২০ বছরেও সিঁড়িটির কাজ সম্পন্ন হলো না
নবগঙ্গা নদীর পাড়ে সিঁড়িবাঁধা একটি ঘাট করার উদ্যোগ নেওয়া হয় বহু বছর আগে। সিঁড়িটি সম্পন্ন না হতেই তা প্রায় ধ্বংস হওয়ার পথে। ঘটনাটি আমার নজরে আনেন এলাকার এক সমাজসেবী। বেশ কিছু সময় চিন্তাভাবনা করে আমার বড় ভাই অধ্যাপক মান্নান মৃধার সঙ্গে আলোচনা করি। তিনি বেশ আগ্রহ প্রকাশ করলেন এ–ই ভেবে যে সেখানে আমাদের অনেকের স্মৃতি জড়িত। ছোটবেলায় সেখানে সাঁতার কেটেছি। সেই খেয়াঘাট দিয়ে জীবনের ছোট–বড় অনেক ভ্রমণ করেছি। ছোটবেলার স্মৃতিগুলো হৃদয়ে বেশ দাগ ফেলেছে। তারপর সেই খেয়াঘাটের পাড়ে ছিল এক বিশাল ফুলগাছ, যেখানে কতই–না সময় কেটেছে।
সরকারি জায়গা হুট করে কিছু করা ঠিক হবে না ভেবে শেষে মাগুরার জেলা প্রসাশককে চিঠি লিখি। তিনি বেশ আগ্রহের সঙ্গে বাকি কাজ সম্পন্ন করবেন বলে জানান। দিনকাল এবং একটি সময় ঠিক করে কাজটিতে হাত দেবেন—এমন এক সময় জেলা প্রশাসক বদলি হয়ে যান। নতুন করে পুরোনো কাহিনি তুলে ধরি সদ্য আগত জেলা প্রশাসককে। তিনি আমার সঙ্গে কথা বললেন, ঘটনাটি শুনলেন এবং এ–ও বললেন, আমি যেন স্থানীয় কাউকে দায়িত্ব অর্পণ করে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলি। আমি এলাকার সেই সমাজসেবীকে ডিসির সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য বলি। সমাজসেবীর সঙ্গে দেখা ও কথা হয় মাগুরার জেলা প্রশাসকের। তারপর কয়েক মাস হয়ে গেল, কিন্তু সিঁড়ি মেরামত কাজের কিছু হয়নি।
আমি পরে স্থানীয় সংসদ সদস্যকে ফোন করে বিষয়টি অবগত করি। তিনি কথা দিয়েছিলেন বিষয়টি দেখবেন, কিন্তু কিছুই করেননি। বলা বাহুল্য, তিনি এলাকার তিনবারের সংসদ সদস্য এবং এবারও নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করছেন। আমি তাঁকে আবারও নতুন করে একটি নোট লিখেছি, ‘দাদা, আমাদের নবগঙ্গা নদীর পাড়ে যে ঘাটের কাজ শেষ করার জন্য আপনাকে বলেছিলাম, সে ব্যাপারে কি কিছু করতে সময় পেয়েছেন! কাজটি কি তাহলে শুরু করাও যাবে, নাকি আপনার অন্য কোনো পরিকল্পনা রয়েছে? কাজটি শুরু এবং শেষ করার জন্য আপনাকে অনুরোধ করেছি বেশ কিছুদিন আগে, অথচ আপনি একটু সময় করে যেতেও পারলেন না! অনেক দিন হয়ে গেল কিছুই জানতে পারলাম না, পারলে একটু জানাবেন প্লিজ।’
শীতের সময়ই কাজটি শেষ করার জন্য অনুরোধ করেছিলাম; কারণ, বর্ষা শুরু হলে নদী পানিতে ভরে যাবে। তখন কাজটি স্বল্প খরচে করা সম্ভব হবে না। নানাভাবে চেষ্টা করে কোনো উপায় না পেয়ে এলাকার দায়িত্বশীল সংসদ সদস্যকে ফোন করি এবং তাঁকে বিষয়টি অবগত করি। একই সঙ্গে ডিসিকে লেখা আমার চিঠিখানা এবং ঘাটের সিঁড়িসহ কিছু অসমাপ্ত কাজের ছবি সংসদ সদস্যকে পাঠাই।
