আইসল্যান্ডিক ঐতিহ্যের ছোট্ট শহর গিমলি

জেটিতে বাঁধা জাহাজ

কানাডায় আসার মাস দুয়েকের মাথায় সামার আসে। আমাদের ভাগ্য বেশ প্রসন্নই বলা চলে, জুন মাসের মাঝামাঝি বেশ উষ্ণ হয়ে উঠেছিল চারপাশ, কিছুটা চৈত্র মাসের গরমের মতো। শীতের রুক্ষতার শেষে প্রকৃতি চারদিকে উজাড় করে তার সৌন্দর্য ঢেলে দিয়েছে। চারদিকে অদ্ভুত সুন্দর সবুজ পাতা, রঙিন ফুল আর নীল আকাশের সৌন্দর্যে চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। এরই মধ্যে আমাদের স্টুডেন্ট হাউজিংয়ের সবাই মিলে ঘুরে এলাম লেক উইনিপেগের তীরে ছোট্ট শহর গিমলি থেকে।

গিমলি সৈকত

উইনিপেগ শহর থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরত্বে লেক উইনিপেগের তীরে ছোট্ট শহর গিমলি। শহর থেকে বের হতেই দেখি, দুই পাশে মাঠের পর মাঠে সবুজ গমের খেত। কোথাও কোথাও আমাদের দেশের শর্ষের মতো ক্যানুলার খেত হলুদ হতে শুরু করেছে। সূর্যমুখীর খেতে এখনো ফুল আসেনি। দুই পাশেই চোখজুড়ানো সৌন্দর্য দেখতে দেখতেই আমরা পৌঁছে গেলাম আমাদের গন্তব্য গিমলিতে। গিমলি শহরের জন্ম হয়েছে আইসল্যান্ডিক সেটেলারদের হাতে। প্রায় ১০০ বছর আগে ১৯০৮ সালের দিকে কিছু আইসল্যান্ডিক সেটেলারদের আগমনে প্রথম গিমলি গ্রামের যাত্রা শুরু হয়। আইসল্যান্ডে আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণের ফলে অনেকেই বাধ্য হয়ে চলে আসেন কানাডাতে, তা-ও প্রায় ১৮৭৫ সালের দিকে। তাঁদের থেকে কিছু পরিবার এসে উপস্থিত হয় লেক উইনিপেগের তীরে। প্রথম প্রথম গিমলিকে নিউ আইসল্যান্ড নামেও লোকজন চিনতেন। ১৯৪৮ সালে গিমলিকে টাউনের মর্যাদা দেওয়া হয়, যা ২০০৩ সালে মিউনিসিপ্যালিটিতে পরিণত হয়। মাত্র হাজার দুয়ের মানুষের এ ছোট্ট শহরের এখনো পরতে পরতে আইসল্যান্ডিক সংস্কৃতিকে ধরে রেখেছে। এখনো কৃষিকাজ আর লেক উইনিপেগে মাছ ধরাই গিমলির অধিবাসীদের প্রধান পেশা। শুনে অবাক লাগলেও, এটাই সত্য। লেক উইনিপেগে মাছ ধরার জন্য বেশ কিছু ছোট-বড় জাহাজ আর ইঞ্জিনচালিত নৌকা গিমলির জেটিতে বাঁধা থাকে।

ভাইকিং পার্ক

লেক উইনিপেগ পৃথিবীর ১২তম বড় লেক, প্রায় বাংলাদেশের ছয় ভাগের এক ভাগের সমান। এসব নৌকাতেই সমুদ্রের মতো বিশাল লেক উইনিপেগে মাছ ধরতে যান গিমলির জেলেরা। এ মাছ চলে যায় আমাদের শহর উইনিপেগসহ আরও অনেক ছোট-বড় শহরে।

