সালাম সালাম হাজার সালাম

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার
ফাইল ছবি

‘ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে’—এমন অনুভূতি ছিল ফাগুন মাসের প্রতি। কিন্তু ১৩৫৮ সাল থেকে আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো ফাল্গুন মাস আমাদের হৃদয়ে ফিরে আসে একগুচ্ছ ফুলের মালা নিয়ে শহীদ মিনারে। এ মাসের শুরুতেই আমার মনটি হাসি-কান্না, মান-অভিমান, আবেগ-ভালোবাসায় পরিপূর্ণ হয়। যদিও আমি ভালোবাসার মায়া ত্যাগ করে অন্য কিছুর আহ্বানে প্রলুব্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করতে চাই না। আমি ভালোবাসার মধ্যে বেঁচে থাকতে চাই। ঠিক আমার মতো বেঁচে থাকার শখ ছিল তাঁদেরও, যাঁরা বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে ঝরে পড়েছিল একটি সোনার বাংলার মাতৃভাষাকে ধরে রাখার স্বার্থে, ভালোবাসার স্বার্থে। সে সব শহীদের ঝরে পড়া রক্তের বিনিময়ে আমি আজ আমার ভালোবাসার অনুভূতি, মুখের বাণীর মধ্য দিয়ে পৃথিবী এবং পৃথিবীর মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারছি, পারছি ভালোবাসার কথা বলতে প্রিয়জনকে।

৮ ফাল্গুন ১৩৫৮ সালে (২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২) এক স্বৈরশাসক বলেছিলেন, বাংলা নয় উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা—মূলত এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করতে যাঁরা সেদিন বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করেছিলেন, তাঁদেরই আমরা স্মরণ করি বছরের এ দিনটিতে। ৮ ফাল্গুনের এ দিনে মাতৃভাষার জন্য যাঁরা জীবন দিয়েছিলেন, তাঁদের সুবাদে একটি জাতি হয়েছে ধন্য। একটি জাতি পেয়েছে একটি ভাষা, পেয়েছে রক্তে রাঙা একটি পতাকা, পেয়েছে একটি ভাষার নাম। সে সব শহীদের ত্যাগের কথা আজীবন বাঙালি জাতি ও মানব জাতি স্মরণ করবে এই পৃথিবীতে। মাতৃভাষার জন্য জীবন দিয়েছে যে জাতি সে হলো বাঙালি জাতি। আমরা আজও ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’র গান গাই। ছোট–বড় থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সরকারপ্রধানসহ অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা একগুচ্ছ ফুলের মালা মধ্যরাতে স্মৃতিসৌধে গিয়ে অর্পণ করি সব শহীদের স্মরণে। যদিও এ দিনটির কথা আমরা শুধু বছরে একবারই মনে করি। স্বাধীনতার যুদ্ধে, ভাষা আন্দোলনের মিছিলে বা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে যাঁরা জীবন দিয়ে চলেছেন, তাঁদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা কতটুকু সত্যিকারার্থে? আমার মনে হয়, যদি শতভাগ কৃতজ্ঞতা বোধ থাকত, তাহলে আমরা দেশকে, দেশের সাধারণ মানুষকে সম্মানের সঙ্গে দেখতাম। তারপর এ বাংলা ভাষার পরিবর্তে উর্দু হবে রাষ্ট্রভাষা, ঔপনিবেশিক শক্তি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর এই অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপ না মানার কারণেই বাঙালি জাতি রক্ত দিয়েছিল অথচ এখনো দেশে আর এক ঔপনিবেশিক শক্তি ব্রিটিশের তৈরি নিয়মকানুন আমরা মেনে চলেছি।

শুধু তা–ই নয়, আমরা পালন করে চলেছি ইংরেজি মাস ২১ ফেব্রুয়ারি। ভাষা আন্দোলনের এত বছর পরও কেউ এ পর্যন্ত বলেনি যে ২১ ফেব্রুয়ারি নয়, ৮ ফাল্গুন বাংলা মাসে ঘটনাটি ঘটেছে। অনেকে তা–ও জানেন না যে আমাদের বাংলা মাস ও বছর রয়েছে। মাসটি এবং বছরটির একটি বাংলা পরিচয় রয়েছে। এটাই সংশোধন করা হলো না অথচ বলা হচ্ছে, বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা করার চেষ্টা চলছে।

