দায়িত্বের ভারে ন্যুব্জ প্রবাসীরা: মৌমাছির জীবনের এক মানবিক রূপ
মৌমাছি, প্রকৃতির এক বিস্ময়কর সৃষ্টি। তাদের পুরো জীবন পরিশ্রম আর কর্তব্যে নিবেদিত, যেখানে নিজস্ব চাহিদার জন্য কোনো জায়গা নেই। একইভাবে, এক কোটির বেশি প্রবাসীর জীবনও যেন এই মৌমাছিদের জীবনের এক মানবিক রূপ, যাঁরা নিজেরা স্বপ্ন দেখেও তা পূরণের সুযোগ কমই পান।
প্রবাসীদের জীবন কি নিছকই দায়িত্ব আর কর্তব্যের গল্প, নাকি এর গভীরে লুকিয়ে আছে আত্মত্যাগ আর মানবিক মূল্যবোধের এক জ্বলন্ত উদাহরণ? মৌমাছি ও প্রবাসীর জীবনের এই মিল এবং অমিল আমাদের এক গভীর প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায়—তাঁদের জীবন কি আসলেই শুধুই ‘দায়িত্ব’ না কি তারা ‘অধিকার’ পাওয়ার যোগ্যও?
মিল: নিঃস্বার্থ পরিশ্রমের উপাখ্যান
মৌমাছিরা প্রতিদিন ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে ফুল থেকে মধু সংগ্রহে বের হয়। তারা দলবদ্ধভাবে কাজ করে, নিজেদের সঙ্গীদের জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু সেই মধু যা তারা তৈরি করে, তার স্বাদ কখনোই তারা পায় না।
প্রবাসীদের জীবনও যেন একইরকম। তারা পরিবার, সমাজ এবং দেশের জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে।
দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ, বিদেশে কঠোর শ্রম দিয়ে অর্থ পাঠায় তারা, যা দেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি।
পরিবারের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য নিজের ইচ্ছা, স্বপ্ন এবং কখনো কখনো নিজেদের সুখও বিসর্জন দেয়।
তাঁদের এই নিঃস্বার্থ পরিশ্রম আমাদের দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহকে স্থিতিশীল রাখে, যা জাতীয় অর্থনীতির অন্যতম প্রধান ভিত্তি। কিন্তু, মৌমাছিদের মতোই, তাঁরা এই শ্রমের ফল ভোগ করতে পারেন না।
অধিকার বনাম দায়িত্ব: প্রবাসীদের অসামঞ্জস্যপূর্ণ ভারসাম্য:
মৌমাছির জীবনে কোনো অধিকার নেই। তারা জন্মের পর থেকে একটি কঠোর প্রাকৃতিক নিয়মে বাঁধা। তাদের জীবন শুধুই কাজ আর দায়িত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ। অপরদিকে, প্রবাসীদেরও প্রায়শই তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে হয়।
অনেকেই অমানবিক পরিবেশে কাজ করতে বাধ্য হন, যেখানে তাদের মৌলিক মানবিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়।
কাজের পরিবেশে নিরাপত্তার অভাব, বেতন বৈষম্য এবং সামাজিক সুরক্ষার অভাব তাঁদের জীবনের স্বাভাবিক অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তাদের ওপর আরোপিত দায়িত্বের বোঝা ক্রমাগত বাড়লেও সেই তুলনায় তাঁরা অধিকার ও সুরক্ষা পায় না। এই অসম ভারসাম্য তাঁদের জীবনকে নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগের এক করুণ চিত্রে পরিণত করে।
অমিল: আত্মত্যাগের বাইরে স্বপ্ন আর সম্ভাবনার লড়াই
যদিও মৌমাছিরা কোনো স্বপ্ন দেখে না, কোনো ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা রাখে না, প্রবাসীদের জীবন সেই চক্র থেকে আলাদা। তারা আত্মত্যাগের পাশাপাশি জীবনের প্রতি নতুন আশার আলোও খুঁজে পায়।
প্রবাসীরা স্বপ্ন দেখে পরিবারের জন্য একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ তৈরির।
তারা আশা করে, একদিন দেশে ফিরে নিজেদের শ্রমের মূল্য পাবে এবং পরিবারের সঙ্গে একটি সম্মানজনক জীবন কাটাবে।
কিন্তু প্রায়ই সেই স্বপ্নগুলো তাদের চোখের সামনে ভেঙে পড়ে। বিদেশে কঠিন পরিশ্রম করে অর্জিত অর্থ অনেক সময় দেশে দুর্নীতি, লুটপাট, কিংবা পারিবারিক বিরোধে নষ্ট হয়ে যায়।
প্রবাসীদের জীবন: এক অনিশ্চিত যাত্রার গল্প
বিদেশে যাওয়ার প্রথম ধাপেই প্রবাসীরা একটি কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হযন। দালালদের শোষণ, প্রশাসনিক জটিলতা এবং নানা ধরনের লাঞ্ছনার মধ্য দিয়ে তারা দেশ ছাড়ে। নতুন দেশে পৌঁছে শুরু হয় এক বিরামহীন পরিশ্রমের জীবন। দেশে ফিরে তাদের জন্য অপেক্ষা করে আরেকটি কঠিন বাস্তবতা।
প্রশাসনের সাহায্য নিতে গেলে ঘুষ বা দুর্নীতির ফাঁদে পড়ে তাঁরা হতাশ হন।
প্রায়শই তাঁদের সঞ্চিত অর্থ লুটপাট বা দখলের শিকার হয়।
তাঁদের জীবনময় আত্মত্যাগের পরও দেশে তাঁরা সম্মানের বদলে অবহেলার পাত্রে পরিণত হন।
এই বাস্তবতা শুধু দুঃখজনক নয়, এটি আমাদের জাতীয় মানবিক বোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। আমরা কি কেবল দায়িত্বের কথা বলেই প্রবাসীদের মূল্যায়ন করব? নাকি তাদের ন্যায্য অধিকার এবং মর্যাদা নিশ্চিত করার জন্য বাস্তব পদক্ষেপ নেব?
এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার মধ্যেই লুকিয়ে আছে প্রবাসীদের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতার প্রকৃত স্বরূপ।
কেন প্রবাসীদের জন্য জীবন এত কঠিন—পর্যালোচনা ও প্রস্তাবনা
প্রবাসীদের জীবন কঠিন হওয়ার পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে, যা তাঁদের আত্মত্যাগকে আরও বেদনাদায়ক করে তোলে। মৌমাছিদের মতোই, প্রবাসীরা নিরলস পরিশ্রম করে অন্যের জন্য, কিন্তু নিজেদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। নিচে এর কারণ এবং সম্ভাব্য সমাধান আরও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা হলো।
কেন এত বাধা
১. দালাল চক্রের প্রতারণা
অনেক প্রবাসী বিদেশে যাওয়ার স্বপ্নে দালাল চক্রের ফাঁদে পড়ে। এ চক্র তাদের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে সর্বস্ব কেড়ে নেয়।
ভিসা ও কাজের নিশ্চয়তার প্রতিশ্রুতি পূরণ না করে মাঝপথে ফেলে রেখে যায়।
অনেক সময় প্রতারণার ফলে প্রবাসীরা নিঃস্ব হয়ে দেশে ফেরে।
২. প্রশাসনিক দুর্নীতি:
দেশে ফিরে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করলে, প্রবাসীরা প্রশাসনের দুর্নীতির শিকার হয়।
সরকারি সহায়তার ক্ষেত্রে ঘুষ বা অনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়।
জমিসংক্রান্ত বিরোধ বা সঞ্চিত অর্থ রক্ষার জন্য প্রশাসনের সঠিক সহায়তা পায় না।
৩. আইনের দুর্বলতা:
জমি দখল, সম্পত্তি জটিলতা বা প্রতারণার শিকার হলেও যথাযথ আইনি সুরক্ষা পাওয়া কষ্টকর।
বিদেশি মুদ্রা উপার্জনের মতো গুরুত্বপূর্ণ অবদানের পরও আইনের চোখে তাঁদের প্রাপ্য মূল্যায়ন প্রায়ই অনুপস্থিত।
৪. সামাজিক মূল্যায়নের অভাব:
প্রবাসীদের সামাজিক মর্যাদা তাঁদের অবদানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
পরিবার ও দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করেও তাঁরা সামাজিকভাবে অবহেলিত থাকে।
তাঁরা দেশে ফিরলেও অবদান বা আত্মত্যাগ যথাযথভাবে স্বীকৃত হয় না।
১. পেশাগত ও ভাষাগত দক্ষতা বৃদ্ধির উদ্যোগ:
বিদেশে কাজের জন্য প্রয়োজনীয় পেশাগত দক্ষতা ও ভাষা শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া জরুরি।
প্রশিক্ষণকেন্দ্র: বিদেশে যেতে আগ্রহী শ্রমিকদের জন্য বিনা মূল্যে পেশাগত প্রশিক্ষণ ও ভাষা শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে তোলা উচিত।
ভাষার উপর জোর: কর্মক্ষেত্রে ও স্থানীয় সংস্কৃতিতে মানিয়ে নিতে ইংরেজি বা প্রাসঙ্গিক ভাষার প্রশিক্ষণ অপরিহার্য।
পেশাগত সনদ প্রদান: আন্তর্জাতিক মানের স্বীকৃত সনদ প্রদান করলে তাদের জন্য উচ্চ আয়ের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা সম্ভব।
২. দালাল চক্রের প্রতিরোধ
সরকারি নিয়ন্ত্রণ: বিদেশে যাওয়ার প্রক্রিয়া সরাসরি সরকারি নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।
নিবন্ধিত এজেন্সি: বিদেশগামীদের শুধু অনুমোদিত রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
শাস্তি: দালাল চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে বিশেষ আইন প্রণয়ন জরুরি।
৩. প্রবাসী কল্যাণ পরিষেবা
প্রবাসী সুরক্ষা অফিস: বিদেশে বাংলাদেশি দূতাবাসগুলোকে আরও কার্যকর করে তুলতে হবে।
হটলাইন ও জরুরি সহায়তা: প্রবাসীদের জন্য একটি আন্তর্জাতিক হটলাইন চালু করা এবং দ্রুত সমাধানের ব্যবস্থা করতে হবে।
