বালারাত সোনার খনি, আধুনিকতায় মোড়া প্রাচীন শহর

বালারাত, ভিক্টোরিয়া অস্ট্রেলিয়ার একটি প্রখ্যাত শহর। এটি সমৃদ্ধ সোনার খনির ইতিহাসের জন্য বিখ্যাত। ১৮৫১ সালে বর্তমান অবস্থান থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে সোনা আবিষ্কৃত হওয়ার পর শহরটি নাটকীয় পরিবর্তন শুরু করে। এ ঘটনা ভিক্টোরিয়ান গোল্ড রাশের সূচনা করে, যা সোনার খনিতে আসা  বিশ্বব্যাপী হাজারো মানুষের আকর্ষণ করেছিল এবং বালারাতকে বিশ্বের অন্যতম ধনী সোনার খনি অঞ্চলে পরিণত করে। প্রচুর মানুষের আগমনে নগরীকরণের দ্রুত উত্তরণ ঘটে; একটি সাধারণ তাঁবুর শহর থেকে বালারাত একটি প্রাণবন্ত শহরে রূপান্তরিত হয়।

এই অঞ্চলের অন্যতম প্রতীকী খনিগুলোর মধ্যে সোভারেন হিল গোল্ডমাইন উল্লেখযোগ্য, যা ১৯৭০ সালে একটি ওপেন-এয়ার মিউজিয়াম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। সোভারেন হিল খুবই পরিপাটি ও নিখুঁতভাবে ১৮৫০-এর দশকের বালারাতের সোনার যুগকে পুনরায় সৃষ্টি করে, যেখানে ওই সময়ের খনির জীবনযাত্রা প্রদর্শিত হয়। সাইটটিতে কস্টিউম পরা চরিত্র, সোনা ধোয়ার কার্যকলাপ এবং ভূগর্ভস্থ খনির পরিদর্শন অন্তর্ভুক্ত, যা একটি সমগ্র ইতিহাসমূলক অভিজ্ঞতা প্রদান করে। রেড হিল মাইন এখানে এক উল্লেখযোগ্য স্থান, যেখানে দ্বিতীয় বৃহত্তম সোনার পিণ্ড ‘ওয়েলকাম নাগেট’ আবিষ্কৃত হয়েছিল।

বালারাত শহরের সোভরেন হিল গোল্ডমাইনে যাওয়ার সুযোগ হলো সম্প্রতি। আগে থেকেই টিকিট কাটা ছিল, তাই ছুটির দিনে গিয়ে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়নি। মেলবোর্ন শহর থেকে প্রায় দেড় ঘণ্টা গাড়ির দূরত্বে বালারাত।

শহরটিতে ঢুকতেই এর পুরোনো ধাঁচের বাড়ির নান্দনিকতা আপনাকে মুগ্ধ করবে। সোভরেন হিলে পৌঁছে নির্ধারিত কাউন্টারে অনলাইনে কাটা টিকিট দেখাতেই তাঁরা তাঁদের একটি টিকিট এবং ভেতরের মানচিত্র হাতে দিয়ে শুভেচ্ছা জানালেন। ঢোকার মুখেই চাইলে আপনি সোনার কয়েনের আদলে তৈরি স্যুভেনির কিনতে পারবেন, প্রতিটা প্রায় ৫০০ টাকা।

ম্যাপ ধরে এগোতেই শুরুতেই পেয়ে যাবেন লিখিতভাবে টাঙিয়ে রাখা ইতিহাসের খণ্ডচিত্র। এরপর ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখবেন বিশাল এক উন্মুক্ত স্থান। হাঁটতে শুরু করলে কিছু তাঁবু ও কুটির দেখা যায়। এখন সেই সময়ের আদলে কুটিরগুলো সাজিয়ে রাখা আছে, যার কিছু থাকার জায়গা, কিছু খাবারের জায়গা। পাশেই সাজিয়ে রাখা আছে খনি থেকে সোনা তোলার কিছু যন্ত্রপাতি। পাশাপাশি দেখতে পাবেন পানি তোলার গভীর নলকূপ, নিরাপত্তার কারণে তা বর্তমানে বন্ধ করা আছে।

পাহাড়ি পথ ধরে একটু এগোলেই দেখা যায় পানির ধারা। সঙ্গে নেমে আসছে ছোট ছোট পাথর ও পলি। আপনি চাইলে এখানে পুরোনো সময়ের মতো টুকরিতে বেলচা দিয়ে পলি মিশ্রিত পাথরকুচি উঠিয়ে পানিতে ধুয়ে স্বর্ণের দানা বা প্রলেপের খোঁজ করতে পারেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, যদি পেয়ে যান তাহলে সেইটা আপনার! অনেকেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা চেষ্টা করেন। কেউ কেউ পেয়েছেন বলেও জানা যায়!

আরও কিছুটা এগোলে পুরোনো সময়ের ব্যাংক, খাবার তৈরি ও বিক্রির দোকান, খনির কার্যক্রম পরিচালনার কর্মক্ষেত্র ও প্রার্থনালয় দেখতে পাওয়া যায়। শহরটাকে যথেষ্ট কার্যকরভাবেই নকশা করা হয়েছিল বোঝা যায়। কিছুক্ষণ পরপর দেখবেন, চারটি ঘোড়ার টানা গাড়িতে পর্যটকেরা স্থানটি ঘুরে দেখছেন। চাইলে আপনিই নির্ধারিত স্থান থেকে উঠে যেতে পারেন।

এখানে সোনার খোঁজ করার পাশাপাশি আরেকটা অন্যতম কার্যক্রম হচ্ছে সোনার খনিতে মাটির বেশ খানিকটা নিচে ঘুরে আসা। সে জন্য অবশ্য আপনাকে নির্ধারিত সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। নির্ধারিত খনিতে ট্যুর গাইড কিছুক্ষণ পরপর দল ধরে ঘুরিয়ে নিয়ে আসেন। খনিতে নেমে আপনার অনুভূতি হবে মিশ্র। আপনি স্বর্ণখনির বিষয়টি দেখে মুগ্ধ হতে পারেন, সেই সময়ে স্বর্ণের সন্ধান পাওয়া শ্রমিকের উল্লাস ভেবে শিহরিত হতে পারেন (এ রকম কিছু স্যুভেনির পাওয়া যায়), আবার খনিশ্রমিকেরা কেমন অবস্থায় কাজ করতেন, ভেবে কষ্টও পেতে পারেন। তবে দর্শনার্থীদের মধ্যে কারও শ্বাসকষ্ট বা বদ্ধ জায়গায় সমস্যা হওয়ার ধাঁচ থাকলে তাঁদের না নামাই ভালো।

বালারাত যাওয়ার এবং ফেরার পথে ব্যতিক্রমী এ শহরের দৃশ্য যেকোনো পর্যটকের মনে অনেক দিন দাগ কেটে থাকবে।

লেখক: সামিউল মাশুক এন্টনি, মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া