প্রথম প্রেমের মতো
প্রথম আলোর ২০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০১৮ সালে একটা লেখা লিখেছিলাম, ‘প্রথম আলোর সঙ্গে ২০ বছর’। সেখানে সময়ের সঙ্গে প্রথম আলোর ২০ বছরের বিবর্তন নিয়ে বলেছিলাম। ৪ নভেম্বর প্রথম আলো ২৪ বছর পূর্ণ করল। আজও প্রথম আলোর একেবারে প্রথম দিকের কথাগুলো হুবহু মনে পড়ে। আগের লেখাতেই সেগুলো লিখেছিলাম বলে আর পুনরাবৃত্তি করছি না।
আজ বরং বলি প্রথম আলোর সঙ্গে এই ২৪ বছরের সময়টা কেমন কেটেছে। প্রথম আলোর আগে অনেক পত্রিকা পড়া হতো, কিন্তু সেগুলো পড়ার অভ্যাস এখন আর নেই। অন্যদিকে প্রথম আলোতে একদিন চোখ না বোলালে মনে হয়, দেশের সঙ্গে বুঝি যোগাযোগটা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
শুরুতে প্রথম আলো প্রিন্ট ভার্সন পড়তাম, তখনো অনলাইন ভার্সন আসেনি। দিন শেষে পছন্দের পাতাগুলো আলাদা করে বিছানার তোশকের নিচে রেখে দিতাম, বিশেষ করে মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের কলাম এবং আনিসুল হকের গদ্যকার্টুন। ঠিক যেমন কিশোর প্রেমিক তার প্রেমিকার ছবি লুকিয়ে ফেলে। আর শনিবারের ছুটির দিনে এবং সোমবারের আলপিন (সেটা রস+আলো নাম নিয়েছিল) তো সব সময়ই আলাদা করে রাখা হতো সারা সপ্তাহ পড়ার জন্য।
বুয়েটের ড. এম এ রশীদ হলের দুটি উইংয়ের মাঝে সিঁড়ির দুই পাশে ছয়টা করে কক্ষ। আমাদের কক্ষগুলো ছিল ২০১ থেকে ২০৬, কিন্তু যেহেতু সবাই একই প্রসাধনকক্ষ ও গোসলখানা ব্যবহার করতাম, যেটা একেবারে শুরুতে। আমরা তাই সেটার নাম দিয়েছিলাম ২০০ নম্বর কক্ষ। আমাদের সব কর্মকাণ্ডকে বলতাম ২০০ নম্বরের কর্মকাণ্ড। আমাদের এ ২০০ নম্বর কক্ষের মুখপত্র হয়ে উঠেছিল ‘প্রথম আলো’।
এরপর একসময় পাস করে কর্মজীবনে প্রবেশ করলাম। সেখানকার ব্যাচেলর জীবনেও এক অবিচ্ছদ্য অংশ ছিল প্রথম আলো। এরপর বিয়ে করে যখন সংসারী হলাম, তখনো বাসায় প্রথম আলো নিয়মিত রাখা হতো। আমি একইভাবে পছন্দের পাতাগুলো আলাদা করে বইয়ের আলমারিতে রেখে দিতাম। আমাদের বাসা ছিল রাজধানীর উত্তরখানে।
রাজধানীর উত্তরা থেকে সেখানে পত্রিকা যেতে একটু সময় লাগত। অনেক সময় দুপুর হয়ে যেত। ওই সময় বারবার বাসার বারান্দায় এসে রাস্তার দিকে তাকাতাম। মাঝেমধ্যে বাসা থেকে বের হয়ে মোড়ের কাছে গিয়ে অপেক্ষা করতাম প্রথম আলোর জন্য।
