বাংলাদেশের নির্বাচনে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ঠিক কতটা উপযোগী

একটি কেন্দ্র ভোট দিয়েছেন একজনছবি: প্রথম আলো

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তিন মাসের মাথায় নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের বিষয়টি যতই এগোচ্ছে, সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক (প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন বা পিআর) পদ্ধতির কথা ঘুরেফিরে আসছে আলোচনায়। নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও গণমাধ্যমকর্মী নানা ফোরামে আয়োজিত আলোচনা সভায় বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন পদ্ধতির পক্ষে-বিপক্ষে মত দিচ্ছেন।

সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক বা প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন পদ্ধতি হচ্ছে এমন একটি নির্বাচন পদ্ধতি, যে পদ্ধতিতে সংসদে আসন বরাদ্দের ভিত্তি হয় রাজনৈতিক দল বা প্রার্থীদের প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ সর্বমোট ৩৫০টি আসন নিয়ে গঠিত। এর মধ্যে ৩০০টি আসনে সরাসরি ভোটের মাধ্যমে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। অবশিষ্ট ৫০টি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত। ৩০০ আসনে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের ভোটে এসব নারী সদস্যরা নির্বাচিত হন। বাংলাদেশে যদি সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক বা প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করা হয়, তাহলে দেশের মোট ভোটের শতকরা হারে নির্বাচনে অংশ নেওয়া দলগুলোর মধ্যে আসন বিন্যস্ত হবে।

প্রথম আলো ফাইল ছবি

উদাহরণস্বরূপ, জনসমর্থনের ভিত্তিতে এত দিন পর্যন্ত বিএনপি ও আওয়ামী লীগ—এ দুটি রাজনৈতিক দল ছিল বাংলাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। জাতীয় নির্বাচনে মোট ভোটের শতকরা ৪০ ভাগ যদি বিএনপি ও আওয়ামী লীগের পক্ষে আসে, তাহলে এ দুই রাজনৈতিক দলের উভয়ই সংসদে ১২০টি করে আসন পাবে। বিগত জাতীয় নির্বাচনগুলোতে আমরা যেমনটি দেখেছি যে কোনো নির্দিষ্ট আসনে ভোটাররা প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে ওই আসনে তাঁদের সংসদ সদস্যকে নির্বাচিত করেন। যদি এ পদ্ধতিতে নির্বাচন আয়োজন করা হয়, তাহলে কোনো সংসদীয় আসনে একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের মনোনীত প্রার্থী কত ভোট পেলেন, তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে সেই দল দেশের মোট ভোটারের কত শতাংশ সমর্থন পেয়েছে। আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে, ইসরায়েল, সুইডেন, নরওয়ে, বেলজিয়াম, ডেনমার্কসহ বিশ্বের কিছু দেশে প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করা হয়। তবে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ যেসব দেশকে আদর্শ হিসেবে বিবেচনা করেন, যেমন গ্রেট ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড—এমনকি আমাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতেও জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় না।

সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক পদ্ধতির একটি বড় সুবিধা হলো বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি ছোট ছোট রাজনৈতিক দলও অনেক সময় সংসদে তাদের প্রতিনিধিকে পাঠাতে পারে। ফলে দেশের সাধারণ মানুষের দাবিদাওয়া আদায়ে তাঁরাও অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। সরাসরি সরকারের অংশ না হয়েও সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে তাঁরা আইনসভায় আলোচনা বা সমালোচনা করতে পারেন। এ পদ্ধতিতে নির্বাচনের আয়োজন করা হলে একদিকে যেমনিভাবে দেশের প্রত্যেকটি ভোটারের ভোট কার্যকর হয়, ঠিক একইভাবে সংসদে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশে যদি পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের আয়োজন করা হয়, অপেক্ষাকৃত ছোট রাজনৈতিক দলগুলোও সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্ব পাঠাতে পারবে। জাতীয় নির্বাচনে কোনো দলের পক্ষে শতকরা ১ ভাগ ভোট এলেও ওই দল সংসদে ৩ জন প্রার্থীকে মনোনয়ন দিতে পারবে। শতকরা ৪ ভাগ ভোট পেলে ওই দল থেকে ১২ জন সংসদ সদস্য জাতীয় সংসদে ওই দলের হয়ে কাজ করতে পারবেন। তবে সামগ্রিক দিক পর্যালোচনায় আমার দৃষ্টিতে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে পিআর পদ্ধতি এখনো কার্যকর নয়।

