নীল শবপত্র
সন্ধ্যার বাতাসটা ভারী মনে হলো নীহারিকার। ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে কিছুক্ষণ দরজায় দাঁড়িয়ে ভেতরে ঢোকার সাহস খুঁজে নিল। সারা দিনের স্কুলের ক্লাস শেষে এই ঘরটায় ফেরার কথা ভাবলেই দম বন্ধ হয়ে আসে—শূন্য, নিস্তব্ধ ঘর। ঘরের কোণে কাপড়ের স্তূপ, টেবিলের ওপর আধখাওয়া বিস্কুট, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বইগুলো নীহারিকার দিকে কেমন একটা দৃষ্টি দিচ্ছে। যেন জিজ্ঞাসা করছে—‘তুমি এখানে এখনো আছো! চলে যাচ্ছো না কেন কোথাও?’ নীহারিকার এখন কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। অবশ্য শেষের বাক্যটা সঠিক নয়। সে চাইলেই একা কোথাও গিয়ে থাকতেই পারে, কিন্তু তার সেই সাহসটা হচ্ছে না।
নীহারিকা তিন ভাই-বোনের মধ্যে বড়। বাবা মারা যাওয়ার পর সংসারের সব দায়িত্ব তার ওপর এসে পড়ে। মা, ছোট বোন নীলা, ছোট ভাই নয়ন—সবাই তার ওপর নির্ভরশীল হয়ে যায়। তখন তার কতই–বা বয়স ছিল! তার একটা স্বপ্ন ছিল আকাশ ছোঁয়ার কিন্তু আকাশ ছোঁয়ার জন্য যতটা পড়াশোনা দরকার ছিল, ততটা আর করা হয়ে ওঠেনি নীহারিকার। সংসারের হাল ধরার জন্য পড়াশোনার পাঠ দ্রুত শেষ করে একটা চাকরি জোগাড় করাই ছিল বাবার মৃত্যুর পর নীহারিকার প্রথম ও একমাত্র কাজ। ভালো একাডেমিক ফলাফল থাকায় সহজে একটা উচ্চবিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পেশায় ঢুকে যায় সে। নিজের স্বপ্নকে বিসর্জন দিয়ে নীহারিকা সংসারের জন্য ছুটেছে, টাকা জমিয়েছে, বোনকে বিয়ে দিয়েছে, ভাইকে পড়াশোনা করিয়েছে। মাথার ওপর একটা ছাদ দরকার ছিল—সেটার জন্য একটু একটু করে টাকা জমিয়ে মায়ের নামে একটা ছোট্ট বাড়িও করে দিয়েছিল। আর তার জন্য! না, সে নিজের জন্য কিছুই চায়নি।
নীহারিকা তার এক এতিম সহকর্মীকে বিয়ে করেছিল ভালোবেসেই কিন্তু সংসারটা টেকেনি। স্বামী সৌরভ খুব ভালোবেসেছিল নীহারিকাকে। বাচ্চা অনেক পছন্দ ছিল তাদের দুজনেরই। তাই বিয়ের পরপরই অর্ণব আসে তাদের ভালোবাসার সংসারে। প্রথম দিকে বেশ ভালোই যাচ্ছিল নীহারিকা আর সৌরভের সংসার। কিন্তু মা-ভাইবোনদের জন্য বাড়িটা করতে গিয়ে শেষের দিকে সব জমানো টাকা শেষ হয়ে গেলেও বাড়ির কাজ শেষ হচ্ছিল না দেখে ছোট্ট অর্ণবকে মায়ের কাছে বাসায় রেখেই আবার চাকরিতে জয়েন করল নীহারিকা। স্কুলের ক্লাস শেষ করেই ছুটত কোচিং সেন্টারে ক্লাস নিতে, তারপর সন্ধ্যায় দুটি টিউশনি করিয়ে রাত ৯টা বেজে যেত বাসায় আসতে আসতে। এত কিছুর ভিড়ে তার আর সৌরভের ভালোবাসাটা ধীরে ধীরে কেমন যেন নিষ্প্রাণ হয়ে গিয়েছিল। সৌরভ অভিযোগ করত, ‘নীহারিকা শুধুই তার মা-ভাইবোনদের নিয়ে ভাবে, স্বামী-সন্তানের প্রতি সে উদাসীন। দুদণ্ড বসে গল্প করার ফুরসত মেলে না নীহারিকার।’ নীহারিকা হয়তো বুঝতে পারত, কিন্তু সময় কই! দায়িত্বের ভার কাঁধে চেপে বসেছিল নিঃশব্দে। তাই সৌরভের সঙ্গে দূরত্ব ধীরে ধীরে গভীর হলো। ভালোবাসা থেকে তিক্ততায় পৌঁছাতে খুব বেশি সময় লাগেনি।
