শিক্ষক দিবসে একজন শিক্ষকের যত কথা

বাংলাদেশসহ বিশ্বের শতাধিক দেশে ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস উদ্‌যাপিত হচ্ছে। জ্ঞানের ফেরিওয়ালাদের নিয়ে প্রকাশ হচ্ছে ‘দূর পরবাস’-এ।

১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে ভর্তি হই। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবার বিভাগে ফিরে এলাম। মুক্তিযুদ্ধে অনেক বন্ধুকেই হারালাম। মাস্টার ডিগ্রি করার সময়ে হঠাৎ একদিন রীনা বউদি বললেন, ‘আমাদের একজন রসায়নের শিক্ষক দরকার।’ রীনা দাশ তখন হলিক্রস কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল। আমি তো এক্সাইটেড, মেয়েদের ক্লাসে পড়াতে হবে। আমার ক্লাস বন্ধুদের কাছে কদর বেড়ে গেল। মেয়ে বন্ধু জুটিয়ে দিতে হবে তাদের।

আমাকে রীতিমতো ডেমো ক্লাস দিতে হলো। প্রিন্সিপাল খুশি হলেন কিন্তু কিছু উপদেশ দিলেন। ক্লাসে রিজার্ভ থাকতে হবে এবং বেশি মুভমেন্ট করা উচিত হবে না। বোঝো তো এরা টিন এজার।

তিনটি মাস অতি দ্রুতই চলে গেল। শেষ দিন ক্লাসে ছাত্রীরা আমাকে ফেয়ারওয়েল পর্যন্ত দিল এবং উপহার দিল। সবচেয়ে বড় কাজ যেটি হলো আমার জীবনের মোড়টাই বদলে গেল। পরে শিক্ষকতাই আমার একমাত্র পেশা হয়ে গেল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ায় সেলেম ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এবং বর্তমানে ১৮ বছর ধরে মিসিসিপি ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনে শিক্ষকতা করছি। দুটি টেক্সট বই লিখেছি আর এই বই এখানকার ছাত্রছাত্রীরা পড়ছে। কতটা সফল জানি না, তবে সুখী তো বটেই। একসময় নিজেও ছাত্র ছিলাম। সেই প্রাইমারি স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত কত শিক্ষকেরা পড়িয়েছেন, ভাবলে অবাক হতে হয়। কমবেশি সবার কথাই মনে পড়ে।

পঞ্চাশ থেকে ষাটের দশকের দিকে গ্রামের প্রাইমারি ও জুনিয়র হাইস্কুলের শিক্ষকদের বেশ কড়া মনে হতো। বেশির ভাগ শিক্ষকদের হাতেই বেত থাকত। বিশেষ করে অঙ্ক ও ইংরেজির শিক্ষকেরা। আর হেডমাস্টার হেঁটে গেলে সব নিশ্চুপ। স্কুল ভিজিটে পরিদর্শক আসার কদিন আগে থেকেই প্রস্তুতি। প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে তো। গ্রামের মেঠোপথ দিয়ে ছাতা হাতে শিক্ষক স্কুলে আসা–যাওয়া করতেন। কোনো কোনো শিক্ষক সাইকেলে আসতেন। দেখা হলেই সালাম/আদাব/নমস্কার। সেই গ্রামের জুনিয়র হাইস্কুল থেকে স্কলারশিপের কল্যাণে একদিন তখনকার কিশোরগঞ্জ মহকুমা শহরে কিশোরগঞ্জ হাইস্কুলে ভর্তি হলাম। বিজ্ঞানের প্রতি ভালো লাগা তখন থেকেই শুরু। রসায়নের নূরুল আমিন স্যার এবং পদার্থবিজ্ঞানের বি কে স্যার কেমন যেন অতি সহজ করে বোঝাতে পারতেন।

রসায়নের অবিনাশকতার সূত্র কিংবা পদার্থবিদ্যার পড়ন্ত বস্তুর মাধ্যাকর্ষণ সূত্র মনে গেঁথে গিয়েছিল। আর তনু স্যারের নোট করা বাংলা পড়ে লেখালেখির হাতেখড়ি হয়ে গেল আমার। কী অনিন্দ্য সুন্দর ভাষা! কবিগুরু ও বিদ্রোহী কবির বেশ কিছু কবিতা মুখস্থ রাখতে হতো। সুযোগমতো রচনায় জুড়ে দিতে হবে। ভালো ভালো শিক্ষকদের পড়ানোর সুফলও পাওয়া গেল।

লেখক
ছবি: সংগৃহীত

১৯৬৭ সালে ঢাকা বোর্ডের এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলে কিশোরগঞ্জ হাইস্কুল এযাবৎকালের সেরা ফলাফল করেছিল। নমস্য আমাদের শিক্ষকদের।

