নানাকে নিয়ে লেখা
নানাবাড়িতে বেড়াতে যাওয়া সব নাতি–নাতনির কাছে সব সময়ই অতি আনন্দের। তবে আমার কাছে ব্যাপারটা বেশি আনন্দের ছিল। এর সবচেয়ে বড় কারণ বাবা–মায়ের হাতের মার খাওয়া থেকে বিরতি আর পড়াশোনা থেকে বিরতি। আমার বাড়ি থেকে নানাবাড়ি লঞ্চে যেতে দু-তিন ঘণ্টা লেগে যেত। কিন্তু ওই সময়টাকে তখন মনে হতো এ রকম যে ১০ ঘণ্টা দূরের পথও পাড়ি দেওয়া যায়, যদি গন্তব্য হয় নানাবাড়ি। নানাবাড়িতে ফেলে আসা দিনগুলো এখনো মনের কোণে উঁকি দিয়ে চোখ ভিজিয়ে দেয়। আমি আমার মাকে মাঝেমধ্যে বলি, নানা আর কিছুদিন বেঁচে থাকলে কী হতো? হয়তো আমার মা–ও জানে, এ প্রশ্নের উত্তর শুধুই এক বুক হাহাকার আর ফেলে আসা স্মৃতির কষ্ট।
নানাবাড়ির সকালটা অদ্ভুত মোহে কেটে যেত। সকালে নানার ফজরের নামাজের সুরাগুলোর আওয়াজ শোনা মানেই আমি নানাবাড়িতে। আর এর মানে হলো নানা বাজারে যাবেন এবং পারলে সব নাতি–নাতনিকে দল বেঁধে নিয়ে যাবেন আর আমরাও নানার সঙ্গে যেতে এক পায়ে রাজি। যদি আমাদের কারও চোখে ঘুম থাকত, তাহলে নানার কালো রঙের লম্বা লাইটের আলো সে ঘুম উড়িয়ে দিত। এর পেছনে বড় কারণ ছিল নানার সঙ্গে বাজারে যাওয়া মানে পরোটার সঙ্গে ডাল আর কনডেন্স মিল্কের চা দিয়ে পেটটাকে ভরে নিয়ে আসা।
প্রচণ্ড সাহসী মানুষ ছিলেন আমার নানা। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাদের কাছে অনেকবার ধরাশায়ী হয়েছেন কিন্তু কখনোই নিজেকে সমর্পণ করে দেননি। সত্তোরোর্ধ্ব বয়সেও বৃষ্টি, বন্যা যা–ই হোক, আমার নানার বাজারে যাওয়া কেউ থামাতে পারত না। স্বরুপকাঠির মাহমুদকাঠী বাজারে নানাকে একনামে সবাই চিনতেন।
আমার মেয়ের জন্ম জাপানে। মাঝেমধ্যে খুব ইচ্ছা করে নানা বেঁচে থাকলে আমার মেয়ে ও সহধর্মিনীকে নানাকে দেখানোর। কী সাদা মনের মানুষ ছিলেন আমার নানা, তা পুরো আরামকাঠী জানত। আরামকাঠী ছিল আমার নানাবাড়ি।
নানার সঙ্গে বাজারে গিয়ে ২ টাকা আর নানাবাড়ি থেকে চলে আসার সময় ১০ টাকা পাওয়া ছিল আমাদের মৌলিক অধিকার। তখনকার দিনে মুঠোফোন ছিল না। তারপরও নানা আমাদের পরীক্ষা শেষের তারিখ জানলে বাজারে মাঝেমধ্যে ওই তারিখগুলোতে অপেক্ষা করতেন, যদি আমরা এসে পড়ি।
নানা তাঁর নাতি–নাতনিদের নিয়ে খুব গর্ব করতেন। আমি ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পেয়েছি শুনে নানা বাজারের সবাইকে বলেছিলেন। নানা বকা দিতেন যদি কেউ শীতে গোসল না করত। তবে নানাবাড়িতে গিয়ে গোসল না করার কাহিনি একটাই। নানাবাড়ির পুকুরের পানি থাকত অনেক ঠান্ডা আর বদ্ধ। মনে হতো বরফের দেশে আছি।
নানাকে কাঁদতে দেখতাম যখন আমরা বিদায় নিতাম। কারণ আমার নানা সব সময় নাতি–নাতনি দিয়ে ভরা বাড়ি পছন্দ করতেন। আগে যে নানাবাড়িতে ঘুমানোর জায়গা থাকত না, আজ সেই বাড়িটা পুরো ফাঁকা। আজ অনেক বছর হলো নানা নেই, নানিও নেই। আমি গিয়েছিলাম ২০১৪ সালে, কিন্তু বাড়িটাতে কী যেন নেই মনে হতে থাকল। মনে হলো যেন চেনা ঘরের অচেনা আমি। এরপর আর যাইনি। জানি না কখনো যাওয়া হবে কি না।
জাপানের এ দূর প্রবাসে নানাকে খুব মনে পড়ে। ঈদ এলে ১০ টাকার প্লাস্টিকের গাড়ি, নানার নামাজের পবিত্র সুর, নানার সঙ্গে বাজারে যাওয়া—এসবই এখন মন খারাপের স্মৃতি।
আমার মেয়ের জন্ম জাপানে। মাঝেমধ্যে খুব ইচ্ছা করে নানা বেঁচে থাকলে আমার মেয়ে ও সহধর্মিনীকে নানাকে দেখানোর। কী সাদা মনের মানুষ ছিলেন আমার নানা, তা পুরো আরামকাঠী জানত। আরামকাঠী ছিল আমার নানাবাড়ি।
নানা যেখানে আছেন, ভালো থাকবেন। আপনার নাতি আজ জাপানে আইটি ইঞ্জিনিয়ার, কিন্তু আপনাকে দেখাতে পারলাম না। প্রিয় পাঠক সবাই আমার নানা–নানির জন্য দোয়া করবেন। বিকেলের লাল আভায় গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছি নীড়ে। ওই দূরের আকাশে নানাও হয়তো আমাকে দেখছেন।