এক প্রজন্মের প্রথম আলো

প্রথম আলো
ফাইল ছবি

সবে কৈশোরের স্কুলকে পেছনে ফেলে কলেজে উঠি। নটর ডেম কলেজ। সময়টা ২০০২। একেবারে প্রত্যন্ত এক গ্রামের স্কুল থেকে উঠে আসি। থাকি কলেজের পেছনে আরামবাগের একটা মেসে। এক কক্ষে চারজন। আমাদের সঙ্গে থাকতেন এক বড় ভাই। তিনি অনার্সে কোনো একটা কলেজে পড়তেন। কোন কলেজে পড়তেন, ঠিক মনে নেই আজ। তিনিই মেসের লিডার। একদিন বললেন, আমরা একটা পত্রিকা রাখব। কোনটা রাখা যায়। কোনো কিছু না ভেবেই বললাম প্রথম আলো। পত্রিকা বলতে প্রথম আলোকেই শুধু জানতাম তখন। তার পেছনেও একটা ছোট্ট গল্প আছে।

তখন দশম শ্রেণিতে পড়ি। আমাদের এক শিক্ষক ছিলেন—রাজকুমার হাজারি। তিনি তখন প্রতিদিন কুমিল্লা শহর থেকে স্কুলে যাওয়া-আসা করতেন। শহর থেকে স্যার স্কুলের জন্য প্রথম আলো পত্রিকা নিয়ে আসতেন। মূলত স্যাররাই পড়তেন পত্রিকা। হাজারি স্যার আমার অন্যতম প্রিয় স্যার ছিলেন। তিনি একদিন একটা পাতা দিলেন। দিয়ে বললেন, এটা রাখ। পড়ে জানাবি কেমন লাগল। বাসায় এনে খুলে দেখি এটি মূলত এইচএসসিতে যাঁরা ওই বছর স্ট্যান্ড করেছেন, তাঁদের ফিচার। সঙ্গে আছে তাঁদের পেছনের গল্পও। দারুণ মুগ্ধকর! সেই পাতা যে কতবার পড়েছি, তার হিসাব নেই। সেই থেকে প্রথম আলোর সঙ্গে একটা উষ্ণ সম্পর্কের যাত্রা।

যাহোক, মেসে প্রতিদিন প্রথম আলো আসে। সকাল আটটা থেকে কলেজের ক্লাস শুরু। তাই পত্রিকা পড়ার মোক্ষম সময় দুপুরের খাবারের পর। সব পাতাই পছন্দের ছিল। তবু কেন জানি খুব পছন্দ করতাম কলামের পাতা। অন্যরা যখন খবরের পাতা নিয়ে ব্যস্ত, তখন কলামের পাতাটা নিয়ে এক কোণে চলে যেতাম। খুব প্রিয় কলাম ছিল মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের। আনিসুল হক, এবিএম মূসা আর আবুল মকসুদের কলামও খুব প্রিয় ছিল। এবিএম মূসার একটা কলামের শেষ কয়টি লাইন যেন আজও হৃদয়ে গেঁথে আছে।

১৫ আগস্ট নিয়ে লিখেছিলেন। সুলতানা কামাল আর ছোট্ট শেখ রাসেলকে নিয়ে। প্রতিদিন ভোরে শেখ রাসেল সুলতানা কামালের হাত ধরে বকুল ফুল কুড়াতে বের হতেন ধানমন্ডি লেকের ধারে। যদিও হুবহু মনে নেই, তবু মনে হয় শেষ করেছিলেন এমনই দুটো লাইন দিয়ে—৩২ নম্বরের ওপর সাদা বাড়িটি আজও আছে। বাড়ির সামনে আছে সেই লেকটিও। লেকের ধারে সারি সারি বকুলগাছ। প্রতি ভোরে শিশিরের জল গায়ে মেখে ঝরে পড়ে আজও কত বকুল। শুধু ওই সাদা বাড়িটি থেকে কেউ আর আসে না খালি পায়ে...

কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে উঠেছি। একদিন দেখি গাঙ্গুলি ভবনের তিনতলা থেকে স্কুলের ছেলেমেয়েদের ভিড়। সবার গায়ে গণিত অলিম্পিয়াডের টি-শার্ট। দেখলাম সেই ভিড়ে মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারকেও। তখন তো তিনি ছাত্রদের হিরো। পরদিন দেখি, সেটি কী চমৎকার করে ফিচার হয়ে আসছে প্রথম আলোয়। তখন থেকে খেয়াল রাখতাম কখন গণিত অলিম্পিয়াড হবে।