অতঃপর কিশোরগঞ্জ থেকে চলে এলাম নটর ডেম কলেজে। বাংলার আরেকজন শিক্ষক পেলাম। আমাদের হামিদ স্যার। কী দারুণ পড়াতেন! গল্প করে করে পড়াতেন এবং উনি খুব হিউমার করতে পারতেন। পাশের রুম থেকে কত শব্দ আসে, তোমাদের কানে ঢোকে না। কিন্তু চুড়ির ঝুনঝুনি শব্দে কান খাড়া হয়ে যায়।

কথা প্রসঙ্গে বিদেশিদের উনি বলতেন, ‘তোমাদের দেশে গাড়ি এবং বাড়িতে এয়ারকুলার থাকে আর আমাদের এখানে ব্যক্তিগত মোবাইল এয়ারকুলারসহ অনেককেই রাস্তায় হাঁটতে দেখা যায়।’ পরীক্ষায় রচনা লিখতে গিয়ে আমি নিজের বানানো কবিতা, ‘কবির ভাষায়’ লিখে দিতাম। আমাদের বীজগণিত পড়াতেন হক স্যার। স্যারের নিজের লেখা বই আমাদের পাঠ্য ছিল। ফাদার গ্রাহাম রসায়ন এবং ফাদার ভেন্ডেন বোস পদার্থবিজ্ঞান পড়াতেন অনেকটা আমেরিকান স্টাইলে।

তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৬৯ সালে। জৈব রসায়নে মফিজ স্যার, মসিউজ্জামান স্যার, গিয়াসউদ্দিন স্যার, তৌফিক স্যার—এমন টপ রেটেড শিক্ষক একমাত্র আমরাই পেয়েছি। সত্যিকথা বলতে কি, অনেক ভালো ভালো শিক্ষক পেয়েছিলাম বলেই আমাদের ব্যাচের প্রায় ১৫–১৬ ছাত্রছাত্রী উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে আসতে পেরেছে। অবশ্যই প্রত্যেকে জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে।

আমাদের সময়ে শিক্ষা ক্ষেত্রে ততটা রাজনীতি ছিল না। শিক্ষা থেকে রাজনীতিটা বাদ দিতে পারলে দেশ আরও এগিয়ে যেত। এ প্রসঙ্গে ভারতের একসময়ের রাষ্ট্রপতি এবং ভারতের প্রয়াত রকেট বিজ্ঞানী ড. এ পি জে আবুল কালামের একটি উদ্ধৃতি তুলে ধরলাম, ‘যদি একটি দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হয় এবং সুন্দর মনের জাতিতে পরিণত করতে হয়, আমি দৃঢ়ভাবে অনুভব করি যে তিনটি প্রধান সামাজিক সদস্য রয়েছে যারা অবদান রাখতে পারে, তারা হলেন বাবা, মা ও শিক্ষক।’

একটি সুস্থ দেশ গড়ার জন্য সুস্থ পরিবেশ, সুস্থ শিক্ষকসমাজ প্রয়োজন। আর সুস্থ শিক্ষাব্যবস্থার জন্য জাতীয় রাজনীতি বর্জন আবশ্যক। ইউনেসকো প্রবর্তিত বিশ্ব শিক্ষক দিবসের এ বছরের থিম হলো ‘আমরা যে শিক্ষা চাই, তার জন্য শিক্ষকের প্রয়োজন: বিশ্বব্যাপী শিক্ষকের ঘাটতি দূর করা অপরিহার্য’। এর মানে বিশ্বব্যাপী শিক্ষকের ঘাটতি চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে আমি বলব, তা অবশ্যই সঠিক। প্রাথমিক স্তরে স্কুলগুলোয় বহু বছর ধরেই শিক্ষকের ঘাটতি চলছে। অন্যান্য দেশ থেকে প্রতিবছরই শিক্ষক নেওয়া হচ্ছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২৩ সালেই যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ২৫ শতাংশ শিক্ষকের কমতি। বিশেষ করে অঙ্ক শিক্ষকের খুবই অভাব, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় স্তরেও। পরিশেষে বলতে চাই, শুধু শিক্ষক নয়, ভালো ভালো শিক্ষক প্রয়োজন।

লেখক: জীবেন রায়, অধ্যাপক, সায়েন্স অ্যান্ড ম্যাথমেটিকস, মিসিসিপি ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন, আমেরিকা।

**লিখতে পারবেন আপনিও। লেখার শিরোনামের ওপর ‘শিক্ষক দিবসের লেখা’ শব্দটি লিখবেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা [email protected]