ভ্রমণ বিমা: বিদেশগামী শ্রমিকদের জন্য বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্য ও ভ্রমণ বিমা চালু করা উচিত।
৪. প্রশাসনিক জটিলতা দূরীকরণ
বিশেষ প্রশাসনিক ইউনিট: প্রবাসীদের জন্য একটি বিশেষ প্রশাসনিক ইউনিট তৈরি করা উচিত, যা তাদের সমস্যা সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ নেবে।
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম: প্রবাসীদের আবেদন ও সমস্যার জন্য একটি কেন্দ্রীয় অনলাইন প্ল্যাটফর্ম চালু করা উচিত, যেখানে দুর্নীতি বা দেরি করার সুযোগ থাকবে না।
৫. দেশে বিনিয়োগের সুযোগ
প্রবাসীদের দেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা দেওয়া উচিত।
করছাড়: বিনিয়োগকারীদের জন্য করছাড়ের সুবিধা।
বিনিয়োগ সহায়তা: নিরাপদ এবং লাভজনক বিনিয়োগ নিশ্চিত করার জন্য বিশেষায়িত ব্যাংকিং পরিষেবা চালু করা।
ইনকামিং ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যান: বিদেশ থেকে সঞ্চিত অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে প্রণোদনা।
৬. প্রবাসী সম্মাননা ও সামাজিক মূল্যায়ন
প্রবাসী দিবস: বার্ষিকভাবে একটি ‘জাতীয় প্রবাসী দিবস’ পালনের মাধ্যমে তাদের অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া।
অভিনন্দন পদক: সফল প্রবাসীদের জন্য রাষ্ট্রীয় পুরস্কারের ব্যবস্থা করা।
মিডিয়াতে প্রচারণা: প্রবাসীদের আত্মত্যাগ এবং অবদান সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধিতে গণমাধ্যমে নিয়মিত প্রচারণা চালানো।
বর্জণীয়: কী এড়ানো উচিত?
১. দুর্নীতি ও ঘুষ
প্রশাসনে ঘুষ এবং দুর্নীতি বন্ধে কঠোর নজরদারি প্রয়োজন।
২. অধিকার লঙ্ঘন
প্রবাসীদের সম্পত্তি বা অধিকার ক্ষুণ্ন করা পুরোপুরি নিষিদ্ধ করতে হবে।
৩. অবহেলা ও অসম্মান
প্রবাসীদের প্রতি প্রশাসন এবং সমাজের অবহেলামূলক আচরণ বন্ধ করতে হবে।
উপসংহার: প্রবাসীদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব
মৌমাছিরা যেমন নিজেদের মধু থেকে বঞ্চিত, প্রবাসীরাও তাঁদের কষ্টার্জিত অর্থের প্রকৃত সুফল প্রায়ই পায় না। তবে তাদের এই কষ্ট লাঘব করা সম্ভব যদি আমরা প্রশাসনিক জটিলতা দূর করি, তাঁদের অধিকার নিশ্চিত করি এবং তাঁদের প্রতি একটি মানবিক মনোভাব গড়ে তুলি।
প্রবাসীরা কেবল অর্থনীতির চালিকা শক্তি নয়, তারা আমাদের জাতীয় গৌরব। তাঁদের প্রতি সম্মান এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব। এভাবে প্রবাসীদের জীবনমান উন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ নিলে তাদের জীবন শুধু সহজ নয়, আরও নিরাপদ এবং সম্মানজনক হবে।
বি.দ্র. এতক্ষণ যা লিখেছি, তা শুধু একটি প্রতিবেদন নয়, বরং আমার নিজের জীবনের গল্প। কারণ, আমি নিজেই সেই হতভাগা দূরপরবাসী, যিনি বছরের পর বছর কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে পরিবারের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করেছি। তবে দেশে ফিরে দেখেছি, অধিকার এবং সম্মান কেবলই মরীচীকা। এই লেখাটি আমার একার নয়; এটি লাখো প্রবাসীর কথা, যারা দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হলেও তাদের যোগ্য মর্যাদা থেকে বঞ্চিত। তাই এ লেখার মাধ্যমে আমি কেবল নিজেদের অভিজ্ঞতা ভাগ করছি না, বরং একটি পরিবর্তনের দাবি জানাচ্ছি।
*লেখক: রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক