লন্ডনে সৌধের জীবনানন্দ উৎসব, দর্শকদের উচ্ছ্বসিত প্রতিক্রিয়া

ছবি: লেখক

গত শুক্রবার সৌধ সোসাইটি অব পোয়েট্রি অ্যান্ড ইন্ডিয়ান মিউজিকের আয়োজনে ইস্ট লন্ডনে অনুষ্ঠিত জীবনানন্দ উৎসবকে ‘লন্ডন নগরীতে এক নতুন সাহিত্য-প্রবণতা’ হিসেবে দেখছেন অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া দর্শক ও শিল্পীরা। পঞ্চমবারের মতো আয়োজিত এ উৎসবকে কবি জন ফার্নডন বলছেন, ‘এ এক নতুন অভিজ্ঞতা; বিভিন্ন বর্ণের ও গোত্রের দর্শকদের উপস্থিতিতে বিস্ময়কর সব সাহিত্য পরিবেশনা দিয়ে নতুন সাহিত্য-তরঙ্গ নির্মাণের এক উজ্জ্বল প্রয়াস’। আবার বিবিসি স্লাম চ্যাম্পিয়ন কবি ডেভিড লি মর্গান বলছেন, ‘এক সত্যিকার আন্তর্জাতিকতা-মনস্ক ধ্রুপদি সাহিত্য উৎসব এটি!’ তিনি আরও বলেন, ‘সৌধের এই আন্তর্জাতিক-মনস্কতার কারণে ১০ বছর ধরেই আমি নিজেকে সৌধের একজন হিসেবেই ভেবে আসছি।’ লন্ডনের রিচমিক্স থিয়েটারে হলভর্তি দর্শকেরা তন্ময় হয়ে উপভোগ করেছেন রবীন্দ্রোত্তর বাংলা ভাষার প্রধানতম কবি জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যকর্ম নিয়ে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টার ‘অসামান্য আর বিচিত্র’ সব পরিবেশনা! অনুষ্ঠান শেষে ঘোরগ্রস্ত, মোহাবিষ্ট দর্শকেরা এমনই উচ্ছ্বাস ও মুগ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।

ব্রিটিশ-ফরাসি দর্শক ফ্লোরা নিকলসন বলেন, ‘আমি আক্ষরিক অর্থেই কাঁপছি, বর্ণনা করার সব ভাষা হারিয়ে ফেলছি। গত শতকের একজন কবি আজকের পাঠক ও লেখকদের জন্যও কতটা প্রেরণা বহন করতে পারেন, কতটা শক্তিশালী ও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে পারেন, এ উৎসবে না এলে আমার জানা হতো না। সাড়ে তিন ঘণ্টার এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা নিয়ে ও সৌধের কাজের একনিষ্ঠ অনুরক্ত হয়ে আমি বাড়ি ফিরছি।’

মিসরীয় কবি মোহসেন মহাম্মেদ বলেন, ‘আমি এ উৎসবে প্রথমবারের মতো অংশগ্রহণ করেছি। জীবনানন্দের “হায় চিল” কবিতাটি আরবিতে অনুবাদ করে এখানে পাঠ করেছি। অনুবাদ করতে গিয়েই এই মহান কবির প্রেমে পড়ে গেছি। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জীবনানন্দের নানা রকমের সাহিত্যকর্ম নিয়ে এত হৃদয়স্পর্শী সব মঞ্চায়ন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে প্রত্যক্ষ করেছি। বিশেষ করে বুলগেরিয়ান, পার্শিয়ান, রোমানিয়ান, স্পানিশ ও পোলিশ ভাষায় অনূদিত কবিতার পরিবেশনা এবং উৎসবে শেষের দিকে মঞ্চস্থ দুটি কাব্য-একাঙ্কিকা। কবিতা নিয়ে এমন অপূর্ব থিয়েটারের ধারণা আর এমন স্বর্গীয় কণ্ঠসংগীতের সঙ্গে আমি ইতিপূর্বে কখনো পরিচিত হইনি।’

ছবি: লেখক

ইরানিয়ান কবি, অনুবাদক ও একাডেমিক আলিরেজা আবিজ বলেন, ‘উৎসবে অংশগ্রহণ করতে পেরে আমি অভিভূত ও সম্মানিতবোধ করছি। পার্শিয়ান ভাষায় আমি আরও অনেক বেশি জীবনানন্দ অনুবাদ করতে চাই। সারা বিশ্ব বাঙালি এই কবির অসামান্য সাহিত্যকর্ম নিয়ে জানা উচিত। আমি জানি, সামনের বছরগুলোতে আরও অনেক বেশি ব্রিটিশ-ইরানি দর্শকেরা এতে উপস্থিত থাকবেন। সৌধের হয়ে আজকের এ বার্তা নগরীর দূরতম কোণগুলোয় শিল্পপিপাসুদের কাছে পৌঁছে দিতে চাই।’
লেখক ও লিটলম্যাগ সম্পাদক সোমন্ত মোহান্ত বলেন, ‘এতসংখ্যক অবাঙালি দর্শকদের সামনে এ মাপের বাঙালি–অবাঙালি কবি ও শিল্পীদের নিয়ে শুধু জীবনানন্দের ওপর সাড়ে তিন ঘণ্টার এহেন বিশ্বমানের উদ্যোগ আমার মনে হয় না ভারত উপমহাদেশের কোথাও এ মুহূর্তে কল্পনাও করা যাবে। কলকাতা ও বাংলাদেশেও এ উদ্যোগের খবর পৌঁছে দেওয়া উচিত, সম্ভব হলে ওখানেও এই উৎসব ছড়িয়ে দিতে হবে।’

ব্রিটিশ-বুলগেরিয়ান কবি ও মেধাবী প্রত্নসংগীত গবেষক স্নেজহিনা গুলুবভা বলেন, ‘বুলগেরিয়ান ভাষায় জীবনানন্দের বনলতা সেন অনুবাদ করে যেমন আনন্দ পেয়েছি, প্রিয়বন্ধু কবি আহমেদ কায়সারের সঙ্গে মিলে এই কবিতা হলভর্তি শিল্পরসিক দর্শকদের সামনে উপস্থাপন করে দ্বিগুণ আনন্দ পেয়েছি। অনুষ্ঠান শেষে দর্শকদের অনেকেই আমাদের পরিবেশনা সম্পর্কে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চেয়েছেন, যা আমাকে আপ্লুত করেছে। আমার বেশ কিছু বন্ধু, যাঁরা এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলেন, তাঁদের সবাই কবিতা, সংগীত, নৃত্য ও পোয়েট্রি থিয়েটারের মতো অভিনব শিল্প-প্রকল্প নিয়ে খুব উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন।’

ব্রিটিশ সংগীতশিল্পী জেসিকা ফার্লি বলেন, ‘পুরো সন্ধ্যা আমি অভিভূত ছিলাম কবিতার সঙ্গে বিস্ময়কর গায়নের অর্থপূর্ণ এক মেলবন্ধন আবিষ্কার করে। আমার জন্য এই ধারণা নতুন নয়, তবে পরিবেশনার মাত্রা, প্রকরণ ও মঞ্চায়ন ছিল একেবারেই নতুন। ভারত থেকে আসা ধ্রুপদি সংগীতশিল্পী কোয়েল যতবারই কণ্ঠ দিয়েছেন, আমি রীতিমতো শিউরে উঠেছি গানের নাটকীয়তা ও গভীরতায় হারিয়ে যেতে যেতে।’
ব্রিটেনে দক্ষিণ-এশীয় শিল্পের শীর্ষতম সংস্থা সৌধ সোসাইটি অব পোয়েট্রি অ্যান্ড ইন্ডিয়ান মিউজিকের উদ্যোগে আয়োজিত এ উৎসবে বিভিন্ন ধরনের পরিবেশনায় অংশগ্রহণ করেন বিলাতের প্রথিতযশা বাঙালি ও অবাঙালি কবি, লেখক, তাত্ত্বিক এবং সংগীত, নৃত্য ও অভিনয়শিল্পীরা।

এতে জীবনানন্দের ‘আবার আসিব ফিরে’ কবিতার এক অভিনব সংগীত-ভাষ্য উপস্থাপন করেন কবি, নাট্যকার ও অনুবাদক জন ফার্নডন। জীবনানন্দের কবিতার বুলগেরিয়ান অনুবাদ ও আনুষঙ্গিক আলোচনায় অংশ নেন মেধাবী বুলগেরিয়ান কবি ও প্রত্নসংগীত গবেষক স্নেজহিনা গুলুবভা। স্ব-অনুদিত পার্শিয়ান অনুবাদ পাঠ করবেন বিশিষ্ট ব্রিটিশ-ইরানি কবি আলিরেজা আবিজ এবং আরবি অনুবাদ পাঠ করবেন তরুণ ব্রিটিশ-মিসরীয় কবি মোহাম্মদ মোহসেন।

