নীল সাগরের দ্বীপ: মিয়োর্কায় কয়েক দিন-২
পরের দিন সূর্যোদয় দেখতে অন্ধকার থাকতেই আমি আর খালেদা সৈকতে এলাম। মিষ্টি ভাবি ও রাজন ভাইদের আসার কথা থাকলেও ঘুমের কাছে পরাজিত। সৈকতে আমরা ছাড়া আরও কয়েকজনকে পাওয়া গেল। যাক, সৈকত পুরো ফাঁকা থাকলে ভয় লাগত। দূরে কয়েকজনকে এই ভোরে সমুদ্রের ঢেউয়ে গা এলিয়ে দিতে দেখলাম। এদের কি শীত লাগে না! আস্তে আস্তে পুবের আকাশ লাল হতে হতে সুয্যি মামাকে দেখা গেল। লাল আলো সৈকতে পড়ে অপূর্ব মায়াবী এক পরিবেশ তৈরি করেছে। খালেদা শাড়ি পরে এসেছে। হোটেলের সামনেই সৈকত, তাই এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় না। বিয়ের পর আমরা বাংলাদেশের সেন্ট মার্টিন দ্বীপে সৈকতের পাশে ব্লু মেরিন হোটেলে ছিলাম। ভোরে সেন্ট মার্টিনের বিখ্যাত সূর্যোদয় দেখেছিলাম। কাকতালীয়ভাবে আজও ওর পরনে কমলা রঙের শাড়ি। মধ্যে ১৫ বছর যে কীভাবে দেখতে দেখতে কেটে গেল!
হাঁটতে হাঁটতে পাশের আরেক সৈকতে চলে এলাম, দেখা হলো আন্দ্রেজের সঙ্গে। অনেকক্ষণ ধরে ওকে এই ভোরে সাঁতার কাটতে দেখছিলাম। দূর থেকে ওর কিছু ছবিও তুলেছিলাম। তাই সৈকতে যখন দেখা হলো, কথা বললাম। জানাল, জার্মান নাগরিক হলেও ছয় মাস এই দ্বীপে থাকে আর সমুদ্রে সাঁতারকাটা ওর শখ। ঠান্ডা লাগে না? জিজ্ঞেস করত জানাল, একবার পানিতে নেমে গেলে আর কোনো ঠান্ডা লাগে না।
রুমে ফিরে তাড়াতাড়ি আমরা রেডি হয়ে গেলাম। আজ আমাদের মিয়োর্কার রাজধানী পালমা দেখার পালা। হোটেলের পাশেই বাসস্টপ। বাসে এক ঘণ্টার জার্নি। স্পেনের পাবলিক বাস সার্ভিস ইংল্যান্ডের চেয়ে ভালো ও সাশ্রয়ী। টিকিট কাটার ঝামেলা নেই। ব্যাংক কার্ড টাচ করে উঠে পড়ো, নামার সময় টাচ করলে দূরত্ব অনুযায়ী টাকা কেটে নেবে। আমরা বাসস্টপে পৌঁছে দেখি, আমাদের বিশাল বহরের সবাই আগেই বাসস্টপে। বাসে কিছুদূর পরই টেনিস প্লেয়ার রাফায়েল নাদালের একাডেমি এল। রাফায়েল নাদালের জন্ম এই দ্বীপে। তাই নিজ দ্বীপে তাঁর নামে বিশাল একাডেমি। রাফায়েলভক্ত মোবাশ্বের ভাই আগেরবার ঘুরে এসেছেন এই একাডেমি। বাস থেকে কয়েকটি প্যাটেল শট নিয়েই আমাদের প্রশান্তি।
পালমার মেইন বাসস্টপটি বিশাল এক আন্ডারগ্রাউন্ড বাসস্টপ। এখান থেকে দ্বীপের যেকোনো অংশে বাসে করে যাওয়া যায়, শুধু জেনে নিতে হবে কত নম্বর বাসে চড়তে হবে।
