3K33: ১ম পর্ব
নীলচে চোখের মণি, একহারা লম্বা পেটানো শরীর ককেশিয়ান লুক, মাথায় ধূসর কালো চুল ছোট করে কাটা। সম্ভবত রেগুলার সুইমিং করে বা লন টেনিস–জাতীয় কিছু খেলে। খুবই উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি, কিন্তু শান্ত।
মন একজন তরুণী, থাকে অস্ট্রেলিয়াতে।
অনেকক্ষণ ধরে ভাবছে সে, এই যুগেও এমন হয় নাকি! এসব তো প্রাচীনকালে হতো, হিস্ট্রিতে পড়েছে, কিন্তু মাথা থেকে একদমই সরানো যাচ্ছে না। এক্ষুনি ট্রেন থেকে নেমে যেতে হবে...সামনের স্টপেজে। শব্দের গতির বেগে ট্রেন ছুটছে, ২.৯ সেকেন্ডে ১ কিলোমিটার যেতে পারে, সুতরাং তিন মিনিটেই তার স্টপেজ চলে আসে। এই নিয়ে দুবার দেখল ছেলেটাকে, দুবারই চোখাচোখি হয়েছে ২–৩ সেকেন্ড, এরপর দুজনেই চোখ অন্যদিকে সরিয়ে নিয়েছে। একদিন ইউনিতে, আজ ট্রেনে, এরপর দেখা হবে খুব সম্ভবত...বেল বেজে উঠল, মন–এর নামার স্টপেজ এসে গেছে, নেমে গেল সে।
মন কার্ড স্ক্যান করে বাসায় ঢুকল, তার রুমের লিকুইড ফুড মেশিনে প্রেস করে অরেঞ্জ জুস নিল এক কাপ, এরপর POM নিয়ে বসে পড়ল বিছানায়...
মনের ঘরের দরজার সামনে ‘বিটা’ দাঁড়িয়ে বাসার কাজে সহকারী রোবট—
শুভ বিকেল মন, তোমাকে এখন কি দেব? Food ক্যাপসুল নাকি স্যালাড না অন্য কিছু?
মনের কপাল কুঁচকে গেল, বলল আমি কি তোমাকে ডেকেছি?
তুমি তো বাইরে থেকে এলেই রোজ ডাকো, এটা আমার সিস্টেমে আপডেট হয়ে আছে, তাই আজ আগেই এলাম।
: তুমি তো দেখি বেশি বোঝা শুরু করছ! আজকে আমি ডাকিনি, যাও...লাগলে আমি ডাকব।
রিমোট দিয়ে দরজা লক করে দিল মন, এরপর তার POM নিয়ে বসল।
বিটা হিউম্যান মাইন্ড ইজ ভেরি স্ট্রেঞ্জ বলে গজগজ করতে করতে চলে গেল।
POM এ দেখল ছেলেটা Ben এ থাকে, বয়স ২৫, উচ্চতা ৬ ৴–২ ৴ ৴, তাদের ইউনিতেই পড়ে, কোর সাবজেক্ট ম্যাথমেটিকস, ইলেকট্রনিকস, পদার্থবিজ্ঞান ও গ্যালাক্সি নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেছে প্রায়, এখন প্র্যাকটিক্যাল প্র্যাকটিস ক্লাসে আছে।
কীভাবে কথা বলা যায়! Text করবে, কিন্তু জানাশোনা নেই তো। আচ্ছা পরে ভাবা যাবে, খুবই ক্লান্ত সে, শাওয়ার–এ গেল।
POM হলো পার্সোনাল ইউজার ট্যাব কাম ফোন যেখানে ফোন, পড়াশোনাসহ যাবতীয় সব কাজ করা যায়, বয়স ১৫ হলেই POM সবার জন্য বাধ্যতামূলক, তবে ৭ থেকে ১৪ পর্যন্ত সবাই সেলুলার মোবাইল ব্যবহার করে, যেগুলো দিয়ে ভিডিও কল ই–মেইল, টেক্সট, প্রজেক্ট ওয়ার্ক, মিউজিক, বুক লাইব্রেরি আর লিমিটেড ব্রাউজ করা যায়।
মন নেমে যাওয়ার ঠিক দুই স্টপেজ পরেই নামল জিল, বাসায় ঢুকেই মনে হলো আজ বাসায় কেউ নেই, সে একা, বাবা–মার আসতে দেরি হবে, এটাও খুবই আশ্চর্য যে সে এখনো তার প্যারেন্ট–এর সাথেই থাকে।
জিল অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে আছে POM–এর স্ক্রিনে। সে তার নিজের ঘরে, হাতে থাকা কফির মগে এক চুমুক দিল, পুরো গোলও না আবার ঠিক চৌকো না, এমন চেহারার একটি মেয়ে, অদ্ভুত সুন্দর চাহনি, স্ট্রেইট নীলাভ কালো চুল, বাদামি ধূসর চোখ, স্লিম বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা, ৫ ৴–৭ ৴ ৴ লম্বা, বয়স ২৩, আই ডি চেক করে দেখল Mel এ থাকে, Uni তে দেখেছে একদিন, আজকে আবার...