একসময় প্রবাসী হলাম। অবশ্য তত দিনে প্রথম আলো অনলাইন ভার্সন চালু করেছে। তাই প্রেমিকার সঙ্গে ভৌগোলিক দূরত্ব তৈরি হলেও মানসিক দূরত্ব তৈরি হলো না। প্রবাসে সকালে ঘুম থেকে উঠেই প্রথম কাজ হচ্ছে প্রথম আলোর হোম পেজে উঁকি মারা। এটা এখন পর্যন্ত একেবারে নিয়মিত রুটিন কাজ। এরপর ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঢুকি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ইদানীং অনেক খবর আসে, কিন্তু সেসব খবরের সত্যতা কতটা, সেটা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। তাই প্রথম আলোর পাতায় উঁকি দিয়ে এর সত্যতা যাচাই করে নিই। আর প্রথম আলোর ফেসবুক এবং ইনস্টাগ্রাম পেজে লাইক দেওয়া থাকাতে সেখান থেকেও সময়ে সময়ে আপডেট পাই। আর প্রিন্ট ভার্সনের মতো একইভাবে এখনো পছন্দনীয় খবরগুলো প্রথম আলোর ফেসবুক পাতা থেকে সেভ করে রাখি, পরে পড়ার জন্য।
এভাবেই প্রথম আলোর সঙ্গে গত ২৪ বছরের প্রেম। আমি প্রচণ্ড রকমের উড়নচণ্ডী স্বভাবের মানুষ। কোনো কিছুতেই বেশি দিন স্থির থাকি না। একসময় চাইতাম, জীবনে একটা প্রেম আসুক। কিন্তু এরপর যখন প্রেম এল, তখন যেন আমি ভেঙে গুঁড়া গুঁড়া হয়ে গেলাম। প্রেম আমার উড়নচণ্ডী জীবনকে একটা নিয়মের মধ্যে বাঁধতে চাইল, তাই শেষমেশ পালিয়ে বেঁচেছিলাম। এরপর আর ও পথে পা বাড়াইনি। কিন্তু প্রথম আলোর সঙ্গে গত ২৪ বছরে ভালোবাসার কোনো পরিবর্তন হয়নি। একসময় তাকে ছুঁয়ে দেখতে পারতাম; কিন্তু এখন আর তা পারি না দূরত্বের কারণে। কিন্তু এই ভৌগোলিক দূরত্ব আমাদের প্রেমে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। এখনো মাঝেমধ্যেই পছন্দের খবরগুলো প্রিন্ট নিয়ে অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে বাসে বা ট্রেনে বসে পড়ি। তখন প্রথম আলোর একটা ছোঁয়া পাই।
প্রথম আলোর এবারের স্লোগান ‘সত্যে তথ্যে ২৪’ আমার কাছে দারুণ লেগেছে। পৃথিবীব্যাপী এখনকার সময়কে বলা হয় ‘ইনফরমেশন ইরা’। যার কাছে যত বেশি তথ্য আছে, সেই এগিয়ে। কিন্তু ইথারের দুনিয়ায় হাজারো মিথ্যা তথ্যের ভিড়ে সত্য তথ্য অন্য সময় চাপা পড়ে যায়। অনেক পত্রিকা শুধু পত্রিকার কাটতি বাড়ানোর জন্য ভুল তথ্যের চটকদার শিরোনাম দিয়ে খবর প্রকাশ করে। এতে তাদের কাটতি বাড়লেও মানুষ বিভ্রান্ত হন।
ছাত্রজীবনে হলের লাইব্রেরিতে দেখতাম সব রকমের পত্রিকা রাখা হতো। সেখানে গিয়ে ছাত্ররা পত্রিকা পড়ত। একটা ব্যাপার আমি লক্ষ করতাম, যে যেই মতবাদের লোকই হোক না কেন এবং সেই মতবাদের পত্রিকাটা পড়ুক না কেন, দিন শেষে একবার হলেও প্রথম আলোর পাতায় উঁকি দিয়ে আসল সত্যটা জেনে নিত। এখনো প্রবাসে মানুষের মধ্যে সেই ধারা অব্যাহত আছে। তাই দিনে দিনে প্রথম আলোর পাঠক কমে না, বরং বাড়ে।