বাসস্টপ থেকে আমরা সবাই রওনা হলাম ক্যাথেড্রাল অব মিয়োর্কার উদ্দেশে। ১৫ মিনিটের হাঁটা আমাদের বাসস্টপ থেকে। ক্যাথেড্রালটি ৯০০ শতাব্দীতে ছিল একটি মসজিদ, যখন স্পেনের এই অংশ মুসলিম শাসিত ছিল। কালের পরিক্রমায় ১২০০ সালের দিকে যখন খ্রিষ্টীয় শাসন শুরু হয়, তখন মসজিদের মূল ভবন রেখে বিশাল এই ক্যাথেড্রাল নির্মিত হয়। আর তাই সাধারণত ক্যাথেড্রালগুলোর ক্রস যেখানে জেরুজালেমের দিকে মুখ করা থাকে, সেখানে এই ক্যাথেড্রাল মক্কায় কাবার দিকে মুখ করে স্থাপিত।
আজ অসাধারণ রোদ্রৌজ্জ্বল এক দিন। নীল আকাশ যেন আরও নীল। ক্যাথেড্রালটির বিশালতা আর আকাশের ব্যাপ্তি যেন একে অন্যকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। ক্যাথেড্রালের পাশেই ফুটপাতে ডিজাইনার ব্যাগ, সানগ্লাসসহ অনেক স্যুভিনরের পসরা সাজিয়ে বসে আছেন দোকানিরা। সাবরিনা ভাবি দরদাম করে কেনাকাটায় মজা পেয়ে গিয়েছেন। ক্যাথেড্রালের সামনে আমরা সবাই একটি গ্রুপ ছবি তুললাম। তারপর ঠিক হলো যে আমরা যে যার মতো ঘোরাঘুরি আর কেনাকাটা করে ৬টায় বাসস্টপে ফিরে যাব।
ক্যাথেড্রালের পাশে ছোটদের সুন্দর খেলার জায়গা। ছোটদের বাদ দিয়ে তাতে নেহাল ভাইকে ওখানে দোল খেতে দেখা গেল। সোনিয়া ভাবির ডাকেও তার ওখান থেকে ওঠার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। একটার পর একটা দোলনায় দোল খাচ্ছেন। ওই দিকে তিতাস ভাই একের পর এক ভিডিও ক্লিপ নিয়ে যাচ্ছেন। তবে রেশমি ভাবির ক্লিপই যে বেশি, তা বলা বাহুল্য। আশা করা যায়, আমরা একটি অসাধারণ সিনেম্যাটিক ভ্রমণ ডায়েরি পাব তার কাছ থেকে। এলোমেলো ঘোরাঘুরির পর আমরা ফিরতি বাসের জন্য পা বাড়ালাম।
আনন্দময় সময়গুলো দ্রুত ফুরিয়ে যায়। আগামীকাল আমাদের ইংল্যান্ডে ফেরার ফ্লাইট। মিয়োর্কায় আমাদের শেষ রাতটাকে হৃদয়ে গেঁথে রাখতে আমরা ঠিক করলাম, রাতে কালা মরলামডার সৈকতে পূর্ণিমার চাঁদ দেখতে যাব। হোটেল থেকে ২০ মিনিটের হাঁটা পথ—পথঘাট এত দিনে চেনা হয়ে গেছে। সারি সারি দোতলা বাড়ির মাঝ দিয়ে গল্প করতে করতে হাঁটছি। নব্বইয়ের দশকের উত্তরা যেন ফিরে এল মনে—ছিমছাম ডুপ্লেক্স বাড়ি, ছোট্ট বাগান। আমাদের সর্বনাশা লোভের কারণে সেই উত্তরা এখন ইতিহাস।
সিঁড়ি বেয়ে নামলাম পাথুরে সৈকতে। দূরে চাঁদ তার রুপালি আলো ঢেলে দিচ্ছে সমুদ্রের বুকে—পানির ঢেউয়ে চিকচিক করে উঠছে আলো। ইংল্যান্ডের ব্যস্ত জীবন থেকে কুড়িয়ে নেওয়া চার দিন, প্রিয় মানুষের সঙ্গ আর প্রকৃতির এত কাছে আসার সুযোগ—জীবনের ব্যস্ততার মধ্যে যেন এক স্বপ্নপুরী। মিয়োর্কা, তোমার নীল সমুদ্র আর নির্মল বাতাসে মন হারিয়েছি। হয়তো একদিন আবার ফিরে আসব তোমার নীল সমুদ্রে গা ভাসাতে। সে পর্যন্ত এই স্মৃতি হৃদয়ে রেখে, বিদায়। (সমাপ্ত)