গতকাল নয়নের ৩ মাস বয়সী মেয়ে স্নেহা মারা গিয়েছে। বাচ্চাটাকে সকালে তার খাটে নিথর অবস্থায় পাওয়া যায়। সবাই সন্দেহ করল নীহারিকাকে। কেননা তাকে মাঝেমধ্যেই দেখা যেত স্নেহার রুমে যেতে।
বিচ্ছেদ হয়ে গেল, নীহারিকা একা চলে এলো মায়ের বাসার দক্ষিণের এক কোণার ঘরে আর ছেলে অর্ণব থেকে গেল বাবার কাছে। এখন আর সে প্রাইভেট টিউশনি করে না। শুধু স্কুলের চাকরিটা আর কোচিং সেন্টারে পড়িয়েই তার চলে যাচ্ছে দিন। মা-ভাই যাতে তাকে বোঝা না মনে করে তার জন্য মাস শেষে মায়ের হাতে কিছু টাকা তুলে দেয় সংসার চালানোর জন্য। এতে ভাইয়ের ও একটু সাহায্য হয়। মা, ছোট ভাই একসঙ্গেই থাকে। ভাই নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত, ভাইয়ের ৩ মাস বয়সী মেয়ে স্নেহাকে নিয়ে ভাইয়ের স্ত্রী নাইমাও ব্যস্ত। ছোট বোন নীলা পাশেই অন্য আরেকটা বিল্ডিংয়ে ভাড়া থাকে। নীলাও বেশ ভালো আছে তার স্বামী-সন্তান নিয়ে। সবার এই সুখের জীবনে নীহারিকার যেন কোনো জায়গা নেই। তার ভাইবোনদের স্বপ্ন ছিল—সে পূরণ করেছে। নিজের জন্য কিছু চায়নি। কিন্তু এখন সবাই তাকে অপছন্দ করে। মা যেন তাকে দেখে বিরক্ত হয়ে যায়। ভাই যেন মুখের ওপর কটুকথা না বলে থাকতে পারে না। এই বাড়িও এখন আর তার নয়। নীহারিকা ভাবতে পারে না, এত বছর ধরে সে কী করল! কিসের জন্য করল! এখন যখন সবাই সুখী, তখন কি তার জন্য একটু ভালোবাসা নেই!
মাঝেমধ্যে নীহারিকা যায় তার ছেলের সঙ্গে দেখা করতে। কখনো পার্কে, কখনো শপিং মল কিংবা রেস্টুরেন্টে। ৯ বছরের বাচ্চাটার দিকে তাকালেই কখনো কখনো ভীষণ ভালোবাসায় বুক ভরে যায়। আবার কখনো মাথার ভেতর এক ভয়ানক ইচ্ছা জন্ম নেয়। ওর ইচ্ছা করে অর্ণবের গলাটা জোরে চেপে ধরে রেখে শ্বাস বন্ধ করে রাখতে, যতক্ষণ না সে নিস্তেজ হয়ে যায়। শ্বাস বন্ধ করে দেওয়ার অনুভূতিটা তাকে অদ্ভুত এক স্বস্তি দেয়। শৈশবে নয়ন যখন দুষ্টুমি করত, তখন একদিন সে মজা করে তার নাক–মুখ হাত দিয়ে চেপে ধরে রেখেছিল। নয়নের মুখ লাল হয়ে গিয়েছিল, চোখগুলো গোল গোল হয়ে বের হয়ে আসতে চাচ্ছিল নয়নের। কিন্তু নীহারিকা যেন এক অদ্ভুত আনন্দ পাচ্ছিল। সেই অনুভূতি আবার ফিরে এসেছে। এখন কখনো কখনো নয়নের মেয়ে স্নেহা যখন ঘুমিয়ে থাকে, তখন তার রুমে হেঁটে হেঁটে ঘুমন্ত স্নেহাকে দেখতে থাকে নীহারিকা। তার ইচ্ছা করে, বাচ্চাটার মাথাটা ধরে বিছানায় জোরে ঠুকে দেয়। কিন্তু সে নিজেকে সামলায়। মাঝেমধ্যে নীহারিকার মনে হয়, স্নেহার ছোট গলাটা দুই হাত দিয়ে চেপে ধরলে কেমন লাগবে! কিন্তু পরক্ষণেই সে ভেতর থেকে কেঁপে উঠে। সে কি ভয়ংকর কিছু হয়ে যাচ্ছে! নীহারিকা জানে—এই ভাবনাগুলো অন্যায়, ভয়ানক পাপ।
