সুইডেনের মিলিও স্টেশন: আবর্জনা থেকে সম্পদ গড়ার গল্প

ছবি: লেখকের পাঠানো

যেখানে অন্যরা আবর্জনা ফেলে, সুইডেন সেখানে গড়ে তোলে ভবিষ্যতের সম্পদ। পুরোনো জিনিসের পুনর্জন্ম ও ভবিষ্যতের টেকসই ভাবনা করে দেশটি। সুইডেন—পরিচ্ছন্ন, শান্তিপূর্ণ ও পরিবেশবান্ধব জীবনধারার এক আদর্শ রাষ্ট্র। কিন্তু এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে গভীর কাঠামোগত শৃঙ্খলা ও নাগরিক সচেতনতা, যার অন্যতম ভিত্তি হলো ‘মিলিও স্টেশন’। বাংলায় বলা যায়, পরিবেশ সংরক্ষণের আধুনিক কর্মশালা।

এখানে কেবল আবর্জনা ফেলা হয় না; বরং প্রতিটি জিনিসকে সতর্কভাবে পরীক্ষা করে দেখা হয়—কী ফেলে দেওয়া হবে আর কী আবার ব্যবহারযোগ্য। গাড়ির পুরোনো টায়ার থেকে শুরু করে রেফ্রিজারেটরের কমপ্রেসর, এমনকি দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত গাড়ির দরজাও এখানে নতুন জীবন পেতে পারে।

কীভাবে কাজ করে মিলিও স্টেশন?

সুইডেনের প্রতিটি কমিউনে রয়েছে এই স্টেশন, যেখানে গৃহস্থালি ও শিল্পবর্জ্য আলাদা আলাদাভাবে নেওয়া হয়। প্রধান বিভাগগুলো সাধারণত—

• ইলেকট্রনিক বর্জ্য (টিভি, ফ্রিজ, ল্যাপটপ, চার্জার)

• গাড়ির যন্ত্রাংশ (টায়ার, ব্যাটারি, হেডলাইট, দরজা)

• বাগানের বর্জ্য (পাতা, ডাল, ঘাস)

• বিষাক্ত বর্জ্য (ব্যাটারি, পুরোনো রং, রাসায়নিক)

• কাঠ, প্লাস্টিক, ধাতব বস্তু, কাচ।

নাগরিকেরা নিজেদের গাড়ি বা ট্রলিতে এসব নিয়ে এসে নির্দিষ্ট কনটেইনারে ফেলেন। কোথায় কী ফেলতে হবে, তা স্পষ্টভাবে চিহ্নিত থাকে এবং প্রয়োজনে কর্মীরা সহযোগিতা করেন।

দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত গাড়ি—ভেতরে সম্ভাবনার খনি—

একটি গাড়ি দুর্ঘটনায় নষ্ট হলেও এর অনেক যন্ত্রাংশ ঠিক থাকে, যেমন—

• টায়ার

• হেডলাইট

• রেডিও

• সিট

• দরজা

• এক্সেল বা ব্রেক ইউনিট

এসব সরাসরি ফেলে দেওয়া হয় না। বরং সরকার অনুমোদিত প্রক্রিয়ায় সেগুলো পরীক্ষা, পরিষ্কার এবং পুনর্ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত করা হয়।

ছবি: লেখকের পাঠানো

ব্যক্তিরা চাইলে কিনতে পারেন—

• অনলাইন মার্কেটপ্লেস

• স্থানীয় স্ক্রুট কোম্পানি

অন্যান্য যন্ত্রাংশের ক্ষেত্রেও একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। একটি অকেজো রেফ্রিজারেটরের কমপ্রেসর, ফ্যান মোটর বা থার্মোস্ট্যাট এখনো কার্যকর হতে পারে। কম্পিউটারের হার্ডড্রাইভ, টিভির ডিসপ্লে—সবই নতুনভাবে কাজে লাগানো যায়। এসব অনেক সময় পাঠানো হয় ‘ReTuna terbruksgalleria’-তে—সুইডেনের অনন্য উদ্ভাবন—যেখানে পুরোনো যন্ত্রাংশ দিয়ে তৈরি হয় নতুন পণ্য, যা পরে সাশ্রয়ী দামে বিক্রি হয়।

পরিবেশ ও অর্থনীতির অনন্য সমন্বয়

এই মডেলের মাধ্যমে সুইডেনে বছরে—

• ৯০ শতাংশের বেশি বর্জ্য পুনর্ব্যবহার হয়

• ল্যান্ডফিল (আবর্জনার স্তূপ) প্রায় শূন্য

• নতুন যন্ত্রাংশের খরচ ৪০ থেকে ৭০ শতাংশ সাশ্রয়

• রিসাইক্লিং ও কারিগরি খাতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি

এটি কেবল অর্থনৈতিক কার্যক্রম নয়; বরং জীবনের প্রতি ও প্রকৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শনের একটি উপায়।

নাগরিক শিক্ষায় প্রভাব:

স্কুল থেকে শুরু করে ঘরে ঘরে শেখানো হয়—

• বর্জ্য আলাদা করার নিয়ম

• কোন জিনিস ফেলা যাবে, আর কোনটি পুনর্ব্যবহারযোগ্য

সন্তানরা বাবার সঙ্গে মিলিও স্টেশনে গিয়ে শিখছে দায়িত্ববোধ ও সচেতনতা। এটি একধরনের নৈতিক শিক্ষা, যা ছোটবেলা থেকেই নাগরিক জীবনের অংশ।

বাংলাদেশের জন্য শিক্ষা:

বাংলাদেশে এখনো—

• গাড়ি ও ইলেকট্রনিক বর্জ্য যত্রতত্র ফেলা হয়

• চোরাই যন্ত্রাংশের বাজারে ঝুঁকি বেশি

• পরিবেশদূষণ ভয়াবহ পর্যায়ে

সুইডেনের এই মডেল অনুসরণ করে গড়ে তোলা যেতে পারে—

• সিটি করপোরেশনভিত্তিক আধুনিক মিলিও স্টেশন

• সরকার অনুমোদিত স্ক্রুট কোম্পানি

• অনলাইন পার্টস রিসেল প্ল্যাটফর্ম

• বাধ্যতামূলক পরিবেশ শিক্ষা

ছবি: লেখকের পাঠানো

শেষ কথা—বাতিল নয়, পুনর্জন্ম

একটি পুরোনো গাড়ি বা অকেজো টিভি আসলে সম্ভাবনার দরজা। সুইডেনের প্রতিটি মিলিও স্টেশন একটি টেকসই সমাজের নীরব চালিকা শক্তি, যেখানে প্রতিটি নাগরিক নিজেকে পরিবেশ রক্ষার অংশ মনে করে।

এটি শুধু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নয়; বরং একটি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। বাংলাদেশসহ যেসব দেশ এখনো পরিবেশ ও পরিকল্পনায় পিছিয়ে, তাদের জন্য এটি হতে পারে ভবিষ্যতের আলোকবর্তিকা।

‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]