মরক্কো ভ্রমণের গল্প: পর্ব-২
রাতে ভালো ঘুম হলো। মরক্কোর প্রথম রাত। ভেবেছিলাম সকালে উঠে নাশতা করব বাইরে। কিন্তু বউ–ছেলের ঘুম থেকে উঠতে উঠতেই দুপুর ১২টা। দ্রুত কফি খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। যাব মাদিনা। এ জায়গাটা অনেক বিখ্যাত। কিন্তু ট্যাক্সি পাচ্ছি না। কিছু দূর হাঁটার পর পেলাম। গরম ৩০ ডিগ্রি। কিন্তু খারাপ লাগছে না। বাতাস বইছে চারদিকে। আমাদের মরক্কোর গাড়িচালক খুব ফুর্তিবাজ। মোটামুটি ইংরেজি জানে। আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে বলল, ‘ওহ মুসলমান, আমি আমার মাকে নিয়ে ওমরাহ হজে গিয়েছিলাম। অনেক বাংলাদেশি দেখেছি সেখানে।’ তারপর আমার ছেলের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলেই বন্ধু হয়ে গেল। তারপর গান ছেড়ে দুজনেই নাচতে থাকল। গাড়ি চালিয়ে চালিয়ে। এসে নামলাম মাদিনা। এ জায়গাটার ছবি আমি অনেক দেখেছি অনলাইনে। আজ নিজেই এখানে দাঁড়িয়ে। আমাদের তিনজনকে ঢুকতে দেখে, ঘোড়ার গাড়িওয়ালারা ঘিরে ধরল আমাদের—ঘোড়ার গাড়িতে ওঠেন, ঘোড়ার গাড়িতে। একজনকে বললাম, তিনজন কত?
১৫০ দিরহাম। মানে ১ হাজার ৮ শ টাকা।
১০ মিনিট ঘুরাবে, তাতেই এত! আসলে এখানে সব কিছুই দামদর করতে হয়। হয়তো ৫০০ টাকায় রাজি হয়ে যাবে। আমরা বললাম, আমরা এখন চড়ব না। কিন্তু এরা নাছোড়বান্দা। পিছে পিছে হাঁটতে লাগল। ভেতরে ঢুকে প্রথমে ছেলে মরক্কোর জুব্বা কিনল, অনেকটা পাঞ্জাবির মতো। বউও কিনল টুকটাক। হাজারো দোকান চারপাশে। প্রচুর পর্যটক। আছে ভিক্ষুকও। আছে বাদ্যবাজনা। বানরের নাচ। হাতে মেহেদি দেওয়ার লোক। বিচিত্র এক জগৎ এখানে। ফলে ফলে সাজানো দোকান। মনোরম। গেলাম ফলের জুস খেতে। ওহ মা। ফলে হাত দিয়ে দেখি শক্ত শক্ত। এগুলো আসল ফল নয়। ফলের পুতুল। ফল খেলাম না। ঢুকলাম এক রেঁস্তোরায়। সেখানে অনেক মানুষের ভিড়। মানুষজন গরুর মাথা খাচ্ছে, পা খাচ্ছে। ছেলে–বউকে বললাম খাবে এসব? তারা নাক সিটকিয়ে বলল, না। পরে মরক্কোর বিখ্যাত ‘লাজান’ খেলাম। এটা চিকেন কারির মতোই। রসুন আর জলপাই দিয়ে রাঁধা। খেয়ে ভালোই লাগলো। সঙ্গে দেয় মোটামোটা ফ্রি ব্রেড। রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে একটা ব্যাগ কিনলাম। তারপর গেলাম ঐতিহাসিক কুতুবিয়া মসজিদে। আসরের নামাজ পড়তে। এটা প্রায় ৮০০ বছরের পুরনো মসজিদ। ছোটবেলায় স্কুলে এই মসজিদ বিষয়ে পড়েছিলাম। এখানে আসতে পেরে খুবই ভালো লাগছে। কিন্তু অজুর জায়গা পাচ্ছি না। অনেকটা হেঁটে পেলাম। ছোটছোট বালতিতে পানি ভরে এনে অজু করতে হয়। বিশাল মসজিদের ভেতরে ঢুকে দেখি আলো আঁধারের খেলা। হয়তো বিদ্যুৎ সাশ্রয় কিংবা গরম কম লাগার জন্য এই ব্যবস্থা। নামাজ পড়ে চলে গেলাম, মারাকেশ শহরেরর সবচেয়ে বড় সুপার মলে। ওহ মা, ওইখানে গিয়ে দেখি কোরবানির হাটও আছে। বড় বড় দুম্বা। শপিং মলের ভেতরে ঢুকলাম। ছেলে বলল ম্যাকডোনাল্ড খাবে। এখানে সবই হালাল। মুসলিম দেশ। সে ম্যাকডোনাল্ডের লাইনে দাঁড়াল আর আমরা পাশের এক রেস্তোরাঁয় গিয়ে মরক্কোর খাবার খাওয়ার প্রস্তুতি নিলাম। হরেক রকম খাবার সেখানে। কিন্তু বুঝতে পারছি না কোনটা কী রকম। হঠাৎ পাশের এক ভদ্রলোক কথা বলে উঠলেন, ভাইসাব, বালানি?