দুই year জুনিয়র, গ্র্যাজুয়েশন করছে, Core সাবজেক্ট বায়োলজি, ম্যাথমেটিকস, এনভায়রনমেন্ট এবং এনসিয়েন্ট হিস্ট্রি, ইন্টারেস্টিং!
ম্যাথমেটিকস তো তারও আছে, ওই ক্লাস তো on campus, সুতরাং সেখানেই আর একবার দেখা হতে পারে...
মুখে হাসি ফুটে উঠল, কফির মগ ডেস্ক–এ রেখে বিছানায় শুয়ে পড়ল জিল...
তিন হাজার তেত্রিশ সাল, পৃথিবীর অনেক কিছুই বদলে গেছে, কিছুই আর আগের মতো নেই। কমেছে মানুষ নামক প্রাণীর সংখ্যা, সব সাকল্য ওয়ান বিলিয়নও হবে না আর...প্রাচীনকালের মতো অনেকগুলো দেশও নেই আর। পুরো পৃথিবী মিলে এখন একটি দেশ, নাম AEARA. পুরোনো দিনের পাঁচটি প্রধান অঞ্চলের নামের আদ্য অক্ষর নিয়ে এই নামের উৎপত্তি। Asia, Europe, America, Russia & Australia–এর প্রথম অক্ষর নিয়ে AEARA. ভৌগোলিকভাবে এই পাঁচটি ভিন্ন জায়গায়তেই এখন মানুষের বসবাস খুবই নিয়ন্ত্রিতভাবে যার সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে কেন্দ্রীয়ভাবে কিছু ক্ষমতাশালী ‘মানবন্ত্র’ (মানুষ+যন্ত্র) এবং শক্তিশালী চিন্তাক্ষমতাসম্পন্ন ‘রোবট’।
এরা পৃথিবীর পাঁচটি জায়গায় সম্মিলিতভাবে সবকিছুর দখল নিয়েই পুরো পৃথিবীসহ মহাকাশের অন্য গ্রহ উপগ্রহগুলোকেও পরিচালিত করে। মহাশক্তিধর এই দলের নাম UNIONE . AEARA–র অন্য মানুষেরা এদের হাতের পুতুল, তাদের নিজস্ব ইচ্ছা–অনিচ্ছা খুবই সীমিত। বাড়িঘর,পড়াশোনা, চাকরি, বিয়ে, সন্তান ইত্যাদি সবকিছুই UNIONE–এর মানবন্ত্রদের ইচ্ছাতেই হয়। কেউ যদি তাদের না মানে তাহলে সে গায়েব হয়ে যায়। এই সাধারণ মানুষগুলোর প্রায় প্রত্যেকের শরীরেই বিভিন্ন ডিজিটাল সিসিম (id+memory+gps) ঢোকানো আছে, যা দিয়ে এদের আইডেন্টিটি ও গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করা হয় শক্তিশালী রোবট দ্বারা।
এক শ বছর আগেও কিন্তু পৃথিবী বা Earth এমন ছিল না, অনেক দেশ, অনেক রাষ্ট্রপ্রধান, অনেক মানুষ, অনেক হাঙ্গামা নিয়েই প্রায় ১০ বিলিয়ন মানুষের বাস ছিল। পরপর দুটো ভয়াবহ প্যান্ডেমিক এ জীবিত মানুষের সংখ্যা প্রায় অর্ধেক কমে যায়, এরপর শুরু হয় লাগাতার প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বড় বড় ভূমিকম্প, সুনামি ইত্যাদিতে শেষ হয়ে যায় আরও মানুষের প্রাণ।
এতেও থামেনি, ভয়ংকর দুর্ভিক্ষ শুরু হলো, লেগে গেল কাড়াকাড়ি, মারামারি...বিশ্বযুদ্ধ। যেকোনো বিপর্যয়ে বরাবরই যোগ্যতম জাতি টিকে থাকে, যুদ্ধেও তা–ই হলো...টিকে গেল যারা, গত ২৫ বছর যাবৎ পৃথিবী চালাচ্ছে তারা। খুবই সংঘবদ্ধ একটি দল, ভীষণ রকমের একতা তাদের UNIONE। এখন কোনো ঝামেলা নেই, পৃথিবী বরং এখন আগের চেয়ে ভালোই চলছে...সাধারণ মানুষগুলোর জীবনে শান্তি, স্বস্তি আছে কি না, তা আপেক্ষিক প্রশ্ন, তবে তারা নির্ভেজাল দুশ্চিন্তামুক্ত সুখেই আছে। যাবতীয় চিন্তাভাবনা ও সিদ্ধান্তের দায়িত্ব UNIONE–এর।
মানবন্ত্রদের বিবেচনায় সাধারণ জনগণ থেকে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রতিবছর ১০ জন মানুষকে মানবন্ত্র বানানোর ঘোষণা দেওয়া হয়। তখন ওই ১০ জন মানুষের শরীরে স্বয়ংক্রিয় অতি উন্নত প্রযুক্তির চিকিৎসক রোবট দ্বারা সার্জারি করে অর্ধেক শরীর যন্ত্র করে ফেলা হয়, তখন তারা মানুষ থেকে হয়ে যায় মানবন্ত্র। অনেক বেশি মাত্রায় ক্ষমতাধর হয়ে গেলেও তাদের জীবনযাত্রা একেবারেই বদলে যায়, তারা থাকে ২৪/৭ কড়া নিরাপত্তায়। অত্যাধুনিক অস্ত্রসহ স্বয়ংক্রিয় রোবট দ্বারা। যদিও পৃথিবীতে নেই কোনো দ্বিতীয় দল, নেই কোনো চোর–ডাকাত বা শত্রুপক্ষ, তবুও তারা সর্বোচ্চ নিরাপত্তায় থাকে, কার ভয়ে কে জানে!
