শিক্ষার শুরু হোক দায়ভার নিয়ে। দায়ভার কী? দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করাকে দায়ভার বলা যেতে পারে। জ্ঞানের আরেক নাম সচেতনতা। সচেতনতা অর্জন করতে বর্জন করতে হবে অসচেতনতাকে। একে বর্জন করতে হলে প্রশিক্ষণের শুরুতে কিছু norms and values থাকতে হবে।
দেশে প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে বই বিতরণ করা হচ্ছে দেখে ভালো লেগেছে। এখন দরকার প্রশিক্ষণ ও পরীক্ষার ধরন পাল্টানো, যাতে করে দেশে ভালো, সৃজনশীল ও সুশিক্ষা পাওয়া সম্ভব হয়। কারণ, শিক্ষা এমন একটি বিষয়, যা বিক্রি করতে না পারলে হতাশা এবং গুদামজাত হবে এবং পরে তা অকেজো হয়ে সমাজে অশান্তির সৃষ্টি করবে।
পাশ্চাত্যে শিশুর জন্মের শুরুতে তাদের পরিবর্তিত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সুন্দর পরিকাঠামোর মধ্য দিয়ে সুশিক্ষার ব্যবস্থা এবং সেই সঙ্গে একটি মাসিক ভাতা দেওয়া হয়। এই ভাতার কিছু অংশ অনুদান হিসেবে এবং বাকি অংশ ধার হিসেবে দেওয়া হয় খুব কম সুদে। শিক্ষাজীবন শেষে যখন তারা কর্মজীবন শুরু করে, তখন ধারের অংশ আস্তে আস্তে পরিশোধ করে থাকে। পাশ্চাত্যের শিক্ষা মডেলকে বিবেচনা করে বাংলাদেশের প্রশিক্ষণের কিছুটা রদবদল করতে পারলে দেশের শিক্ষার মান বাড়বে বই কমবে না। সে ক্ষেত্রে যেমন যারা অষ্টম শ্রেণি শেষ করেছে, পড়ার প্রতি আগ্রহ কম বা কর্মে জড়িত হতে চায়, তাদের সেভাবে সুযোগ করে দেওয়া যেতে পারে। যেমন কাজের মাধ্যমে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা (one the job training)।
ফিনল্যান্ড বা সুইডেনের স্কুলে যেমন নবম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের সবকিছুই ফ্রি। দশম শ্রেণি থেকে তাদের মাসিক ভাতা দেওয়া হয়, যার এক-তৃতীয়াংশ অনুদান, বাকিটা ধার হিসেবে। প্রতি টার্মে শিক্ষার্থীদের তাদের সিলেবাস অনুযায়ী পড়াশোনা করতে হয়। যদি কোনো শিক্ষার্থী তার শিক্ষার ফলাফল আশানুরূপ পর্যায়ে উপনীত হতে ব্যর্থ হয়, তখন এর কারণ কর্তৃপক্ষকে জানাতে হয়। এই কারণ দর্শানো যদি কর্তৃপক্ষের মনঃপূত না হয় তখন তাদের মাসিক ভাতা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর মূল উদ্দেশ্য হলো তারা যেন লেখাপড়ায় বেশি মনোযোগী হয়।
শিক্ষার্থীদের চাহিদা অনুযায়ী, প্রশিক্ষণের ধরন তৈরি করে নাগরিকের হাতে দেশের দায়ভার তুলে দেওয়া হতে পারে সাফল্যের এক চমৎকার পরিকল্পনা (plan for success)। মনে রাখতে হবে শিক্ষার্থীদের সাফল্য মানেই দেশের সাফল্য। একটি সচেতন জাতির নৈতিক মূল্যবোধের (moral values) উন্নতি এভাবেই হয়ে থাকে।
ফিনল্যান্ড বা সুইডেনের শিক্ষা প্রশিক্ষণে শিক্ষার্থীদের সরকার ধার দেয়, যার ফলে তারা মা-বাবার ঘাড়ে চেপে বসে থাকে না। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন ঘটে। এ কারণে তারা নানা অসৎ কাজকর্ম থেকে বিরত থাকে। ফলে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তাদের প্রশিক্ষণ শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশ করে।