পশ্চিমের দেশগুলোর মতো আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ এখনো নিজেদের অধিকার আদায়ে সচেতন নন। বিচার বিভাগ থেকে শুরু করে সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনসহ সব ইনস্টিটিউশন পশ্চিমের দেশগুলোতে সরকারের হস্তক্ষেপ ছাড়া স্বাধীনভাবে নিজস্ব গতিতে কাজ করতে পারে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তেমনটি অনেক সময় আমরা আশা করতে পারি না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে সেভাবে গণতন্ত্রের চর্চা করে না। এ ছাড়া বাংলাদেশে নির্বাচনের ক্ষেত্রে দলীয় প্রতীকের পাশপাশি অনেক সময় প্রার্থীর নিজস্ব ইমেজও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেমন ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফরিদপুর-৩ আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন সাবেক মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের প্রার্থী ছিলেন তৎকালীন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ। বিএনপির নেতা চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ দল থেকে মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করেন। খন্দকার মোশাররফ হোসেন ১,২২,০৪৭টি ভোট পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ পেয়েছিলেন ৭৬,৪৭৮ ভোট। আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ ৩০,৮২১ ভোট পেয়েছিলেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে চারদলীয় জোটের প্রার্থী আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ স্বতন্ত্র চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফের তুলনায় অনেক কম ভোট পান। এমন অনেক উদাহরণ আছে।

এ ছাড়া বড় দলগুলোর ভিড়ে ছোট দলগুলো অনেক সময় সেভাবে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে না। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পর জনসমর্থনের দিক থেকে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় পার্টি সবচেয়ে বড় দুটি রাজনৈতিক দল। গত ১৫ বছর শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ও কার্যক্রম নিয়ে বর্তমান সময়ে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনা হচ্ছে। জাতীয় পার্টি, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি—এসব রাজনৈতিক দলও ১৫ বছর চৌদ্দ দলীয় ঐক্যজোটের অধীন থেকে দীর্ঘ সময় ধরে নির্বাচন করেছে এবং সংসদে এমনকি মন্ত্রিসভায়ও তাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল। অথচ এসব দলের কোনোও রাজনৈতিক নেতাকে আমরা ওই সময় শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগের কোনো বিষয় নিয়ে আমরা সমালোচনা করতে দেখিনি। তাঁরা বলতে গেলে নীরব ভূমিকায় থেকে সরকারের সব নীতিবহির্ভূত কর্মকাণ্ডকে সমর্থন দিয়েছেন। বাংলাদেশের অতীত ইতিহাসকে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, ছোট দলগুলোও ক্ষমতার স্বাদ পাওয়ার আশায় বড় দলগুলোর সঙ্গে একীভূত হয়ে তাদের সুরে কথা বলতে শুরু করে।

বাংলাদেশে যাঁরা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন, তাঁদের আইন প্রণয়নের পাশাপাশি অনেক সময় নিজ নিজ এলাকার উন্নয়ন ও জনকল্যাণমূলক কাজেরও দেখভাল করতে হয়। তাই বাংলাদেশে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন আয়োজনের জন্য সবার প্রথমে প্রয়োজন সংসদ সদস্যের সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনা। নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা শুধু আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে কাজ করবেন আর এলাকার উন্নয়ন ও জনকল্যাণমূলক কাজের দায়িত্ব থাকবে স্থানীয় সরকারের হাতে।

