বড় হওয়া ভালো, ভালো হওয়া তার চেয়ে বড়

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

পাঠকেরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, আজকের শিরোনামটি আমার নিজের দেওয়া নয়। অন্য একজনের কাছ থেকে শোনা ও ধার করা। এ কথাটি ইতিমধ্যে আপনাদের হয়তো অনেকেরই জানা হয়ে গেছে। এমন সুন্দর উদ্ধৃতি আমি প্রথম শুনেছি বেশ কয়েক বছর আগে ঢাকার কোনো এক বাংলা টিভি চ্যানেলের টক শোতে। সেই দিনের অতিথি ছিলেন অভিনেত্রী শম্পা রেজা। প্রসঙ্গক্রমে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে ওই আলোচনায় তিনি এ কথা যথোপযুক্তভাবেই পেড়েছিলেন। শম্পা রেজা বলেছিলেন, তিনি একবার ট্রেনে করে কোথাও যাচ্ছিলেন।

পথে কোনো এক অজপাড়াগাঁয়ের ছোট স্টেশনে এসে ট্রেনটি থামল। জানালা দিয়ে তিনি এদিক–ওদিক দেখছিলেন। হঠাৎ তাঁর নজরে এল, দেয়ালে একেবারে কাঁচা হাতে কেউ লিখে রেখেছে, ‘বড় হওয়া ভালো, ভালো হওয়া তার চেয়ে বড়’। দেয়ালের লিখনটি তাঁর কাছে খুব পছন্দ হয়েছিল। শোনামাত্র তাৎক্ষণিকভাবে আমার কাছেও খুব ভালো লেগেছিল। এমন সুন্দর কথা কার না ভালো লাগবে, বলুন তো? এর তাৎপর্য ও গভীরতা হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়ার মতো। সেদিনকার অতিথির মুখে এই অমূল্য বাণীটি শুনে সঙ্গে সঙ্গে ভেবেছিলাম, এ নিয়ে একটা কিছু লিখব এবং আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করব, কিন্তু নিত্যদিনের ব্যস্ততায় লেখা আর হয়ে ওঠেনি। কয়েক দিনের মধ্যেই কথাটিও আমার মন থেকে হারিয়েও গেল।

বেশ কিছুদিন পর স্বাভাবিক এক সকালে ঘুম থেকে উঠে ঢাকার অনলাইন বাংলা কাগজে যখন চোখ বোলাচ্ছিলাম, তখন হঠাৎ ওই দিনকার টিভি টক শো ও ওই মূল্যবান কথাটি হুবহু আমার মনের আয়নায় আবার ভেসে উঠল। কেন এত দিন পর এ কথা সেদিন নতুন করে মনে পড়ল, তা ভেবে সময় নষ্ট না করেই লিখতে বসলাম। লিখতে গিয়ে প্রথমেই এক ধাক্কা খেলাম। বুঝলাম, এ কথার ওজন আমি যতটা ভেবেছিলাম, তার চেয়ে অনেক বেশি। এর গভীরতা অনুধাবন করে কিছু লিখতে গেলে যে পরিমাণ তথ্য-উপাত্ত, যুক্তির সাযুজ্য ও জ্ঞান–বুদ্ধি দরকার, আমার মধ্যে তার প্রচুর ঘাটতি রয়েছে। এ দুর্বলতার কথা মেনে নিয়েই এক দিকে ভাবতে লাগলাম এবং আরেক দিকে কি–বোর্ডে আঙুল চালাতে শুরু করলাম। লেখাটি দাঁড় করাতে আমার প্রায় সারাটা দিন লেগেছিল। তারপর ঘষামাজা করেছি আরও কয়েক দিন ধরে। তবু জানি না, কেমন হয়েছে।