কখনো কখনো স্কুলের বাতাস ভারী লাগে তার, দম বন্ধ হয়ে আসে। শ্রেণিকক্ষে শিশুরা কথা বলে—হাসে, কিন্তু মাঝেমধ্যে কোনো শিশু হাসলে, নীহারিকার মনে এই অদ্ভুত ভয়ংকর ভাবনা উঁকি দেয়—যদি ওদের নিশ্বাস বন্ধ করে দিই? যদি চিরতরে চুপ করিয়ে দিই? যদিও সে দ্রুত মাথা ঝাঁকিয়ে ভাবনাটা সরিয়ে দেয় প্রতিবারই। সে খারাপ মানুষ নয়। সে একজন শিক্ষিকা, একজন মা, একজন বোন। তাহলে এই অনুভূতিগুলো আসে কেন? তাই তো সে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখায়। চিকিৎসক বলেছে , ওর মধ্যে অজানা ক্ষোভ আছে। কিন্তু ক্ষোভ কার ওপর? স্বামী! মা! ভাই! বোন! নাকি অন্য কারও ওপর! এই সমস্যা ইমপালস কন্ট্রোল ডিজঅর্ডারের মধ্যে পড়ে। সে যখনই কারও শ্বাস বন্ধ করতে চায়, তার মস্তিষ্কে ডোপামিন নিঃসরণ হয়, যা তাকে স্বস্তি দেয়। এই ধরনের মানসিক সমস্যা সাইকোথেরাপি ও মেডিকেশনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আর এসব জানলে অন্যরা যদি তাকে ভয় পাওয়া শুরু করে সেই ভয়ে নীহারিকা থেরাপি নেওয়ার পাশাপাশি ওষুধ চালিয়ে যাচ্ছে সবার অগোচরে।
গতকাল নয়নের ৩ মাস বয়সী মেয়ে স্নেহা মারা গেছে। বাচ্চাটাকে সকালে তার খাটে নিথর অবস্থায় পাওয়া যায়। সবাই সন্দেহ করল নীহারিকাকে। কেননা তাকে মাঝেমধ্যেই দেখা যেত স্নেহার রুমে যেতে।
নীহারিকার মা কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘তুই এটা কি করেছিস, নীহা?’
নাইমার শোকে পাথর হয়ে যাওয়া বিবর্ণ চেহারা আর ছোট ভাইয়ের কান্না—সব মিলিয়ে, নীহারিকা বুঝল, তার অস্তিত্বই এখন সবার কাছে একটা অভিশাপ। কিন্তু সে চুপ করে সব সহ্য করল।
পুলিশ এলে নীহারিকার দিকেই সবাই আঙুল তুলে। পরিদর্শক খন্দকার আসাদ নীহারিকার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন—
‘আপনার ওপর সবাই সন্দেহ করছে, জানেন?’
নীহারিকা নির্বিকার মুখে তাকিয়ে থাকে। খন্দকার আসাদ আবার বললেন—‘শুনুন, এটা একটা অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু। আপাতত যা বোঝা যাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে, বাচ্চাটার শ্বাসরোধ করা হয়েছে।’
এসব শুনে নীহারিকার গলা শুকিয়ে আসে।
‘আপনার কী কোনো শত্রু আছে?’—আসাদের করা এই প্রশ্নে নীহারিকা একটা ফ্যাকাসে হাসি হেসে উত্তর দিল— ‘আমি নিজেই তো সবার শত্রু।’
আসাদ চোখ সরু করলেন। তার অভিজ্ঞতা বলে, কেউ দোষী হলে কি এতটা নির্লিপ্ত থাকে থাকতে পারে!