সুইডেনের জাতীয় নির্বাচনে কোনো ব্যক্তি যদি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেন এবং সংসদ সদস্য হতে চান, তাহলে তাঁর অবশ্যই মোট ভোটের অন্তত ৪ শতাংশ পেতে হবে। বিকল্পভাবে, কোনো নির্দিষ্ট নির্বাচনী এলাকা থেকে ১২ শতাংশ ভোট পেলেও তিনি সংসদে প্রতিনিধিত্বের সুযোগ পাবেন। পিআর পদ্ধতিতে যদি আমাদের দেশে নির্বাচনের আয়োজন করা হয়, তাহলে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ক্ষেত্রে কী ধরনের নীতিমালা অনুসরণ করা হবে, সেটা এখনো সুস্পষ্ট নয়। এ ছাড়া নির্বাচন শেষে কোন নির্বাচনী এলাকা কোন সংসদ সদস্যের অধীন যাবে এবং আসনবণ্টনের প্রক্রিয়া কীভাবে সম্পন্ন হবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। প্রতিটি রাজনৈতিক দলই গুরুত্বপূর্ণ আসনগুলোতে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাইবে, যা কার্যকরভাবে বিশৃঙ্খলার জন্ম দিতে পারে।

পিআর পদ্ধতি যে কারণে সমালোচিত, সেটি হচ্ছে কোনো রাজনৈতিক দল যদি সংসদে এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে সমর্থ না হয়, তখন তাদের অন্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জোট গঠনের মাধ্যমে সরকার গঠনের পথে অগ্রসর হতে হয়। বড় দলগুলো না চাইলেও পরিস্থিতি বিবেচনায় বিভিন্ন সময় ছোট দলগুলোর অনেক দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। জোটের শরিক দলগুলো ক্ষমতাসীন বৃহৎ রাজনৈতিক দল থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করলে সরকারের স্থায়িত্ব প্রশ্নের মুখে পড়ে। জোটের শরিক দলগুলো কোনো একটি বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারলে সরকারের কার্যক্রম স্তিমিত হয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, জার্মানির কথা বলতে পারি। জার্মানির ২১তম সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল আগামী বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর। ৬ নভেম্বর জোটভুক্ত তিন শরিক দলের সভার পর চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ জোটভুক্ত ফ্রি গণতান্ত্রিক দলের সভাপতি ও অর্থমন্ত্রী ক্রিশ্চিয়ান লিন্ডনারকে মন্ত্রীর পদ থেকে বরখাস্ত করেন। ফলে চার বছর পার না হতেই জার্মানির ক্ষমতাসীন জোটে তিক্ততা দেখা দেয়। এ কারণে গত সপ্তাহে ভেঙে যায় জোট সরকার। এমন প্রেক্ষাপটে আগামী বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি জার্মান পার্লামেন্টের নির্বাচনের নতুন তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। জার্মানিতেও পিআর পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ইসরায়েলে বর্তমানে পিআর পদ্ধতি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে।

শেষে বলা যায়, সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক পদ্ধতির সুফল যে রকম রয়েছে, ঠিক তেমনি এ পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্নের অবকাশও রয়েছে। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমার দৃষ্টিতে এ নির্বাচনী ব্যবস্থা এখনো উপযোগী নয়। এত দিন পর্যন্ত যে পদ্ধতিতে আমাদের দেশে নির্বাচনের আয়োজন করা হয়েছে অর্থাৎ ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ পদ্ধতি, আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সে পদ্ধতি এখনো সবচেয়ে বেশি উপযোগী। তবে নির্বাচনকেন্দ্রিক বিভিন্ন সংস্কারের ক্ষেত্রে আমাদের দেশের সব শ্রেণির মানুষকে ঐকমত্যে আসতে হবে। সংসদীয় আসনগুলো পুনর্বিন্যাসের লক্ষ্যেও সরকারকে কাজ করতে হবে। সংসদে নারীদের জন্য ৫০টি সংরক্ষিত আসন রয়েছে। তবে আমি মনে করি নারীদের অন্য প্রার্থীদের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিজয়ী হয়ে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ অর্জন করা উচত। এ ৫০টি আসন দেশের প্রান্তিক শ্রেণির জনগোষ্ঠীর জন্য নির্ধারিত রাখা যেতে পারে। এ ছাড়া প্রবাসী, তৃতীয় লিঙ্গ, প্রতিবন্ধী, বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, সংখ্যালঘু ও অবহেলিত জনগোষ্ঠীর মানুষের জন্য এই ৫০টি সংরক্ষিত আসন বরাদ্দ করা যেতে পারে।

* লেখক: রাকিব হাসান রাফি, শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া