ছবি: লেখক

আবৃত্তি ও নৃত্য দিয়ে জীবনানন্দের কবিতার হৃদয়স্পর্শী সব উপস্থাপনা মঞ্চায়ন করেন কাউন্সিলর জাসমীন চৌধুরী, কবি তানজনা নূর-ই সিদ্দীক, জাকি রেজওয়ানা আনোয়ার, আবৃত্তিকার পপি শাহনাজ, উর্মি মাজহার, ছান্দসিক প্রতিষ্ঠাতা মুনিরা পারভীন, সৈয়দ আনোয়ার রেজা, প্রপা রেজোয়ানা আনোয়ার, ভারতীয় ধ্রুপদি নৃত্যশিল্পী মনিদীপা শীল, শীতেষ্ণা বোস, শর্মিষ্ঠা পন্ডিত, এষা চক্রবর্তী ভট্টাচার্য ও বাংলাদেশ থেকে আসা মনিরুল ইসলাম মুকুল। ব্রিটেনের বিশিষ্ট শাস্ত্রীয় সংগীতশিল্পী চন্দ্রা চক্রবর্তীর সুরারোপিত জীবনানন্দের কবিতা দিয়ে সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী লাবনী বড়ুয়া এবং নিজের সুর করা ‘শঙ্খমালা’ কবিতার ব্যতিক্রমধর্মী পরিবেশনা উপস্থাপন করেন শিল্পী সুহা প্রিয়দর্শিনী চক্রবর্তী। কবিতার সঙ্গে বিভিন্ন আনুষঙ্গিক রাগসংগীত পরিবেশন করেন ভারত থেকে আসা উস্তাদ রাশিদ খানের সংগীতশিষ্য মেধাবী শাস্ত্রীয় সংগীতশিল্পী কোয়েল ভট্টাচার্য।

উৎসবের শেষের দিকে পরিবেশিত হয় টি এম আহমেদ কায়সার নির্দেশিত জীবনানন্দের ‘হায় চিল!’ ও ‘কুড়ি বছর পর’ কবিতার ওপর নির্মিত অভিনব পোয়েট্রি থিয়েটার। কবি সারওয়ার ই আলম, অভিনেত্রী ও নৃত্যশিল্পী শিউলি ভট্টাচার্য, কবি ও আবৃত্তিশিল্পী তানজিনা নূর-ই সিদ্দিকী, নৃত্যশিল্পী মনিদীপা শীল, সংগঠক জাসমীন চৌধুরীর সঙ্গে নেপথ্যে কণ্ঠসংগীত পরিবেশন করেন কোয়েল ভট্টাচার্য। দর্শকেরা এই দুটি একাঙ্কিকার নতুনত্ব ও উপস্থাপন কৌশল নিয়ে ভূয়সী প্রশংসা করেন।
‘চিত্রশিল্পী সোনিয়া ইয়াসমীনের চিত্রশিল্প ও জীবনানন্দের কবিতা’ শীর্ষক এক অভিনব দৃশ্যপাঠ যৌথভাবে উপস্থাপন করেন বর্ষীয়ান সাংবাদিক কাজী জাওয়াদ ও চিত্রশিল্পী সোনিয়া ইয়াসমীন।

সৌধ পরিচালক টি এম আহমেদ কায়সার বলেন, ‘উৎসব শেষ হয়ে যাওয়ার পর এখনো দর্শক এবং শিল্পী মহল থেকে অব্যাহত প্রশংসা পেয়ে আমরা খুবই অনুপ্রাণিত বোধ করছি। আমরা জানি, রবীন্দ্রনাথের পর যে কবিকে বাংলা বা সর্বভারতীয় কবিতার যথার্থ উদাহরণ, একটা স্বাদ বা আস্বাদ হিসেবে আমরা বিশ্ববাসীর কাছে উপস্থাপন করতে পারি, তিনি জীবনানন্দ দাশ। মাত্র কয়েক বছরে এটি লন্ডনের মূলধারার কবি, লেখক ও শিল্পরসিক দর্শকদের মধ্যে যে ইতিবাচক অভিঘাত তৈরি করেছে, তা আশ্চর্যজনক। এ বছর অনুষ্ঠানের দুই দিন আগেই হলের সব আসন বুকড হয়ে যায়। সামনের বছরগুলোতে এটি আরও বর্ধিত আকারে অন্তত ব্রিটেনের অন্যান্য শহরেও প্রসারের পরিকল্পনা চলছে।’

উৎসবের সার্বিক নেপথ্য-ব্যবস্থাপনায় ছিলেন আলোকচিত্রী পাবলো খালেদ, মেধাবী তবলাবাদক কুন্তল দাস ও কবি সৈয়দ আনোয়ার রেজা।

**দূর পরবাস–এ ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]