোমার দেহের পবিত্রতা রক্ষা পায়, আর কেউ যেন তোমাকে খুঁজে পেয়ে অবজ্ঞা বা অপমান করতে না পারে। কিয়োনা এই সব স্তন্যপায়ী প্রাণীগুলো বিভার, এরমাইন, ও স্যাবলকে অনেক অনেক ধন্যবাদ জানায়।

কিয়োনা সাদা রক পাথরের ওপর বসে মা ও বোন এলিনার কথা ভাবতে থাকে। মা, পুলিশ ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কাছে সে মিসিং হয়েই থাকবে আজীবন। সে কখনো আর বাড়িতে ফিরবে না। তার নামের গিফট বক্সগুলো অন্য কেউ আর খুলে দেখবে না। মায়ের কাছ থেকে আর বেডটাইমে গল্প শোনা হবে না।এলিনার সঙ্গে লুডু খেলা হবে না। টিভিতে কার্টুন ছবিও দেখা হবে না।

দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে এসব কথা ভেবে কিয়োনার চোখে জল এসে যায়। চোখের জল মুছে আকাশপানে তাকিয়ে দেখতে পায়, আকাশনীলায় নক্ষত্রের আলোগুলো কেমন যেন নিবু নিবু হয়ে জ্বলছে। দিগন্তবিস্তৃত কালো নিকষ অন্ধকার বনের গাছপালা ছুঁয়ে গেছে। আকাশের তারাগুলো বহু দূর হতে মিটমিট করে জ্বলে পৃথিবীর দিকে নির্লিপ্ত চোখে চেয়ে আছে। সাদা পাথরের ধারে শতবর্ষের একটা উইলোগাছ দেখতে পায় কিয়োনা, যার পাতাগুলো ঝিরিঝিরি করে কাঁপছে অক্টোবরের শেষ রাতের মৃদুমন্দ ঠান্ডা বাতাসে। উইলোর সরু সরু ঝুলন্ত ডালের চিকন পাতাগুলো এমন করে নড়ছে, যেন মনে হচ্ছে অসংখ্য দলহারা ডিমনরা গাছের ডাল ধরে ঝোলাঝুলি খেলছে।

*লেখক: রানা টাইগেরিনা, টরন্টো, কানাডা

পাদটীকাঃ কিলার্নে মিউনিসিপ্যালিটির তথ্যগুলো তাঁদের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া।