এখন অপেক্ষার পালা, দেখি এই সামান্য কাজ কখন কীভাবে সম্পন্ন হয় বা হয়তো সম্পন্ন না–ও হতে পারে। সম্পন্ন হোক আর না হোক, সেটা পরে নিশ্চিত করে লিখব, তবে যে কারণে আমি ঘটনাটি তুলে ধরছি, সেটা হলো বিশ্বের পরিকাঠামো এবং তার ব্যবস্থাপনা কোথায়, কীভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়, তার ওপর আলোকপাত করা। আমি দুটি জায়গার ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে কিছু তথ্য তুলে ধরব।
একটি শিল্পকারখানা, অন্যটি সুইডেনের। এই দুটি জায়গার কাজের ধরন কী রকম এবং বিষয়টি কীভাবে শিক্ষণীয় হতে পারে, সেটা নিয়ে আমি লিখব।
আমি যে শিল্পকারখানার মধ্য দিয়ে বড় হয়েছি সেটা হলো ফাইজার ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি। সেখানে কাজ করেছি। মূলত আমরা যে যেখানে বা যে ধরনের কাজ করি না কেন, সমস্যার ধরনগুলো এক রকমই। কারণ, একটি সমস্যার পেছনে নানা ধরনের জটিলতা জড়িত থাকে, যেমন দায়িত্ব, অর্থ, মধ্যস্থতা, জনশক্তি, সময় এবং সর্বোপরি ফলোআপ। সমস্যা ছাড়া একটি ইন্ডাস্ট্রি, একটি দেশ, একটি প্রতিষ্ঠান বা একটি পরিবার হতে পারে না এবং ভালো ব্যবস্থাপনা ছাড়া সেগুলো সুন্দরভাবে গড়ে উঠতে পারে না।
সে ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনার কাজই হচ্ছে কী, কখন, কে, কেন, কীভাবে ইত্যাদি সম্পর্কে অবগত থাকা এবং থাকতে হবে তার শতভাগ দায়বদ্ধতার সঙ্গে জবাবদিহি। ব্যবস্থাপনায় যদি এর একটা বাদ পড়ে যায়, তখনই চ্যুতি বা ডেভিয়েশন দেখা দেয়। শিল্পকারখানায় এসব কাজ খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহি না থাকায় কর্মের প্রতিফলন ঘটাতে ব্যর্থ হয়।
একটি দেশ বা একটি শিল্পকারখানা যখন সঠিকভাবে পরিচালিত না হয়, তখন ধরে নিতে হবে চালক ব্যর্থ এবং তাকে সরাতে বা সারতে হবে আগে। আমার ওপরের অসম্পূর্ণ সিঁড়িঘাট কেন এত বছরেও সম্পন্ন হয়নি? এ প্রশ্নের জবাব নেই, নেই দায়বদ্ধতা, নেই জবাবদিহি অথচ রাষ্ট্র ঠিকই বেতনভুক্ত কর্মচারীদের বেতনসহ সব সুযোগ-সুবিধা দিয়ে চলেছে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। আজ যদি সঠিক ফলোআপ হতো, তাহলে সিঁড়িঘাটটি অনেক আগে থেকেই ব্যবহারের যোগ্য হতে পারত, কিন্তু সে সিঁড়ি দাঁড়িয়ে আছে দুর্নীতি আর অনীতির সাক্ষী হয়ে।