কর্মের শুরুতেই তারা সরকার থেকে যে ধার নিয়েছিল, তা মাসে মাসে ফেরত দিতে শুরু করে। এ ধার শোধ দেওয়ার সময়সীমা কর্মজীবনের ব্যাপ্তি, অর্থাৎ ৬৫ বছর পর্যন্ত। ৬৫ বছর কর্মের পর তারা অবসরজীবনে চলে যায় এবং সিনিয়র নাগরিক হিসেবে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে। ফিনল্যান্ড বা সুইডেনের শিক্ষা প্রশিক্ষণের মতো সুযোগ-সুবিধা যদি বাংলাদেশে চালু করা যায়, তবে শিক্ষার্থীরা প্রশিক্ষণের শুরুতেই খুঁজে পাবে এর গুরুত্ব, যা তাদের মোটিভেট করবে এবং জানার জন্য শিখবে বলে আমি মনে করি। প্রশিক্ষণের ধরন পাল্টানো মানে শুধু শিক্ষাপদ্ধতির পরিবর্তন বা নকল নিয়ন্ত্রণ করা নয়। অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধাসহ মনিটরিং পদ্ধতি চালু করা দরকার।
সরকার বেশ উঠেপড়ে লেগেছে শিক্ষার পরিবর্তনে, কিন্তু যদি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাপনা দুর্বল হয়, সে ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে উপনীত হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। কারণ, পরিবর্তনের পেছনে যদি যুক্তিসম্পন্ন পরিকল্পনা না থাকে, তবে সৃজনশীল বা স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব নয়। তাই দরকার একটি ভালো, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা তৈরি করা দেশের প্রশিক্ষণের পুরো পরিকাঠামোর ওপর। যেমন যেসব শিক্ষার্থী ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হচ্ছে, তাদের পেছনে সরকার অনেক অর্থ ব্যয় করছে। দেখা যাচ্ছে, তাদের অনেকই পরে দেশ ছেড়ে বিদেশে চলে যাচ্ছে। দীর্ঘ পাঁচ থেকে ছয় বছর যে পরিমাণ অর্থ সরকার বিনিয়োগ (ইনভেস্ট) করছে, সেটা ধার হিসেবে দিলে পরবর্তী সময় সে অর্থকে নতুন শিক্ষার্থীর পেছনে ইনভেস্ট করা সরকারের জন্য সহজ হবে এবং দেশে সীমিত ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার থেকে বেশি ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার পাওয়া সম্ভব, সে ক্ষেত্রে নতুন নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু করারও সুযোগ বাড়বে। এ বছর যে পরিমাণ শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে, মেধাবী শিক্ষার্থী হওয়া সত্ত্বেও তারা ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হতে পারছে না সীমাবদ্ধতার কারণে। হয়তো কথা উড়বে দেশ ভরা ভূরি ভূরি ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হলে পরে চাকরি পাবে না, তখন বেকার হয়ে ঘরে বসে থাকবে। না থাকবে না, যদি আমাদের কূটনীতিকেরা তাঁদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেন। তবে বিশ্বের অনেক দেশেই এসব ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ারের চাকরির সুন্দর ব্যবস্থা করা সম্ভব। কূটনৈতিক এবং দূতাবাসের কাজকর্মের ওপর বা তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কেও আমাদের সচেতন থাকতে হবে, কিন্তু দেশের কোথাও কূটনৈতিকদের নিয়ে আলোচনা হয় বলে আমার চোখে পড়েনি আজও।