বিনয় আর ভালোবাসার দেশ দক্ষিণ কোরিয়ায় যা দেখলাম
সিলেসিমান, কোরিয়ার সর্বোচ্চ সম্মানিত সম্বোধন। কেউ যদি একজন এই সিলেসিমান শব্দটা ব্যবহার করে কথা বলেন, তাহলে তাঁরা খুশিতে গদগদ করে আপনার সঙ্গে বিনয়ের সঙ্গে বলবে।
হ্যাঁ, আমি আপনাদের সেই দেশেরই কিছু অভিজ্ঞতার কথা শোনাব। দক্ষিণ কোরিয়া আজ থেকে ৫০ বছর আগেও খুবই গরিব আর দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ ছিল; কিন্তু কঠোর পরিশ্রম আর অধ্যবসায়ের কারণি আজ তারা বিশ্বের সেরা ৫টি শিল্পোন্নত দেশের একটিতে পরিণত হয়েছে।
কোরিয়ানরা দিনে টানা ১৬ ঘণ্টা পরিশ্রম করে তাঁদের দেশকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন; কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো, তাঁদের জন্মহার সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। কাজের প্রতি মনোযোগ, কঠোর পরিশ্রম আর দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁরা পরিবারে বেশি সময় দিতে পারেন না। শিল্পের পাশাপাশি জ্ঞান–বিজ্ঞানে বিশ্বের অন্যতম সেরা দেশে পরিণত হয়েছে।
শরতের সুন্দর এক সকালে আমি হংকং থেকে রওনা দিয়ে কোরিয়ায় ইনচন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছাই আমার ভ্রমণজীবনের দ্বিতীয়বার। হংকংয়ে অনেক দিন চাকরি করার পর কোরিয়া যাই। হংকং তো খুব ছোট একটি নগর। তাই আমার ধারণা ছিল, কোরিয়া হয়তো হকংয়ের মতোই। কিন্তু বাস্তবে অনেক বড় দেশ দক্ষিণ কোরিয়া।
বিমানবন্দরে নেমে আমার এক বন্ধুর ঠিকানায় যাওয়ার জন্য ইনচন মেট্রোস্টেশনে যাই। কিছু লোককে আমার বন্ধুর ঠিকানা দেখিয়ে সাহায্য চাই। কিন্তু সবাই ব্যস্ত আর ইংরেজি না জানার কারণে অনেকেই আমাকে এড়িয়ে গেলেন। হঠাৎ এক লোক এসে আমাকে ইংরেজিতে জিজ্ঞাসা করলেন, আমার কী সাহায্য দরকার। আমি সব বুঝিয়ে বললাম। খুব ভালো ইংরেজি জানা লোক অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় লেখাপড়া করেছেন। তিনি বললেন, ‘তোমার কোনো চিন্তা নেই, আমাকে ফলো করো। আমি তোমার গন্তব্যে পৌঁছিয়ে দেব। যেই কথা সেই কাজ। উনি আমাকে মেট্রোস্টেশনে নিয়ে গেলেন। নিজের পয়সা দিয়ে টিকিট কেটে ইনচন থেকে আমার বন্ধুর কর্মস্থল প্রায় ষাট কিলোমিটার দূরে নিয়ে গেলেন। এ দীর্ঘ রাস্তায় দুইবার ট্রেন বদল করে প্রায় দুই ঘণ্টায় আমাকে নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে গেলেন। একটি মোটেলে থাকার ব্যবস্থাও করে দেন তিনি। পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা। ভিনদেশে এসেছি। কেমন খাবার খাব, তা ভেবে উনাকে বললাম, চিকেনকারি আমার পছন্দ। একটি কোরিয়ান রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেলেন (তাক তুরি তাক) মোরগের তরকারির মতো রান্না করা তরকারি দিয়ে রাতের খাবার সারলাম। ততক্ষণ আমার সঙ্গেই ছিলেন তিনি। শেষে আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যাওয়ার সময় আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনি যে আমাকে এত বড় উপকার করলেন, নিজের পকেটের টাকা খরচ করলেন, আমি আপনার টাকা ফিরিয়ে দিতে চাই।’ উনি বললেন, ‘এমন কাজ করো না। মানুষকে সাহায্য করা আমার দায়িত্ব।’ শ্রদ্ধায় কৃতজ্ঞতায় আমার মাথা নিচু হয়ে গেল। অনেক দিন দক্ষিণ কোরিয়ায় ছিলাম, কিন্তু এমন পরোপকারী মানুষটাকে আর দেখিনি।