আসাদ তদন্ত চালাতে থাকে।
নীহারিকার প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে। মা, ছোট ভাই, ভাইয়ের স্ত্রী, বোন নীলা এমনকি নীলার স্বামীর সঙ্গে ও কথা বলে।
মোটামোটি সবাই বলে, ‘নীহারিকা বাচ্চাদের পছন্দ করত।’
অন্যদিকে আসাদের মনে হচ্ছিল, কিছু একটা ঠিক নেই। এটা স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, এটা খুন—এই ব্যাপারে সে নিশ্চিত ছিল। কিন্তু কে করল? নীহারিকা? নয়ন? নাইমা? অন্য কেউ? সে তদন্ত শুরু করল স্নেহার মরদেহের ফরেনসিক রিপোর্ট দিয়ে।
একদিন হঠাৎ করেই পরিদর্শক আসাদ নীহারিকার রুমে যায় কিছু প্রশ্নের উত্তর জানতে চাওয়ার জন্য। তখন সে নীহারিকার হাতের ভাঁজে লুকানো একটি ওষুধ দেখে ফেলে। ব্যাপারটায় আসাদের মনে খটকা লাগে। যখন নীহারিকাকে আরও কঠোরভাবে জিজ্ঞাসা করে, তখন আসাদ জানতে পারে নীহারিকা সাইকিয়াট্রিস্ট দেখায়। এরপর আসাদ নীহারিকার ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারে যে নীহারিকা ইমপালস কন্ট্রোল ডিজঅর্ডারের রোগী। সে বাচ্চাদের পছন্দ করলেও মাঝেমধ্যে অবচেতন মনে সে তাদেরই শ্বাস বন্ধ করে মেরে ফেলতে চায়। শুধু বাচ্চা নয়, যেকোনো মানুষকেই এমনভাবে দম বন্ধ করে তাদের কষ্ট দেখতে তার ভালো লাগে, যদিও পরবর্তী সময়ে অনুশোচনা অনুভব করে।
আরেকটা খটকা লাগে নয়নকে নিয়ে...সে কেমন যেন অস্থির।
যখন তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করা হয়, সে স্পষ্টভাবে চোখের দিকে তাকাতে পারে না।
‘নয়ন সাহেব, আপনার কি মনে হয়, আপনার স্ত্রী বাচ্চাটাকে খুন করেছে?’
নয়ন আঁতকে উঠে বলল, ‘না! নাইমা কখনো এটা করতে পারে না!’
‘তাহলে কি আপনি মনে করেন, নীহারিকা করেছে?’
নয়ন কথা বলতে গিয়েও থেমে গেল।
‘আমি জানি না...’
‘আচ্ছা আপনি নিজেই মেরে ফেলেননি তো?’ প্রশ্নটা করেই নয়নের দিকে তাকিয়ে আসাদ লক্ষ করল, নয়নের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।
স্নেহার মৃত্যুর পর পুরো পরিবারটা শোকে ভেঙে পড়েছিল। নাইমা একদিকে শোকাহত, অন্যদিকে ক্ষিপ্ত। তার মধ্যে বিরাট এক অস্থিরতা জন্ম নিয়েছিল। স্নেহা তার জীবন ছিল, অথচ স্নেহা তার কাছ থেকে দূরে চলে গেছে। স্নেহার মৃত্যুর পর, তার হৃদয়ে রাগ, কষ্ট আর অগণিত দুঃখ জমে ছিল। প্রথম কয়েক দিন সে কিছুটা বিহ্বল ছিল, কোনো কিছুই স্পষ্ট মনে করতে পারছিল না। অনেক রাত পর্যন্ত ঘুমুতে পারেনি, মনে হচ্ছিল যেন অন্ধকারের শূন্যতা তার চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার মানসিক অবস্থা অনেকটা জটিল হয়ে উঠেছিল। মাঝেমধ্যে গভীর রাতে একাকী বসে, তার জীবনে কী কী ভুল হয়েছিল, সেসব সে ভাবত। আচ্ছা, তার আদরের মেয়েটাকে কি আসলেই আপা মেরে ফেলেছে! নাকি নয়ন কিছু একটা আঁচ করেছে? কিন্তু এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর তার কাছে ছিল না। একসময়, সে নিজেকে এমন এক জায়গায় দেখত, যেখানে রয়েছে সবকিছু হারানোর পরও কিছু একটা অবিশ্বাস্য শান্তি —যে শান্তি ছিল তার নিজেরই সৃষ্টি, কিন্তু সেটা ছিল একেবারেই নিঃসঙ্গ, নিঃসঙ্গতার মধ্যে ডুবে থাকা শান্তি। মনে হতো তার বুকের ওপর থেকে একটা ভারী পাথর সরে গেছে স্নেহা মারা যাওয়ায়। কিন্তু মাঝেমধ্যে তার ভেতরে থাকা ক্ষোভের আগুন আবার জ্বলে উঠত, স্নেহা আর নেই এবং তার অনুপস্থিতি কখনো পূর্ণ হবে না!
এত যন্ত্রণার মধ্যে নীহারিকা যেন ভেতর থেকে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছিল। এত কিছু ঘটে চলেছে তার জীবনে, কিন্তু সে সৌরভকে কিছুই জানায়নি। নিজের কষ্টগুলো চেপে রেখেছিল নিঃশব্দে। একদিন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি নীহারিকা। স্কুল ছুটির পর সে ঠিক পাগলের মতো ছুটে গিয়েছিল অর্ণবের সঙ্গে দেখা করতে। তখন সৌরভ বাসায় ছিল। নিঃসঙ্গ, বিধ্বস্ত নীহারিকা খুব করে চেয়েছিল, সৌরভকে একটু জড়িয়ে ধরে তার বুকের ভেতরের সব কষ্টের কথা ঝেড়ে ফেলতে। কিন্তু সৌরভ ছিল নির্লিপ্ত, নির্বিকার। তার এই নিস্পৃহতা নীহারিকার ভেতরের সবটুকু আশা ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিল সেদিন। সৌরভ শুধু বলেছিল— ‘নীলা আমাকে ফোন দিয়ে অনেক কথা বলেছে। দেখলে তো কাদের জন্য নিজের সর্বস্ব শেষ করে দিয়েছিলে ! আশা করি জলদি সব ঠিক হয়ে যাবে। আর এসব ঘটনা যত দিন চলছে, তত দিন তুমি অর্ণবের সঙ্গে দেখা করতে এসো না। ও তোমার আচরণে ভয় পেয়ে যাবে। সব শেষ হোক, তখন আমিই অর্ণবকে নিয়ে যাব তোমার সঙ্গে দেখা করাতে। তোমাকে ভালোবেসেছিলাম কিন্তু তোমাকে হারিয়ে ফেলেছি। এখন অর্ণবই আমার সব, ওকে হারাতে পারব না।’ নীহারিকার টুকরা টুকরা হয়ে যাওয়া হৃদয়টা সেদিন এতটাই ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল যে বাসায় ফিরে একবার ভাবতেই বসেছিল—নিজেকেই শেষ করে দেবে। কিন্তু সেইটুকু সাহসও তার হয়ে ওঠেনি। যাত্রা তো শুরুই হয়েছিল নিজের অস্তিত্ব বাঁচানোর জন্য, তাই আর এই আত্মহননের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তার নেওয়া হয়ে ওঠেনি…
অন্যদিকে আসাদের মনে হচ্ছিল, কিছু একটা ঠিক নেই। এটা স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, এটা খুন—এই ব্যাপারে সে নিশ্চিত ছিল। কিন্তু কে করল? নীহারিকা? নয়ন? নাইমা? অন্য কেউ? সে তদন্ত শুরু করল স্নেহার মরদেহের ফরেনসিক রিপোর্ট দিয়ে।