কোথাও কেউ নেই যে বিষয়টি নিয়ে ভাবছে বা কিছু করার জন্য চেষ্টা করছে! সুইডেনে এমন একটি ঘটনা দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করত, জবাবদিহি থেকে শুরু করে সবকিছু তদন্ত করা হতো। শেষে কাজটি সম্পন্ন হতো। যেখানে সত্যিকার গণতন্ত্রের বেস্ট প্র্যাকটিসের অভাব এবং দুর্নীতিতে ভরপুর, সেখানেই এ ধরনের ডেভিয়েশন লক্ষণীয়। সুইডেনের রাজনীতিতে এ ধরনের গাফিলতি হয়, তবে সঠিক জবাবদিহি না দেখাতে পারলে ব্যক্তির চাকরি থাকে না। ইন্ডাস্ট্রির ক্ষেত্রে আরও কড়া নজরদারি মেনে চলা হয়।
বাংলাদেশ যে এর বাইরে, তা নয়। পার্থক্য শুধু একটা, সেটা হলো, দুর্নীতি এখানে বড় আকারে কাজ করে, ফলে অনেক কিছুই চাপা পড়ে যায়। তা ছাড়া দেশভরা নেতা আছেন, কিন্তু নেতার অনুসারী নেই। নেতা তাঁর মনুষ্যত্ব, লজ্জাশরম ও বিশ্বস্ততা হারিয়েছেন।
আমাদের ম্যানেজমেন্টের প্রশিক্ষণের ধরনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন। বন্ধ করুন মুখস্থধারী তোতাপাখি নিয়োগ প্রক্রিয়া, চালু করুন রাইট ফার্স্ট টাইম, রাইট ফর্ম মি, অন দ্য জব ট্রেনিং কনসেপ্ট। বিসিএস পাস করে দেশের দায়ভার নিলে দেশকে সোনার বাংলা করা যে সম্ভব নয়, তার প্রমাণ ৫২ বছরই যথেষ্ট। রাষ্ট্রের সব বিসিএসধারী যন্ত্রের অতিসত্বর অবসান ঘটিয়ে তাঁদের চাহিদাভিত্তিক প্রশিক্ষণ দিতে হবে, একই সঙ্গে জনগণের প্রতিনিধিদের কাজ করার সুযোগ দিতে হবে।
টিকিট কেনার অর্থ থাকলেই কিন্তু দেশ ভ্রমণ করা যায় না, দরকার হয় ভিসার। বাংলাদেশকে সঠিক পথে চালিত করতে শুধু টিকিট কেনার অর্থ থাকলেই হবে না বা টিকিট দিলেই হবে না, দেখতে হবে দেশ চালানোর যোগ্যতা আছে কি না। কেস স্টাডি করুন! ওপরের অসমাপ্ত সিঁড়িঘাটই যথেষ্ট একটি কেস স্টাডির জন্য। একই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোয় ‘রাইট পারসন রাইট প্লেস কনসেপ্ট’ ব্যবহার করুন, অর্থ বিনিয়োগ ছাড়া, দেখবেন দেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাবে।
সঠিক শিক্ষা শেষে যখন সিভিল প্রশাসন কাজে যোগদান করবে, তখন তারা সুষ্ঠুভাবে এ ধরনের কাজ পরিচালনা করতে সক্ষম হবে, একই সঙ্গে ফলোআপ করা শিখবে। সামান্য একটি ঘাটের সিঁড়ি এত বছরেও সম্পন্ন হয়নি, কিন্তু কে এর জন্য দায়ী এবং কার জবাবদিহি বাদ পড়েছে? কে টাকা মেরেছে ইত্যাদি বিষয় যদি মনিটর না করা হয়, তবে এমনটি সমস্যা নিয়ে আমাদের বেঁচে থাকতে হবে। কিন্তু যদি দেশ সঠিকভাবে পরিচালিত হয়, তাহলে এ ধরনের অপ্রত্যাশিত ঘটনা চিরজীবনের জন্য বিদায় নেবে দেশ থেকে।
একই সঙ্গে দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা সতর্ক হবেন এবং তাঁরা জানবেন কত ধানে কত চাল। দুঃখের বিষয়, স্বাধীনতার ৫৩ বছর চলছে এখন, সঠিক ম্যানেজমেন্ট তথা দেশের অবকাঠামো গঠন করা হয়নি। প্রশ্ন জাতির কাছে, কবে সম্ভব হবে এই ছোট্ট কাজ সঠিকভাবে পরিচালনা করা?