বলা হচ্ছে, তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করেছি। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীদের ভাষা ও বর্ণমালাকে বিলুপ্তি থেকে রক্ষা করার জন্য ২০১৭ সাল থেকে তাদের ভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রবর্তন করেছি। এ বছর তাদের নিজস্ব ভাষায় প্রায় ৩৩ হাজার বই বিতরণ করেছি। আমরা বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমি সবিনয় বলতে চাই, ২১ ফেব্রুয়ারি না বলে ৮ ফাল্গুন যেন বলা হয়, সেই ব্যবস্থা করুন অগত্যা এই দিনটিতে। শুধু কি তাই, আমরা বিজয় দিবস এবং স্বাধীনতা দিবস পালনেও কিন্তু এখনো ১৬ ডিসেম্বর এবং ২৬ মার্চ বলি। যে ভাষার জন্য জীবন দেওয়া হলো অথচ ঠিক এই দিনটিতেও সেই বাংলা ভাষার দিন, মাস ও বছরের ব্যবহার আজও হলো না!

যাহোক, আমার নাম বাংলাদেশ। এ নাম আমি পেয়েছিলাম আমার পূর্বপুরুষদের থেকে। আমার তিন দিকে ভারত ভূমি, তবুও আমি গর্বের সঙ্গে যুগ যুগ ধরে বুকভরা ভালোবাসা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আমার কোলে জন্ম নেওয়া আমার পূর্বের সন্তানেরা আমাকে খুব ভালোবাসত। আমার ওপর পরপর কয়েকবার বড় ঝড় এসেছে। কিন্তু আমার সন্তানেরা আমাকে বড় বিপদ থেকে রক্ষাও করেছে। একবার আমার নামও বদলে দিয়েছিল। কিন্তু বহিঃশত্রুকে তাড়িয়ে আমার সন্তানেরা আমাকে মুক্ত করেছে। আমার অনেক সন্তান আমার জন্য জীবনও দিয়েছে। তারা আমার বুকে আশ্রিত আমার ভালোবাসায়। আমাকে তারা ভালোবাসা দিয়ে মুগ্ধ করেছে। ভেবেছিলাম বাকি জীবনটা আমার সন্তানদের নিয়ে সুখে কাটাব। কারণ, আমার তো সবই আছে।

আমাকে আমার সন্তানেরা স্বাধীন করেছে, তাই তাদের জন্য আমি সব উজাড় করে দিয়েছি। আমার ভূমিতে তারা যা রোপণ করছে, তাতেই ফলছে প্রচুর ফসল এবং আমিই পৃথিবীর একমাত্র দেশ, যেখানে যে যা ইচ্ছা তাই ফলাতে পারে। সবাই বলে আমি নাকি সোনার বাংলা। আমাকে সব দেশের রানী বলেও আখ্যায়িত করা হয়েছে। আমি অনেক আশা–ভরসা নিয়ে শুরু করেছিলাম এক উন্নত সমাজ গঠনের এই যাত্রা। আমি সব সময়ই চাই, আমার সব সন্তান নিয়ে বিশ্বের বুকে গর্বের সঙ্গে বসবাস করব। কিন্তু কী চেয়েছিলাম আর কী হতে চলেছে। আজ ৫২ বছর কেটে গেল! কিন্তু কোথায় সেই উন্নত সমাজ? আমি তো আর পারছি না এই পশ্চাৎপদতা সহ্য করতে! কী অন্যায় আমি করেছি যে নিজের সন্তানেরা আজ আমার বুকে ঢালছে বিষাক্ত বিষ এবং আমার উর্বরতাকে ধ্বংস করছে। আমার কর্মক্ষমতাও নষ্ট করতে চেষ্টা করছে! আমার ভূমিতে বাস করা নানা জাতিসত্তার মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও সংখ্যালঘুদের বিতাড়িত করতে উঠে পড়ে লেগেছে। অথচ তারাও আমার সন্তান। তারা নিজেদের মধ্যে ঘৃণার বিষবাষ্প ছড়িয়ে একে অপরকে শেষ করছে। তারা আমার নামের ওপর কলঙ্কের ছাপ ফেলছে। এসব নিয়ে আমাকে বিশ্বের সবাই ঠাট্টা করছে! আমাকে সবাই কলঙ্কিনী বলছে! আমাকে অনেকে বলছে আমার সন্তানেরা অনেকেই দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর।