অটোপসি রিপোর্ট আসতেই আসাদ দেখল রিপোর্ট অনুযায়ী স্নেহার শরীরে কোনো বাহ্যিক আঘাত ছিল না, কিন্তু তার ফুসফুসে অক্সিজেনের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম ছিল। এটা বোঝা যাচ্ছে, সে শ্বাসরোধে মারা গেছে। কিন্তু গলায় কিংবা মুখে খুনির হাতের কোনো চিহ্ন নেই কেন? আসাদ রিপোর্টে আরও গভীরভাবে তাকাল। একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সেখানে ছিল— স্নেহার মুখের চারপাশে মৃদু নীলচে ছাপ। যেটা দেখলে বোঝা যায়, খুব হিসাব করে, খুব পরিকল্পিতভাবে তার মুখ চেপে ধরা হয়েছিল, অথবা মুখের ওপর বালিশ—কিংবা কাপড় রেখে দিয়েছিল। যদি কেউ রাগের বসে গলা টিপে হত্যা করত, তাহলে আঙুলের দাগ থাকত। কিন্তু এখানে তেমন নেই। মানে—খুনি পরিকল্পিতভাবে খুন করেছে। এটা কোনো দুর্ঘটনা না কিংবা মাঝেমধ্যে অবচেতন মনের ক্রোধ থেকে উদ্ভূত কোনো ইচ্ছা নয়।
আসাদ প্রথমে নীহারিকার কথা ভাবল। সে কি পারবে, একটা শিশুকে এমনভাবে নিশ্বাস বন্ধ করে মারতে? এমনভাবে, যাতে বোঝাই না যায়? সে নীহারিকার সাইকিয়াট্রিস্টের সঙ্গে আবার কথা বলল। কিন্তু সাইকিয়াট্রিস্ট পরিষ্কার বলল- ‘নীহারিকা মাঝেমধ্যে অদ্ভুত চিন্তা করে, এটা ঠিক। কিন্তু ওর সেই চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতাও আছে।’ তার মানে দাঁড়াচ্ছে যে ওর মধ্যে হিংস্রতা আছে, কিন্তু ওর পরিকল্পিত খুনি হওয়ার সম্ভাবনা কম।
আসাদ নীহারিকার বোন নীলার সঙ্গেও আবার কথা বলল। নীলা বলল, ‘আপার মানসিক সমস্যা রয়েছে। তার সঙ্গে আমাদের কারোরই ভালো সম্পর্ক নেই কারণ ওর মাথা খারাপ। অর্ণবকে এর জন্যই দুলাভাইয়ের কাছে রেখে দিয়েছে। কিন্তু স্নেহাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে। বাকি আর কিছু আমি জানি না। মাথা খারাপ মানুষ কত কিছুই তো করতে পারে!’ আসাদ এবার নয়নের দিকে তাকাল। নয়ন প্রথম থেকেই অদ্ভুত আচরণ করছিল। কিছু জিজ্ঞাসা করলেই সে চুপ করে থাকে। একদিন নয়নের সঙ্গে তার অফিসে দেখা করতে যায় আসাদ। পেছন থেকে গিয়ে নয়নের কাছে দাঁড়াতেই সে শুনতে পায় নয়ন বিড়বিড় করছিল—‘আমি তো আমার স্নেহাকে কোলে রেখে ঘুম পারিয়েছি, ডায়াপার পরিবর্তন করে দিয়েছি, বুকের ওপর শুইয়ে রেখেছি। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না...কিচ্ছু বিশ্বাস হচ্ছে না। আমার মেয়ে কি সত্যিই আমার ছিল না!’ আসাদ এই এই লাইনটা শুনেই চমকে উঠল। নয়ন কি স্নেহাকে নিজের মেয়ে বলেই মনে করত না? তাহলে কী সে…
আসাদ তখন নয়ন সম্পর্কে খোঁজ নেওয়া শুরু করে। সে জানতে পারে, নয়ন বেশ কিছুদিন ধরে তার বন্ধুদের কাছে বলছিল, ‘স্নেহা হয়তো আমার মেয়ে নয়!’ নয়নের মনে গভীর সন্দেহ বাসা বেঁধেছিল—নাইমা তাকে প্রতারণা করেছে। নয়নের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু আসাদকে একটি এসএমএস দেখায়, যেখানে নয়ন তার সেই বন্ধুকে লিখেছিল, ‘আমি ডিএনএ টেস্ট করিয়েছি, ফলাফল এলেই বুঝতে পারব, নাইমা আমাকে প্রতারণা করেছে কিনা।’ এসএমএসটা দেখে আসাদ প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায়—নয়ন বিশ্বাস করত, স্নেহা তার নিজের সন্তান নয়। নয়নকে নিয়ে আসাদের সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়, যখন নয়নের সেই বন্ধুর সহায়তায় আসাদ ডিএনএ রিপোর্ট সংগ্রহ করে। রিপোর্ট দেখে সে থমকে যায়—নয়নের সন্দেহই সত্যি ছিল। ডিএনএ রিপোর্ট অনুযায়ী, স্নেহার জেনেটিক পিতা নয়ন নন! —তবে কি এই কারণেই নয়ন সেই নিষ্পাপ শিশুটিকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল?