পাশাপাশি খুব আগ্রহ নিয়ে পড়তাম ইন্টারন্যাশনাল কলেজিয়েট প্রোগ্রামিং কনটেস্ট নিয়ে ফিচার ও লেখাগুলো। কী চমৎকার কলাম লিখতেন গলিত অলিম্পিয়াড ও প্রোগ্রামিং কনটেস্টের সঙ্গে জড়িত বুয়েটের অধ্যাপক কায়কোবাদ স্যার। প্রথম আলোর মুনির হাসান স্যারও দারুণ সব কলাম লিখতেন। পেছন ফিরলে আজ বুঝতে পারি কোলাহলের ভিড়ে শান্ত এক কলেজ, কলেজের সবুজ মাঠ, লাগনো উঁচু দেয়াল, তার পেছনে চলে যাওয়া আরামবাগের সরু পথ। সেই পথের ধারে অসংখ্য ঘিঞ্জি দালান। সেই দালানের কোনো এক কোঠায় জবুথবু বসবাস। এসবের সঙ্গে প্রথম আলো যেন একটা স্মৃতি জমা করে রেখেছে, যার দাম হয়তো বেদনা, না হয় শুকনা হাহাকার!  

একটা সময় বিশ্ববিদ্যালয়জীবন শুরু হয় সিলেটের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখনো নিয়মিত পড়ি প্রথম আলো। কলামের পাতার সঙ্গে প্রিয় হয়ে ওঠে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পাতা। প্রিয় হয়ে ওঠে আলপিন। আলপিনের কার্টুন খুব প্রিয় ছিল। তখন দেশের ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের মিমিক্রি করে কার্টুন আঁকা হতো। কার্টুনের গায়ে একধরনের প্রতিবাদও হতো, কটাক্ষ হতো কত অপশক্তির বিরুদ্ধে। সেই আলপিনের পাতা আজও খুব মিস করি।

তখন সময়টা ২০০৭-০৮। সবকিছুতেই যেন একধরনের নিষেধাজ্ঞা। কেমন যেন ভয় ভয়! প্রথম আলো তখনো লিখেছে মানবাধিকার নিয়ে। তখন মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের একটি কলামের কয়েকটি লাইনের স্পর্শ যেন এখনো পাই।

ছাত্রজীবন ছেড়ে শিক্ষকতাও শুরু করি সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারপর ২০১৮ সালের স্প্রিংয়ে আসি যুক্তরাষ্ট্রের অবার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করতে। ২০১৯ সালের ফল ব্রেকে ঘুরতে যাই টেনিসি স্টেটের স্মোকি মাউন্টেইনে। ফিরে সেই ভ্রমণের গল্প লিখি প্রথম আলোর দূর পরবাসে। পত্রিকায় সেই প্রথম লেখা।

নিজের নাম প্রথম ছাপার অক্ষরে দেখি। সে যে কী অনুভূতি! তারপর ১২ থেকে ১৩টি আর্টিকেল লিখেছি প্রথম আলোয়। লিখতে লিখতে হঠাৎ মনে হলো, আমি তো চাইলে উপন্যাসও লিখতে পারি। কোনো এক গভীর রাতে বিছানা থেকে উঠে লেখাও শুরু করি। দেশভাগের পর এ দেশে থেকে যাওয়া একটি পরিবারের জীবনগল্প। প্রায় ৩০০ পাতার একটা উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি এখন ল্যাপটপে। ভাবি আর অবাক হই, তবে কি প্রথম আলো নিজেকে ঔপন্যাসিকের পথে তাড়া দিচ্ছে। হয়তো (হা হা)। যাক গে, সে উপন্যাসের গল্প নাহয় অন্য দিন হবে।  

সেই স্কুল থেকে কলেজ। কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়। তারপর দূরে নৈঃশব্দ্যের প্রবাস। গোটা এক প্রজন্মের যাত্রা। শৈশব, কৈশোর আর যৌবনের অনেকটা পথ। ভাবি, এ এক প্রজন্মে যে মূল্যবোধ ও দায়, মন ও মনন তৈরিতে প্রথম আলো যেমন করে লেপটে ছিল, তার কি আর মূল্য হয়!  

তবু সময় গড়িয়েছে। যুগ পাল্টেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ও প্রযুক্তির দাপট বেড়েছে। এত কিছুর ভিড়েও প্রথম আলো আজও প্রথম। একটা মান আজও ধরে রেখেছে। তবে অসংখ্য অসত্যের ভিড়ে আগামীর দিনগুলোয় পারবে তো প্রথম আলো সেই সত্যের মান ধরে রাখতে! এ কথা ভাবতেই হয়তো মনে আসল রবীন্দ্রনাথের একটি গানের দুটো লাইন।

‘পাছে আপনারে রাখিতে না পারি, তাই কাছে কাছে থাকি আপনারি!’

প্রিয় প্রথম আলো, তুমি যেন ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে না যাও কখনো। বরং তুমি নিজেই তৈরি করো নতুন এক ভিড়; সেই ভিড়ে আমরা থাকব তোমার সঙ্গে।

লেখক: মো. মনির হোসন, সহকারী অধ্যাপক, ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টি টেকনোলজি, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট এবং ডক্টরাল গবেষক, অবার্ন বিশ্ববিদ্যালয়, আলাবামা, যুক্তরাষ্ট্র।