সাজানো-গোছানো ছোট্ট গিমলি শহরের মাঝ দিয়ে কিছু দূর যেতেই পেয়ে গেলাম সৈকতের। সৈকতের এক পাশে বেশ কিছু হোটেল, অন্য পাশে রেস্টুরেন্ট। গাড়ি রেখে সৈকতের দিকে এগিয়ে যেতেই দেখা পেয়ে গেলাম লেক উইনিপেগের। ছোট ছোট নুড়ি পাথরের সৈকত প্রস্থে বড় না হলেও দৈর্ঘ্যে বেশ বড়। কিছু দূর এগিয়ে যেতেই নৌকা রাখার বিশাল জেটি। লেকের পানিতে অনেকেই সাঁতার কাটছেন, কেউবা জেট স্কি চালাচ্ছেন। আমরাও নেমে গেলাম পানিতে দাপাদাপি করতে। পানি থেকে উঠে সবার যখন খিদেয় মাথা খারাপ অবস্থা, তখনই জানলাম, গিমলির বিখ্যাত ফিশ অ্যান্ড চিপসের কথা। রেস্টুরেন্টের বাইরে বেশ বড় লাইন, অপেক্ষায় থাকতে হবে খেতে চাইলে। ক্ষুধায় বেশ খারাপ অবস্থা সবার, তাই অন্য আরেক দিন মেনুতে রাখলাম ফিশ অ্যান্ড চিপস।

লেক উইনিপেগের তীরে গিমলি সৈকতে

এখানে পূর্বপুরুষ আইসল্যান্ডিক ভাইকিংদের স্মরণে রয়েছে ভাইকিং পার্ক। সবাই মিলে সেখানেই গেলাম। দারুণ এক ভাইকিং যোদ্ধার ভাস্কর্য পার্কের মাঝে। চারদিকে বেশ একটা শান্তি শান্তি আবহাওয়া এখানে। লেকের ঠিক পাশেই অনেকের বাড়ি। দেখে বেশ অবাক লাগছিল, সকালে উঠেই এক কাপ চা হাতে নিয়ে লেকের মিষ্টি বাতাসে না জানি কী দারুণ ব্যাপার এখানকার অধিবাসীরা উপভোগ করেন।  

আমরা পার্ক থেকে চলে গেলাম জেটির উদ্দেশে। গিমলিতে জেটির কাছেই ছোট্ট একটা পুরোনো লাইটহাউস আর জেটির রেলিং ধরে হেঁটে শেষ মাথায় গেলে সেখানে আরেকটি লাইটহাউস। জেটির কাছের পুরোনো লাইটহাউসে আর আলো জ্বলে না। বেশ অনেক বছর আগে এটি ভেঙে গেলে সেটিকে মেরামত করে জেটির পাশে রেখে দেওয়া হয়েছে। সন্ধ্যায় জেটি ধরে এগিয়ে দেখা মিলল দূরের দু-একটা জাহাজ মাছ ধরে ফিরে আসছে গিমলির দিকে। শৌখিন মৎস্যশিকারিদের বেশ আনাগোনা এখানটায়। জেটির পাশে বসে ছিপ ফেলে বসে বসে বাতাস খাচ্ছেন। অনেকেই মাছও পাচ্ছেন। কেউ একজন দেখলাম, গিটার হাতে নিয়ে অচেনা সুরে গান গাচ্ছেন। জীবনের বিভিন্ন রঙে যেন রঙিন চারপাশ।

গিমলির জেটি

উইনিপেগ শহরের বেশ কাছে হওয়াতে গিমলিতে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন থাকে। এদের মধ্যে গিমলি ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ও গিমলি সেইলিং বা পাল তোলা নৌকার উৎসব অন্যতম। এ ছাড়া বাৎসরিক আইসল্যান্ডিক ফেস্টিভ্যালের আয়োজন হয়ে থাকে আগস্টের প্রথম সপ্তাহে। হাজারো মানুষের আগমনে মুখর হয়ে যায় গিমলি। ফেস্টিভ্যালে মূলত আইসল্যান্ডিক খাবার, পোশাক, গয়না, নাটক, গান আর খেলাধুলার আয়োজন থাকে। আইসল্যান্ডের সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যকে সবার কাছে উপস্থাপনা করাই এর মূল উদ্দেশ্য।

কত গল্প আর ইতিহাস ছড়িয়ে আছে একসময়ের ওই ছোট্ট জেলেগ্রাম গিমলিতে, পরেরবার সেগুলোই জানার চেষ্টা থাকবে।