এই মরুর দেশে, কে কথা বলে মায়ের ভাষায়!
ভদ্রলোক সিলেটি। থাকেন ব্রিটেনের নিউক্যাসেলে। বেড়াতে এসেছেন মরক্কো। এখানে তার শ্বশুরবাড়ি। তার বউ ও শাশুড়ি আমাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করলেন, ইংরেজিতে। সিলেটি ভাইসাবের কাছ থেকে, মরক্কোর খাবারদাবার সম্পর্কে জানলাম। তারপর বিভিন্ন রকমের খাবার অর্ডার দিলাম। কোনোটা মজার, কোনোটা রাবিশ। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ছেলে বলল, শিশা খেয়ে দেখতে চায়। এটা অনেকটা হুকা খাওয়ার মতো। ছেলেকে বললাম এটা খাওয়ার দরকার নেই। ছেলে বলল, তুমি বলেছিলে, ছোটবেলায় তুমি তোমার নানার হুকা টান দিয়েছো। আমি টান দিলে সমস্যা কী!
ঠিক আছে একবার ট্রাই করতে পারো। আর কখনো না।
ওকে।
কিশোর ছেলের অনেক বিষয়ের ওপর কৌতুহল। আমরা একটা আলো–আঁধারের সুরঙ্গ দিয়ে ঢুকতে লাগলাম। চারদিকে নিষিদ্ধ নিষিদ্ধ গন্ধ। অবশ্য ভেতরের জায়গাটা সুন্দর। ছেলেমেয়েরা কাজ করছে একসঙ্গে। ইংরেজি জানে ওরা। বিনয়ী। ছেলে হুঁকা টানল। ৫০ দিরহামে, মানে ৬০০ টাকা। হুকা টানে আর ভিডিও অন করে বন্ধুদের দেখায়। দেখো আমি আরব শেখ, কীভাবে হুকা টানি। একটু বাহাদুরি আর কী। হুকা টেনে বেরিয়ে দেখি সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। রুমে ফিরতে হবে। কিন্তু ট্যাক্সি পাচ্ছি না। বউ ছেলে বলল, চলো হেঁটেই যাই। হাঁটতে খারাপ লাগছে না। প্রায় আধা ঘণ্টা হেঁটে রুমের কাছাকাছি এলাম। হঠাৎ দেখি একটা রেস্তোরাঁয় এক মেয়ে পরোটা ভাজছে। বউ দাঁড়িয়ে গেল। মেয়েকে ইংরেজিতে বললাম, পরোটার ভেতর ডিম দিচ্ছ? নাকি কিমা? মেয়েটা ইংরেজি বুঝতে পারছে না। দৌড়ে এল আরেক মেয়ে। সেও ইংরেজি জানে না। বিপদে পড়ে দুই মেয়ে ডেকে আনল কালো আফ্রিকান এক যুবককে। যুবক এসে বলল, এটাতে ডিমও নেই, কিমাও নেই। আছে পেঁয়াজ ও স্পাইস। ৪০০ টাকায় ৪ পরোটা কিনে রুমে ফিরলাম। গোসল করলাম। খাওয়া দাওয়া করলাম। সারা দিন হাঁটার কারণে শরীর অনেক ক্লান্ত। এতটা হাঁটাহাঁটি আমি বিগত ২০ বছরে করিনি। ভাবলাম, রাতে পায়ের ব্যথায় ঘুমাতে পারব না। কিন্তু কোনো ব্যথা হয়নি। আমরা তো গরমের দেশের মানুষ। গরমে এসেই উজ্জীবিত হয়ে যাই। ব্যথা আবার কী! চলবে...
*আগামীকাল পড়ুন: মরক্কো ভ্রমণের গল্প: পর্ব-৩
দূর পরবাসে ভ্রমণ, ভিডিও, ছবি, ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]