চোখ বন্ধ করলেই আসাদ দেখতে পায়, কীভাবে নয়ন ধীরে ধীরে একটা ভারী বালিশ নিয়ে মেয়েটার মুখের ওপর রেখে দেয়। মাত্র তিন মাসের শিশু স্নেহা—তাই হাত পা ছুঁড়ে বালিশ সরাতে পারার কথা নয়। শুধু ফোঁসফোঁস করছিল ছোট্ট নাকমুখ দিয়ে। আর এই দিকে নয়ন ঠিক ততক্ষণ পর্যন্ত বালিশটা মুখের ওপর ফেলে রাখে, যতক্ষণ না ছোট্ট স্নেহার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়, দেহ নিস্তেজ হয়ে পড়ে। আসাদ বুঝে যায়, নয়নই খুন করেছে— এই ছোট্ট প্রাণটাকে। স্নেহা শুধু এই কারণেই প্রাণ হারাল যে সে নয়নের ‘নিজের’ রক্ত ছিল না।
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
সেদিন সন্ধ্যায় আসাদ নয়নদের বাড়িতে গেল। নীহারিকার সঙ্গে কথা বলতে তার রুমে গিয়ে দেখল, অন্য সময়ের মতোই তার ঘর এলোমেলো। নীহারিকা জানলার ধারে বসে আছে। হাতের কাপে চা, কিন্তু চা ঠান্ডা হয়ে গেছে। তার চোখ দুটো ভেতর থেকে শূন্য হয়ে আছে।
আসাদ ধীরে ধীরে বলল, ‘স্নেহার আসল খুনি কে, সেটা জানতে চান না আপনি?’
নীহারিকা তাকাল না, শুধু ফিসফিস করে বলল, ‘জানতে চেয়ে কী করব …! সবাই বলছে আমিই মেরেছি।’
আসাদ পকেট থেকে একটা কাগজ বের করল। ডিএনএ রিপোর্ট। এতে লেখা ছিল—নয়ন, স্নেহার বাবা ছিল না। নীহারিকা এবার ধীরে ধীরে আসাদের দিকে তাকাল। তার কাঁপা গলায় একটাই প্রশ্ন এল, ‘তাহলে ?’
এতক্ষণে নীহারিকা যেন সব বুঝতে পারল। তার চোখে একমুহূর্তের জন্য বিদ্যুৎ চমকের মতো কিছু একটা খেলে গেল। তারপর নিঃশব্দে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। নীহারিকা যখন পরিদর্শক খন্দকার আসাদের থেকে জানতে পারল যে আসল খুনি তার ভাই নিজেই, তখন তার ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। কারণ, সে স্নেহাকে খুব ভালোবাসত। সারা দিনের ক্লান্তি শেষে বাসায় এসে একমাত্র স্নেহার হাসি দেখলেই তার আরাম লাগত, অন্যরা তো ঠিকমতো কথাও বলত না তার সঙ্গে। নীহারিকার জন্য একমাত্র স্নেহা আর অর্ণবের ভালোবাসাই ছিল নির্ভেজাল আর নিঃস্বার্থ। স্নেহার মৃত্যুর পর থেকে একটা রাতেও নীহারিকা আরাম করে চোখ বন্ধ করতে পারেনি।
নীহারিকা ফিসফিস করে বলল, ‘সে… নিজের সন্তানকে খুন করল ?’