প্রথম আলো নিয়ে আরও কিছু বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। আমার বর্তমান কর্মস্থলে সবাই আয়ারল্যান্ডের বাসিন্দা। এখানে যোগ দেওয়ার পর আমার পরিচয় হয় ‘মাইকেল মিকেলপ’র সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে মতের মিল হওয়াতে আমরা অনেক চিন্তাভাবনা শেয়ার করতাম। আমার লেখাগুলো প্রথম আলোতে প্রকাশ হলেই আমি তাঁকে সেই লিংক দিয়ে দিতাম। এরপর তিনি গুগল ট্রান্সলেট তুলে দিয়ে সেগুলো পড়তেন। এভাবে অফিসের অনেকেই প্রথম আলোর সঙ্গে পরিচিত। আমার বসকে একবার একটা লিংক পাঠিয়েছিলাম।
তিনি ভাষা না বুঝে ভুল করে ‘আপনি কি নিয়মিত এই পেজ থেকে নোটিফিকেশন পেতে চান’-এর হ্যাঁ বাটনে ক্লিক করাতে তার কম্পিউটারে নিয়মিত আপডেট আসতে শুরু করেছিল। পরে একদিন আমাকে ডেকে দেখালে আমি সেটা ঠিক করে দিয়েছিলাম।
এ ছাড়া একবার অফিসে আসার পথে ট্রেনে বসে মুঠোফোনে প্রথম আলো পড়ছিলাম দেখে পাশে বসা ভদ্রলোক বললেন, আপনি বাংলাদেশি। আমি বললাম, আপনি কীভাবে বুঝলেন! তিনি বললেন, আপনি প্রথম আলো পড়ছেন তাই। তিনি বললেন, তিনি নেপালি, কিন্তু বাংলাদেশে অনার্স পড়তে গিয়েছিলেন। সেখান থেকেই বাংলা ভাষা এবং প্রথম আলোর সঙ্গে পরিচয়।
তিনি খুব ভালোভাবে বাংলা বলতে ও পড়তে পারেন। এরপর আমি এ ঘটনা নিয়ে প্রথম আলোতে লিখেছিলাম ‘বন্ধুত্বের সীমানা’। তিনি সেই লেখাটা তাঁর নিজের ওয়ালে শেয়ার পর্যন্ত করেছিলেন। প্রবাসের ভাষায় এরপর তিনি আমাদের ‘ফ্যামিলি রিলেটিভ’ হয়ে গেছেন। এভাবেই প্রথম আলো প্রবাসেও অন্য ভাষাভাষীর সঙ্গে আত্মীয়তার বন্ধন তৈরিতে সহায়তা করে যাচ্ছে।
প্রথম আলোর ২৪ বছর পূর্তিতে অন্তরের অন্তস্তল থেকে শুভেচ্ছা। আর মাত্র এক বছর পর রজতজয়ন্তী উদ্যাপন। আমার মনে হয়, এটা শুধু সম্ভব হয়েছে দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা পাঠকদের জন্য। আর এ ভালোবাসা প্রমাণ করে, প্রথম আলো তার খবরে বস্তুনিষ্ঠ এবং সত্যতা নিশ্চিত করতে পেরেছে। আশা করি, ভবিষ্যতেও প্রথম আলো তার এই ধারা অব্যাহত রাখবে। একটা পত্রিকার পথ পরিক্রমায় ২৪ বছর বড় একটা সময়। দোয়া করি, প্রথম আলো রজতজয়ন্তীর ২৫ পেরিয়ে সুবর্ণজয়ন্তী এবং একসময় হীরকজয়ন্তী পালন করবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যখন বাংলা ভাষা এবং বাঙালির বিবর্তনের পাশাপাশি বিশ্বের ঘটনাবলির বিশ্লেষণ করবে, তখন প্রথম আলো নির্ভরযোগ্য রেফারেন্স হিসেবে কাজ করবে।