কানাডা আদিবাসী রেসিডেনশিয়াল স্কুল আদিবাসীদের নিপীড়নে পোপ ফ্রান্সিসের ক্ষমা চাওয়া আবার আলোচনায়
ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের প্রধান ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস আমাদের মাঝে আর নেই। তাঁর মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে, বিশেষ করে কানাডার অনেক আদিবাসী সম্প্রদায়ের হৃদয়ে, যাঁদের কাছে তিনি একজন সাহসী ক্ষমাকারী হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
২০২২ সালের ২৪ থেকে ২৯ জুলাই পর্যন্ত পোপ ফ্রান্সিস কানাডা সফর করেন। এ সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল আদিবাসী জনগণের প্রতি রোমান ক্যাথলিক চার্চের অতীত কর্মকাণ্ডের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে দুঃখ প্রকাশ ও ক্ষমা চাওয়া।
‘আমি দুঃখিত...,’ কানাডার মাস্কওয়াসিসে পোপের আবেগঘন ভাষণ
সফরের দ্বিতীয় দিন, ২৫ জুলাই ২০২২, পোপ ফ্রান্সিস আলবার্টা প্রদেশের মাস্কওয়াসিস অঞ্চলে যান, যেখানে একসময় ছিল এরমিনেস্কিন ইন্ডিয়ান রেসিডেনশিয়াল স্কুল। সেখানে কানাডার নানা প্রান্ত থেকে আসা আদিবাসী নেতাদের সামনে দাঁড়িয়ে পোপ বলেন, ‘আমি দুঃখিত...আমি বিনীতভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করছি সেই খ্রিষ্টানদের দ্বারা আদিবাসী জনগণের বিরুদ্ধে সংঘটিত মন্দ কাজের জন্য।’ এ বক্তব্য ছিল তাঁর ‘প্রায়শ্চিত্তের তীর্থযাত্রা’র অংশ। কানাডার ইতিহাসে এটি ছিল এক অনন্য মুহূর্ত, যেখানে গির্জার সর্বোচ্চ নেতার মুখ থেকে শোনা গেল একটি রাষ্ট্র অনুমোদিত সাংস্কৃতিক গণহত্যার স্বীকারোক্তি।
সে সময় পোপ ফ্রান্সিস আরও সফর করেন কুইবেক সিটি ও নুনাভুট অঞ্চলের ইকুয়ালিট, যেখানে ইনুইট সম্প্রদায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পুনরায় ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
রেসিডেনশিয়াল স্কুল: কানাডার ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায়
১৮৭০ থেকে ১৯৯০-এর দশক পর্যন্ত প্রায় ১৫০ বছর ধরে কানাডা সরকার ও খ্রিষ্টান গির্জার যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত হয়েছিল এই রেসিডেনশিয়াল স্কুলের ব্যবস্থা। প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার আদিবাসী শিশুকে জোর করে তাদের পরিবার থেকে আলাদা করে এসব স্কুলে পাঠানো হতো। সেখানে তাদের মাতৃভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে ‘সভ্য সমাজে রূপান্তর’ করার নামে চালানো হতো শারীরিক, মানসিক ও যৌন নিপীড়ন। অনেক শিশুই কখনো ঘরে ফিরে আসেনি।
২০২১ সালে ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার কামলুপস এলাকায় বন্ধ হয়ে যাওয়া একটি রেসিডেনশিয়াল স্কুলের চত্বরে ২১৫টি শিশুর অচিহ্নিত কবর আবিষ্কৃত হয়। এরপর সাসকাচুয়ান, ম্যানিটোবা এবং অন্যান্য প্রদেশেও একই ধরনের শত শত কবর খুঁজে পাওয়া যায়। এসব শিশুর মৃত্যুর কোনো সঠিক নথি নেই; অনেক মা–বাবা জানতেও পারেননি যে তাঁদের সন্তান কখন মারা গেছে।
জড়িত ছিলেন কে কে, কারা ক্ষমা চাইলেন না?
কানাডা সরকার গঠিত ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিটির (টিআরসি) মতে, এটি ছিল একটি কালচারাল জেনোসাইড। গির্জা পরিচালিত এই স্কুলগুলোর জন্য দায়ী রোমান ক্যাথলিক গির্জা, অ্যাংলিকান গির্জা, ইউনাইটেড চার্চ অব কানাডা এবং প্রেসবাইটেরিয়ান চার্চ, যাদের অধিকাংশ এখনো পুরো দায় স্বীকার করেনি। রিপোর্টে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, কমপক্ষে ছয় হাজার শিশু মারা গেছে; তবে প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে বলে ধারণা।
বর্তমানে ৩০ সেপ্টেম্বর দিনটিকে কানাডায় পালিত হয় ন্যাশনাল ডে ফর ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন, যাকে বলা হয় অরেঞ্জ শার্ট ডে। একটি শিশু তার হারিয়ে যাওয়া শৈশবকে স্মরণ করে পরেছিল কমলা রঙের জামা, তার স্মৃতিতেই এই নামকরণ।
এ ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত ছিলেন—
স্যার জন এ ম্যাকডোনাল্ড: কানাডার প্রথম প্রধানমন্ত্রী, যিনি এ স্কুলব্যবস্থার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
এজারটন রায়ারসন: যিনি আদিবাসীদের জন্য ‘নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা’র ধারণা দেন।
জোসেফ হুগোনার্ড: রেজিনা ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা।
এ ছাড়া রানি ভিক্টোরিয়া ও রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের নামও এই নিপীড়নমূলক শাসনব্যবস্থার প্রতীকে পরিণত হয়, যার কারণে ২০২১ সালে উইনিপেগে তাঁদের ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হয়।
কানাডাজুড়ে নাম পরিবর্তন ও ভাস্কর্য অপসারণ
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় কলঙ্কময় এ ইতিহাসের পুনর্মূল্যায়নের অংশ হিসেবে মন্ট্রিয়েল, ভিক্টোরিয়া, টরন্টোসহ বহু শহরে স্যার জন এ ম্যাকডোনাল্ড ও এজারটন রায়ারসনের ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলা হয়েছে। টরন্টোর রায়ারসন ইউনিভার্সিটির নাম পরিবর্তনের দাবিও জোরালো হয়েছে।
তবে পোপের মৃত্যুতে বিশ্বজুড়ে শোক প্রকাশ করা হলেও কানাডার অনেক আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে অনুভূতি মিশ্র। কারণ, অনেকেই মনে করেন, পোপের ক্ষমা চাওয়া ছিল প্রয়োজনীয় একটি পদক্ষেপ, তবে তা পর্যাপ্ত ছিল না। তাঁদের মতে, শুধু বক্তব্য নয়, গির্জার সম্পূর্ণ দায় স্বীকার এবং ক্ষতিপূরণ ছাড়া প্রকৃত ন্যায়বিচার সম্ভব নয়। কানাডিয়ান আদিবাসীরা আজও কাঁদে তাদের হারিয়ে যাওয়া সন্তানদের জন্য। আসবে না জেনেও তারা অপেক্ষায় থাকে। তারপরও পোপের উচ্চারিত ‘আমি দুঃখিত’ আজও প্রতিধ্বনিত হচ্ছে কানাডার আদিবাসী জনগণের অন্তরে।
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]