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এবং তাদের দায়িত্বে থাকা দূতাবাসগুলোর ব্যবস্থাপনার জন্য যে বাজেট, সেই মোতাবেক রিটার্ন কি তাঁরা দেশকে এবং দেশের মানুষকে দিচ্ছে? তার কি কোনো খবর আমরা রাখি? আমি শুনেছি তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাদের নিজ নিজ স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে সময় নষ্ট করেন। তেমন কোনো সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে তাঁদের দেখা যায় না, যার ফলে তেমন কোনো আশানুরূপ ফল বাংলাদেশ পাচ্ছে না। বাংলাদেশের জনগণের জানা দরকার, এসব কূটনৈতিকদের কী কাজ এবং জাতি তাঁদের থেকে কী প্রত্যাশা করে।
একটি গরিব দেশকে সুন্দর করে গড়ে তুলতে দরকার সমবেত প্রচেষ্টা। সেসব প্রচেষ্টার একটি হলো আন্তরাষ্ট্রীয় যোগাযোগ বৃদ্ধি করা। আর সে কারণেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ তার দূতাবাসগুলো স্থাপন করে রেখেছে, যাতে করে বাংলাদেশ বৈশ্বিক সব সুযোগ-সুবিধা ঠিকমতো ভোগ করতে পারে। বাংলাদেশের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সুসম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে, কিংবা আন্তরাষ্ট্রীয় বিপদে-আপদে বন্ধু দেশগুলো পাশে এসে দাঁড়াতে পারে! বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের শিক্ষা এবং ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি করা প্রয়োজন এবং প্রয়োজন বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা। আমরা যেমন বিদেশি বিনিয়োগ চাই, তেমনি আমাদের যাঁরা প্রবাসী আছেন, তাঁদের বিনিয়োগও আমরা পেতে চাই। সুইডেনে যেমন প্রতিবছর হাজার হাজার ডাক্তার বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে এসে এখানকার হাসপাতালে কাজ করছেন। এসব সুযোগ-সুবিধা পেতে দরকার রাষ্ট্রের সব দায়িত্বশীল নাগরিকের সমন্বিতভাবে পরিকাঠামোর উন্নয়নে কাজ করা।
বর্তমানে শিক্ষা প্রশাসনের যে পরিস্থিতি, তাতে আনাড়ি ছেলেদের ফুটবল খেলার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। মাঠের যেখানে ফুটবল যায়, সেখানে সবাই জট পাকায়। কখনো কখনো গোলরক্ষকেরাও নিজ জায়গা ছেড়ে দিয়ে ফুটবলের পেছনে সারা মাঠ চষে বেড়ায়। সবার লক্ষ্য ফুটবলে লাথি মারা। কার লাথি খেয়ে বল কোনো গোলে ঢোকে, সেদিকে কারও খেয়াল থাকে না। আমাদের বাংলাদেশের শিক্ষার অবস্থা দাঁড়িয়েছে আনাড়ি খেলোয়াড়দের ফুটবল খেলার মতো। যখন যে ঘটনা ঘটছে, সে ঘটনার পেছনে গোটা জাতি ছুটছে। ফলে কোনো সমস্যার সমাধান মিলছে না। অসংখ্য সমস্যার বাঁধছে জট। পরিস্থিতি মোটেই সুখকর নয়। দেশের সর্বাঙ্গীণ শিক্ষা উন্নয়নে কড়া নজর দিতে হবে। আনাড়ি খেলোয়াড়দের দ্বারা পরিচালিত না হয়ে উদ্দেশ্যমূলক শিক্ষা ব্যবস্থাপনার ওপর নজর দেওয়া দরকার। সব শিক্ষার্থীকে শিক্ষা (স্টাডি) লোন দেওয়া এবং জ্ঞান অর্জনে সাহায্য করা হোক সরকারের নতুন উদ্যোগ। শুধু বর্তমানে কেমন চলছে, তা দেখলে হবে না। আগামী ১০ বছর পর কেমন চলবে, সে বিষয়ের ওপর গুরুত্ব প্রদান করা দরকার। আজকের দিনটা আগামীকাল হয়ে যাবে গতকাল, এ কথা মনে রেখে দেশের শিক্ষা প্রশিক্ষণ পরিকাঠামোর ওপর কাজ করা দরকার। সৃজনশীল শিক্ষা পেতে এবং প্রশিক্ষণের মান উন্নত করতে শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ করা আশু প্রয়োজন।