আমি যে শহরে প্রথমে উঠেছিলাম, সেই শহরের নাম ছিল পিয়ানটেক। রাস্তায় বের হলেই অনেক কোরিয়ান গাড়ি থামিয়ে জিজ্ঞাসা করতেন,‘ তোমার কোনো বন্ধু আছে? কাজ করবে?’ এত বড় শিল্পোন্নত দেশে কাজের লোকের খুবই অভাব, জনসংখ্যা মাত্র ৫ কোটি। একদিন আমি রাস্তায় হাঁটছি, হঠাৎ একজন গাড়ি থামিয়ে একটা প্যাকেট আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এটা তুমি খেয়ো।’ আমি খুলে দেখি, প্যাকেটের ভেতর আইসক্রিম, ফল, বিস্কুট আর কোমল পানীয়।
শীতের সময় প্রচুর বরফ পড়ে কোরিয়াতে, কখনো মাইনাস ১০-১৫তে নেমে আসে তাপমাত্রা। বরফ আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য শুধু মানুষের মনের খোরাকই জোগায় না, অর্থনৈতিকভাবেও একটি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যায় বহুদূর, তার বাস্তব প্রমাণ দক্ষিণ কোরিয়া। শীতপ্রধান দেশ হওয়ায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে পুঁজি করে দাঁড় করিয়েছে শক্তিশালী পর্যটনশিল্প। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণ নয়, কোরিয়ায় পর্যটনের মূল আকর্ষণ নিজ দেশের সংস্কৃতি। তুষারপাতের নান্দনিক সৌন্দর্যের কারণে প্রতিবছরই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটক আসেন দক্ষিণ কোরিয়াতে। এই শীতে বরফপ্রেমীরা বরফে স্নোবোর্ড-স্কি খেলার প্রস্তুতি নিয়ে থাকেন। কোরিয়ার ভূমির প্রায় ৮০ শতাংশই পাহাড়ে আচ্ছাদিত, প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যবর্তী দেশটি সাগর আর পাহাড়ের অপরূপ মিলনমেলায় নৈসর্গিক দৃশ্যপট এঁকে থাকে বছরজুড়েই। শীতে প্রকৃতির এ রূপ–সৌন্দর্যকে বরফপ্রেমীরা দারুণভাবে উপভোগ করে থাকেন। শুধু কোরিয়ান নাগরিকেরা নন, বিশ্বের লাখো পর্যটক এ সময় উপভোগ করেন তুষারপাতের নয়নাভিরাম দৃশ্য।
কোরিয়ায় পর্যটকদের আকর্ষণের জন্য নির্মাণ করা হয় স্পেশাল বরফের হোটেল। বেশ কিছু পর্যটক স্পটে এসব হোটেল তৈরি করা হয়। বিশ্বজুড়ে বরফের বেশ কয়েকটি হোটেল রয়েছে। এর মধ্যে বেশ কিছু পর্যটন স্পটে এসব হোটেল তৈরি করা হয়। এ ছাড়া ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে বরফ ও তুষারের হোটেল রয়েছে।
শীতের সময় কোরিয়ায় বিভিন্ন অঞ্চলে বরফ ফেস্টিভ্যাল শুরু হয়। এ ছাড়া কোরিয়ায় সর্বত্র চলে স্নোবোটিং ও স্কি খেলার জমজমাট আসর, বরফের মধ্যে কোরিয়ানরা খেলাটি দারুণ উভোগ করে থাকেন, অনেক বিদেশিও স্নোবোটিং ও স্কি খেলা দেখতে দক্ষিণ কোরিয়ার বিভিন্ন স্পটে শামিল হন।
*লেখক: শাহ হারুন রশিদ, আনসান শহর, দক্ষিণ কোরিয়া