জিল শুয়ে শুয়ে ভাবছে BEN–এর প্রিমিয়ার–কে ই–মেইল করবে কি না, সে ‘মন’ নামের একটা মেয়ের সাথে কথা বলতে চায় রিলেশনশিপ বিষয়ে, তাদের কোনো সমস্যা আছে কি না! কি ছাই একটা জীবন...সবকিছুতেই অনুমতি প্রার্থনা!
মন শাওয়ার থেকে বেরিয়ে pray করতে বসল, সকাল সন্ধ্যা দুবেলা সে pray করে, এতে সে মানসিক শান্তি ও স্থিরতা পায়, তার দাদি তাকে শিখিয়েছিল। Pray করা শেষ করে তার মনে হলো সে নিজেই জিল–এর সাথে কন্টাক্ট করবে, আজকেই, এক্ষুনি...
বিটা, আমাকে কিছু প্রোটিন ট্যাবলেট আর এভোকাডো স্যালাড দিয়ে যাও।
বিটা এক মিনিটের মাথায় সব দিয়ে গেল।
মন দরজা lock করে খাবার খেল, এরপর মেশিন থেকে এক মগ latte কফি বানিয়ে POM নিয়ে বসল।
এখানে সবাই সবার ফোন নম্বর চাইলেই বের করতে পারে, তবে ফোন করবে কি না, এটা তার ব্যক্তিগত ইচ্ছা। মন জিলের ফোন নম্বর বের করে টেক্সট করল ‘হ্যালো আমি ‘মন’ তোমার সাথে কথা বলতে চাই...’
জিল শুয়ে শুয়ে মেয়েটার কথা ভাবছিল, হঠাৎ POM এ টেক্সট–এর সাউন্ড, সে হাতে নিয়ে তাকাতেই শক খাওয়ার মতো চমকে গেল, শোয়া থেকে উঠে বসল, ডান হাতে চোখ ঘষে আবার তাকাল, খুশিতে সব দাঁত বেরিয়ে গেল।
টেক্সটটা তিনবার পড়ল, এরপর রিপ্লাই দিল, ‘হাই গুড ইভিনিং, আমি জিল, হ্যাঁ, বলো’
মন পাল্টা রিপ্লাই দিল, ‘কথা বলতে চাইছিলাম, ফোন করব নাকি একদিন কোথাও দেখা করব?’
জিল লিখল, ‘দুটোই করা যায়, এখন ফোন...কথা বলে ঠিক করি কবে কোথায় দেখা করব!
মন লিখল, ‘জানতে চাইলে না কেন দেখা করতে চাই?’
জিল লিখল, ‘তাড়াহুড়োর কি আছে? ও দেখা হলেই জানা যাবে, এখন ফোন দিই?’
মন লিখল, ‘না থাক, দেখা হলেই কথা বলব, আজ তো থার্সডে গেল, কাল ফ্রাইডে, আমার ক্লাস আছে, স্যাটারডে ফ্যামিলি প্রোগ্রাম আছে, সানডে আমরা দেখা করতে পারি’
টেক্সট পড়ে জিলের কপাল কুঁচকে গেল, সানডে তো অনেক দেরি, কিন্তু লিখল আচ্ছা, তবে আমি আগামীকাল ফ্রি আছি, তোমার ক্লাস কয়টায় শেষ হবে? এরপর দেখা করা যায়...
: আমার দেরি হবে কাল, তাড়াতাড়ি হলে আমি টেক্সট বা কল করে তোমাকে জানাব।
বিরস মুখে জিল লিখল, আচ্ছা, জানিও, কিন্তু সানডে কোথায় দেখা করতে চাও?
মন লিখল তোমার সমস্যা না থাকলে Tas–এ যাওয়া যায়, Wine glass Bay সৈকতের পাশে সুন্দর ক্যাফে আছে।
: Ok, কয়টায়?
: আমি সানডে ফ্রি আছি, তুমি কখন ফ্রি?
: সকাল ১০টা?
: ছুটির দিন এত সকালে...! আচ্ছা ঠিক আছে, আমি ১০টায় থাকব ক্যাফেতে।
: ধন্যবাদ।
এখন তাহলে বাই, শুভ রাত্রি।
ফোন কেটে দিল মন।
জিল কাটা ফোনের দিকে তাকিয়ে ভাবছে সানডে ১০টা বাজতে কত ঘণ্টা বাকি! চলবে...
দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]