ভালোর বক্তব্যে স্পষ্টতই রয়েছে দুটি অংশ। ‘বড় হওয়া’ ও ‘ভালো হওয়া’। প্রথমে দেখা যাক, ‘বড়’ হওয়া মানে কী এবং কারাই–বা ‘বড়লোক’? ‘বড়’ বলতে আমরা সাধারণত যা বুঝে থাকি, তা হলো প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া অর্থাৎ উচ্চতর ডিগ্রি কামাই করা। বড় চাকরি পাওয়া। রাষ্ট্র ও সমাজের ওপর খবরদারির দায়িত্ব পাওয়া। বড় ব্যবসা করা। ব্যবসায় সফল হওয়া। প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক হওয়া। বড় বাড়িতে থাকা। দামি গাড়িতে চড়া। শানশওকতের মধ্যে জীবন যাপন করা। সমাজের ক্ষমতাবান ও উঁচুতলার লোকজনদের সঙ্গে চলাফেরা, উঠবস করা ইত্যাদি।

আপাতদৃষ্টে সমাজে ‘বড়’ হয়ে যাঁরা প্রতিষ্ঠা পান, তাঁরা আবার দুই ধরনের। এক জাতের ‘বড়লোক’ আছেন, যাঁরা ‘বড়’ হতে গিয়ে অসৎ কিংবা অনৈতিক পথের ধারেকাছে যান না। সৎ পথে থেকে বড় হওয়ার চেষ্টা করেন এবং সফলও হন। তাঁরা তাঁদের বড়লোকি যেখানে–সেখানে জাহির করতে চান না। করেনও না। মানুষকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য জ্ঞান করেন না। অহংকার তাঁদের চরিত্রে নেই। সমাজের দুর্বল ও গরিব মানুষের প্রতি তাঁদের নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব পালনে সব সময় আন্তরিক ও সচেষ্ট থাকেন। ধর্ম-কর্মও পালন করেন। এ–জাতীয় বড়লোকদের বেলা কেউ বলতেই পারেন, বড় হওয়া ভালো। কিন্তু এ রকম ‘বড়লোক’ সমাজে কয়েকজনই–বা পাওয়া যায়। থাকলেও হাতে গোনা এবং তাঁরা সহজে ধরাও দেন না। এই লাজুক লুকিয়ে থাকা লোকগুলো আমাদের গর্ব। সমাজের অমূল্য সম্পদ। তাঁরা এতই প্রচারবিমুখ, তাঁদের সহজে শনাক্ত করা যায় না। এমন মহৎ ব্যক্তিদের মূল্যায়নই–বা করব কীভাবে?

এবার আসা যাক, নকল বড়লোকদের কথায়। তাঁরা আজকাল সংখ্যায় অনেক। চোখ মেললেই আশপাশে তাঁদের চলতে ও ফিরতে দেখা যায়। তাঁরা ধান্দাবাজ, চালাক ও অতি চালাক। আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে, ক্ষমতা বলয়ের কাছাকাছি থেকে, সব ধরনের সাহায্যে নীতি-নৈতিকতার মাথা খেয়ে, চাতুর্যের সঙ্গে তাঁরা আপন আপন স্বার্থ আদায় করতে ওস্তাদ। তাঁরা সব কাজ সাবধানতার সঙ্গে ও সুকৌশলে নিপুণভাবে সমাধান করেন। তাঁদের কোনোভাবেই ধরাছোঁয়া যায় না। তাঁরা দুর্নীতিবাজ, চতুর, সাহসীও বটে। আর এসব বদ গুণের কারণেই তাঁরা ‘বড়’ হতে পারেন। তর তর করে বিশাল বড় হয়ে ওঠেন। তাঁদের বিদ্যাশিক্ষা থাকতে পারে, আবার না–ও থাকতে পারে। তবে তাঁদের অর্থবিত্তের কোনো কমতি থাকে না, থাকে না ক্ষমতারও। তাঁদের বেলায় যে কথাটি ষোলো আনা সত্য, তা হলো, ‘Behind every opportunity, there is a crime’ এমন বড়লোকদের কি কেউ ‘ভালো ’বলতে পারেন? আলবৎ না। তাহলে দেখা যায়, ‘বড় হওয়া ভালো’ এ কথার সঠিক মূল্যায়ন করার আগে জানতে হবে, কে কীভাবে ‘বড়’ হয়েছেন। তিনি বড়লোকির প্রচার ও প্রসার করেন কি না। করলে কীভাবে? তাই সহজেই আমরা এই উপসংহার টানতে পারি, ‘বড় হওয়া ভালো’ কথাটি কারও কারও জন্য প্রযোজ্য হলেও এটা সর্বজনীনভাবে সঠিক নয়।