আসাদ শান্ত গলায় বলল, ‘সন্দেহ যখন কুড়ে কুড়ে খায়, তখন মানুষ জানোয়ার হয়ে যায়।’
নীহারিকা এবার উঠে দাঁড়াল। তার চোখে জল ছিল না, বরং একধরনের অদ্ভুত শীতলতা। আসাদ তাকে গভীরভাবে দেখল। তারপর বলল —‘আপনাকে বলার কারণ কি জানেন? আমার মনে হয় আপনি একটু সাবধানে থাকা প্রয়োজন। কারণ, নয়নের এখন যে মানসিক অবস্থা, তাতে সে আরও কিছু অঘটন ঘটালেও ঘটাতে পারে। তাই আপনাকে জানালাম। আর কাল সকালে আমার প্রথম এবং প্রধান কাজ হচ্ছে নয়নের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া।’
তার ঠিক পরদিনই, নয়ন রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়ে যায়।
সকালে বাসা থেকে অফিসের উদ্দেশ্যে বের হয়েছিল, কিন্তু আর ফেরেনি। আসাদ যখন তাকে ধরতে বাসায় আসে, সে ততক্ষণে অফিসের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। আসাদ দ্রুত তার অফিসে যায়, কিন্তু সেখানে নয়নকে পায়নি। আজকে প্রায় তিন দিন হতে চলল, নয়নের কোনো খোঁজই পাচ্ছে না পরিদর্শক আসাদ।
আসাদ তাই আবার নীহারিকারদের বাসায় আসে। তখন নীহারিকা ছিল আরও শান্ত, আরও নীরব। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে খন্দকার আসাদ প্রশ্ন করে —
‘আপনার কী মনে হয়? নয়ন নিজেই আগে থেকে কিছু আঁচ করে—পরিকল্পনা করে পালিয়ে গিয়েছে, নাকি তার সঙ্গে খারাপ কিছু হয়েছে?’
‘আমি জানি না, অফিসার।’
‘আপনার কি কোনো ধারণা আছে, সে কোথায় যেতে পারে?’ প্রশ্নের উত্তরে নীহারিকা খুব সহজ ভাবেই উত্তর দিল—‘নয়নের সঙ্গে আমার এত ভালো সম্পর্ক ছিল না যে সে কখন কোথায় যাচ্ছে বা যাবে, সেটা আমাকে বলে যাবে কিংবা যায়।’
তার এমন উত্তরে আসাদের সন্দেহ হয়; কারণ, তার মধ্যে নয়নের নিখোঁজের জন্য কোনো দুশ্চিন্তা ছিল না বরং একদম সাধারণভাবেই উত্তর দিচ্ছে সব কিছুর। কিন্তু নয়নের নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারে কোনো প্রমাণ তার কাছে ছিল না।
আসাদ চলে যাওয়ার পরও নীহারিকা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল জানালার ধারে। সন্ধ্যার নিঃশব্দ বাতাসে নীহারিকার নিশ্বাস মিলিয়ে যায়। অবশেষে স্নেহার জন্য সে একটি নীল শবপত্র লিখতে পেরেছে। সেই শবপত্রটা হয়তো কখনো হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে চলে যাবে স্নেহার কাছে। নীহারিকার চেহারায় এখন অন্য একরকম প্রশান্তি। কেননা, সে এখন জানে—শ্বাসরোধ করে কাউকে নিশ্বাসহীন করে দেওয়ার অনুভূতিটা কেমন। এখন নীহারিকা রাতে ঘুমাতে পারে। শুধু মাঝেমধ্যে, গভীর রাতের নীরবতা তাকে প্রশ্ন করে—‘তুমি কি এখন সুখী?’ নীহারিকা তখন তার ঠোঁটের কোণে একটুখানি হাসি এনে রাতের নীরবতাকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ে।
* লেখক: নুসরাত আহমেদ আশা, সফটওয়্যার কোয়ালিটি এসুরেন্স ইঞ্জিনিয়ার, কার্ল যাইস ডিজিটাল ইনোভেশন জিএমবিএইচ, মিউনিখ, জার্মানি