কিন্তু কেন? কী অন্যায় আমি করেছি যে আমার সন্তানেরা আমাকে বিশ্বের কাছে এত ছোট করছে? ছোটই যদি করবে, তবে কেন তারা আমাকে বহিঃশত্রু তাড়িয়ে স্বাধীন করেছিল? আমি তো আর সহ্য করতে পারছি নে! তারা দিনের পর দিন অন্ধকার আর অধঃপতনের দিকেই কি চলবে? তারা শিক্ষা বিসর্জন দিতে চলেছে। তারা কু-শিক্ষার বীজ বপন করতে শুরু করছে। শিক্ষাব্যবস্থায় অনেক বড় বড় সমস্যা তৈরি হয়েছে। কারিকুলাম ডেভেলপমেন্ট, উত্তম পাঠ্যপুস্তকের অভাব এবং অতি অবশ্যই ভালো শিক্ষকের অভাব খুব লক্ষণীয়। কিন্তু তারা এখনো ভালো শিক্ষক তৈরির কোনো ভিত গড়ে তুলতে পারেনি এবং এটা নিয়ে কেউ ভাবতেও চায় না। চাহিদাভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম না চালিয়ে শুধু লাখ লাখ সার্টিফিকেটধারী গ্র্যাজুয়েট বের করে তারা আমার সংকট আরও ঘনীভূত করছে, যেটা কেউ মানতে নারাজ। চাহিদাভিত্তিক, জ্ঞাননির্ভর, পেশাগত দক্ষতা উন্নয়ন যে সত্যিকারের মানবসম্পদ তৈরির সেরা উপায়, সেটাও তারা স্বীকার করছে না। তাই সারা দেশে স্কুল–কলেজে ছেয়ে গেলেও মানসম্পন্ন সুশিক্ষা ও বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠছে না। যাদেরকে শিক্ষার কারিগর বলে আমি গর্ব করতাম, তারাও এখন উঠে পড়ে লেগেছে আমার মুখে চুন কালি মাখাতে। তারা শুধু দায়িত্ব-কর্তব্যে অবহেলাই নয়, সক্রিয়ভাবে পরীক্ষায় নকল করাকে সাহায্য করছে, যাতে করে প্রশাসনকে জবাবদিহি করতে না হয়, পরীক্ষার খারাপ ফলাফলের কারণে। তারা আমাকে পৃথিবীর নিম্ন মানের সারিতে ফেলতে চেষ্টা করছে। আমার ১৭ কোটি সন্তানের মধ্যে কেউ কি নেই যে এর প্রতিবাদ করতে পারে? আমার এই দুর্দিনে কি কেউ নেই যে সত্যি আমাকে সুন্দর সমাজ গঠনের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারে?

মানুষকে একতাবদ্ধ করতে পারে? কেন এত নিশ্চুপ তারা? কেন? আমার ভালোবাসা তো তাদের জন্য কখনো কমেনি! আমার যা আছে তা যদি তারা মিলেমিশে দেখাশোনা করে রাখে তাদের তো কষ্টে থাকার কথা নয়। আমাকে তারা সোনার বাংলা করার স্বপ্ন দেখিয়েছে। তারা প্রতিদিন শপথ গ্রহণ করে আমাকে ভালোবাসে বলে অথচ তারপরও কীভাবে তারা পারে আমাকে এ ভাবে কষ্ট দিতে? আমার গর্ব, আমার বিশ্বাস, আমার আশা, আমার ভরসা তারা কি ফিরিয়ে আনতে পারবে না আমার বুকে! আমাকে তারা কি সুশিক্ষিত জাতি গড়ে দিতে সক্ষম হবে না! আমি তো কলঙ্কিনী মা হয়ে বেঁচে থাকতে চাই না! আমি ভালোবাসার সোনার বাংলা হয়ে তাদের মাঝে থাকতে চাই। আমাকে তারা সোনার বাংলা করার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, আমি চাই তা তারা প্রতিটি পদক্ষেপে পালন করুক। তারা ধর্ম, গণতন্ত্র, সমৃদ্ধি, বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত করুক এবং ভণ্ডামি, অনৈতিকতা থেকে বেরিয়ে এসে দেশ ও জাতির খেদমত করতে চেষ্টা করুক। সুশিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে বিশ্বে আমাকে মর্যাদাশীল ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলুক। আমার প্রত্যেকটি সন্তান গর্বের সঙ্গে মনে-প্রাণে ও ধ্যানে বলুক—‘সকল দেশের সেরা সে যে আমার জন্মভূমি’ এমন প্রত্যাশা নিয়ে আমি রইলাম আগামীর পানে।

“সালাম সালাম হাজার সালাম
সকল শহীদ স্মরণে,
আমার হৃদয় রেখে যেতে চাই
তাদের স্মৃতির চরণে...”।