এবার দেখে নিই ‘ভালো হওয়া’ মানেটা কী এবং কারা ভালো হতে পারেন। কারা ভালো হন। এ প্রসঙ্গে আমার ব্যক্তিগত মত, ‘ভালো’ হতে গেলে ‘বড়’ হতে হয় না। যে যে পেশাতেই থাকুন না কেন, চাইলেই তিনি সফল হতে পারেন। সার্থক হতে পারেন। ‘ভালো’ হতে পারেন। ‘ভালো’ হতে হলে কাউকে প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, উকিল-মোক্তার, জজ-ব্যারিস্টার, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, টাকার কুমির, নামশীল, সুশীল, সমাজসেবক, উচ্চশিক্ষিত, অধ্যাপক, ইমাম, মোয়াজ্জিন, এমনকি নোবেল লরিয়েটও হতে হয় না। ‘ভালো’ হওয়ার পূর্বশর্ত হলো, যে যে কাজই করুন না কেন, তাঁর কাজটি তিনি সর্বদা আন্তরিকভাবে সম্পাদন করেন এবং করেন একান্তই যোগ্যতা, দক্ষতা, দায়িত্বশীল ও নিষ্ঠার সঙ্গে; কাজ করেন দেশপ্রেম ও মানবপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে। কাজে ভুল হলে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপান না বা চাপানোর চেষ্টাও করেন না। ষোলো আনা দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন এবং ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের বা অন্য কোনো রকমের ভুল না হয়, তার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করে নিজের কাজ যত্নের সঙ্গে করে যান। সত্যিকারের ‘ভালো’ যিনি, তিনি কারও প্রতি অবিচার করেন না। আবার কেউ তাঁর প্রতি অন্যায় করলে সেটা সহ্যও করেন না। তিনি যে ব্যক্তিই হোন না কেন। তিনি কখনো কাজে ফাঁকি দেন না কিংবা দেওয়ার চেষ্টা করেন না। জনগণ, প্রকৃতি ও পরিবেশের সেবাই তাঁর কাজের মূল উদ্দেশ্য, অন্য কিছু নয়। আর যিনি মানুষের সেবা করেন, সৃষ্টির সেবা করেন, বিশ্বাস যদি থাকে, তবে তিনিই তো হতে পারেন সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব।

তাহলে দেখা যায়, জনসেবার মনোবৃত্তি নিয়ে, ন্যায়-নীতি, আইনকানুন মেনে সঠিকভাবে আপন দায়িত্ব পালন না করলে একজন প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, নোবেল লরিয়েট, কোটিপতি কিংবা সুশীল সমাজের সমাজপতি যেমন ‘খারাপ’ হতে পারেন, তেমনি আবার উল্টো বিবেচনায় একজন কেরানি, চাপরাশি কিংবা একজন মেঘরানি সততা, আন্তরিকতা ও দায়িত্বশীলতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে অনায়াসেই হতে পারেন ‘ভালো’। অনেক ‘ভালো’একজন মানুষ। আর যে মানুষটি ‘ভালো’, তিনি যত গরিব হোন না কেন, তিনি যত ছোট কাজই করুন না কেন, তাঁকে আমি ‘ছোট’ বলি কী করে! তিনি তো ‘বড়’। অনেক ‘বড়’। অনেক মহৎ। আমার কাছে তাঁর স্থান অনেক উঁচুতে। তিনি অনুসরণীয় ও অনুকরণীয়। অন্যভাবে বলতে গেলে, প্রকৃত অর্থে যিনি ‘ভালো’, তিনি ‘বড়’।

আর কেউ যদি ‘বড়’ হতে চান, তাহলে তাঁকে আগে ‘ভালো’ হতেই হবে, অন্য কোনো পথে ‘বড়’ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। মেকি বড়লোক প্রসঙ্গে সাংবাদিক নাঈমুল ইসলাম খানের কথাটা অন্যভাবে বললে দাঁড়ায়—যারা বলে বড়লোক, তারা বড় নয়। তাদের শুধু বড়র মতো দেখতে মনে হয়...।

লেখক: অধ্যাপক, অর্থনীতি, টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি ও এডিটর, জার্নাল অব ডেভেলপিং এরিয়াজ