হ্যালিফ্যাক্সের কাচের রাস্তায়
হাঁটতে বহু চেষ্টা করছেন, কিন্তু পারছেন না! বারবার হড়কে যাচ্ছেন! পিচের রাস্তার ওপরে কাচের পুরু আস্তরণ বিছিয়ে দিয়েছে প্রকৃতি। মাইলের পর মাইল হাঁটার রাস্তা খালি পড়ে রয়েছে আর হাঁটতে হচ্ছে বাস, গাড়ি চলাচলের রাস্তায়। কীভাবে হাঁটবেন?
উপায় আছে, জুতার নিচে স্কেটিং ব্লেড লাগিয়ে নিন, তারপর দিব্যি স্কেটিং করতে করতে গন্তব্যে পৌঁছে যান। কিছুটা অবাস্তব ধারণা মনে হচ্ছে, তাই না?
এ ছাড়া আর উপায় কী বলুন?
সাড়ে ছয় বছরের কানাডার জীবনে এমন অদ্ভুতুড়ে পরিস্থিতির মুখোমুখি আমিই কেন, কানাডিয়ানরাই হননি!
এবারের শীতে যেটা হয়েছে, বরফের সাদা আস্তরণের নিচে পুরু শক্ত একটা আস্তরণ পড়েছে, যা এত বছরে আমি একদমই দেখিনি, তা নয়।
ব্ল্যাক আইস!
নাম না শুনে থাকলে আজ জানুন।
মূলত বরফ গলে যাওয়ার পর বা বৃষ্টির পর পানির যে হালকা আস্তরণ রাস্তায় জমা হয়, সেটার আশপাশের বায়ু যখন ঋণাত্মক সূচকে পৌঁছে যায়, তখন তা জমাট বেঁধে এমন স্বচ্ছ কাচের মতো আকার ধারণ করে। মূল সমস্যা হচ্ছে, খালি চোখে যেমন শুভ্র বরফ সহজেই দৃশ্যমান হয়, তেমনি এই ব্ল্যাক আইস দৃশ্যমান হয় না। প্রধানত ড্রাইভিংয়ের সময়। এ ক্ষেত্রে বিশেষ ধরনের টায়ারের শরণাপন্ন হওয়া বুদ্ধিমানের কাজ। আর কখনোই এমন রাস্তায় সজোরে ব্রেক কষতে হয় না। গাড়ি ভীষণ ধীরগতিতে চালিয়ে নিতে হয়।
কিন্তু আপনি যখন পথচারী, তখন কী করবেন?
ব্ল্যাক আইসের এমন রূপ একদম দেখিনি, তা নয়।
দেখেছি কিন্তু একটু–আধটু। দুটি শহরেই—কেপ ব্রেটনের সিডনি আর হ্যালিফ্যাক্সের কিছু কিছু জায়গায়। তবে এ বছরের মতো এত ভয়ানক আর বিশাল অবয়বে এর আগে ইতিপূর্বে তাকে দেখা যায়নি।
টিকটকে একটা ভিডিও বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, যেখানে দেখা যায়, আবহ গীতে কানাডার জাতীয় সংগীত শোনা যাচ্ছে আর এক মধ্যবয়সী গোছের যুবক পিচঢালা কাচের রাস্তায় দিব্যি স্কেটিং করতে করতে মনের আনন্দে এগিয়ে চলেছে।
অফিসে গিয়ে সহকর্মীদের মুখেও কাচের রাস্তায় কীভাবে চলাফেরা করবে, সেই গালগল্প চলছে। আমাদের জেনারেল সার্ভিস ম্যানেজার স্টেসিকে দেখলাম জুতার নিচে স্নো গ্রিপ লাগিয়ে নিয়েছে। আমাকেও বলল পরে নিতে। ওর বাসার সামনে পার্কিং প্লেস থেকে মূল ঘরের পথ বেশ প্রশস্ত আর পুরো জায়গাজুড়েই ব্ল্যাক আইসের আস্তরণ জমে আছে। ও জানাল এত দিন এমন হতে কখনো দেখেনি। আমাকেও এক জোড়া কিনে নিতে বলল।
অফিসে এক ক্লায়েন্ট আসেন। ভদ্রমহিলা ইমার্জেন্সি ডিপার্টমেন্টে চাকরি করতেন। জানালেন, তাঁর কাজের অভিজ্ঞতার কথা। ওনার এভাবে উল্টাপাল্টা চিতপটাং হয়ে পড়ে মাথা চূর্ণবিচূর্ণ হওয়ার অভিজ্ঞতা দেখা হয়েছে অনেক। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ওই দিন অফিসে স্টেসি চলে যাওয়ার পরপরই ভদ্রমহিলা এলেন। তিনিও লবিতে প্রবেশ করেই চেয়ারে বসে জুতার নিচে লাগানো স্নো গ্রিপ খুললেন। এরপর ভেতরে প্রবেশ করার সময় আমাকে নিজের বাস্তব জীবনের কিছু ঘটনা বললেন।
এর আগের দিন সকালেই প্রতিদিনের মতো আমি গটিংজেন স্ট্রিটে পরবর্তী বাসে উঠব বলে প্রথম বাস থেকে নেমেছি। তবে আজকের মতো সকাল কখনো দেখিনি। রাস্তায় মনে হচ্ছে কেউ এসে কাচ বিছিয়ে দিয়ে গেছে। সাদা বরফের রাস্তার ওপর কাচের মতো ব্ল্যাক আইসের আস্তরণে ঢাকা পড়ে আছে পুরো পথচারী পারাপারের রাস্তা। অর্ধেকের বেশি গটিংজেনের রাস্তাজুড়েই এ দৃশ্য চোখে পড়ল। এ জায়গায় আমি দুই বছর আগে প্রায় প্রতিদিনই জবে আসতাম। কখনো এমন কিম্ভূতকিমাকার পরিস্থিতি দেখিনি। রাস্তায় তখন খুব একটা কাউকে দেখছি না। মনে হচ্ছে সবাই ব্ল্যাক আইসের ভয়ে ঘরবন্দী হয়ে আছেন। কয়েকজন আমার সঙ্গে ছিলেন, তাঁরাও আমার মতো গুটিগুটি পায়ে চলতে লাগলেন। আমি পথচারীদের রাস্তা ছেড়ে মেইন রোডে হাঁটছি। সব গাড়ি আমার রাস্তা ছেড়ে দিয়ে পাশ ঘেঁষে চলছে, এমনকি বাসও। সবাই জানে পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ। ওদিকে হাঁটতে যাওয়া আর যমের বাড়ির পথে যাওয়া একই অবস্থার শামিল!
অনেক সামলে নিয়ে, কয়েকবার হড়কে গিয়ে বেঁচে গেছি। কীভাবে তা জানি না! যেখান থেকে বাসে চড়ব ওই জায়গাও একদম পিচ্ছিল প্রকৃতির, ওপরে হালকা বরফের আস্তরণ জমেছে আর নিচেই আছে ভয়ালদর্শন কালো বরফ!
অবশেষে বাস এল। ওতে চড়ে কিছুটা মহাবিদিশার অবস্থা থেকে গতি ফিরে পেলাম। এরপর বাস থেকে নেমেও একই দশা! বেশ সাবধানে যেসব জায়গায় সাদাটে বরফের গুঁড়া চোখে পড়ছে সেই জায়গায় খুব সাবধানে পা ফেলে এগিয়ে চলেছি। শুধু ভাবছি, কবে যে এই ভয়ালদর্শন বরফের হাত থেকে রেহাই পাব?
সবচেয়ে বেশি মজার ব্যাপার হলো, বাসার সামনেই রাস্তাটাই সবচেয়ে ভয়াবহ। কারণ, এতক্ষণ যা দেখে এসেছি ওখানে বরফের সাদা আস্তরণ ছিল বা রাস্তা এড়িয়ে চলার পথ ছিল। এখানে তো নেই! একটাই রাস্তা আর পুরোটাই ব্ল্যাক আইসের আস্তরণে মোড়ানো। আমি অতি সন্তর্পণে একটু বেশি সময় নিয়ে যেসব জায়গায় বরফের খাঁজ দেখছি, সেখানে পা দিয়ে চলেছি। খুবই ধীরগতিতে, অল্প কিছু হলেই কিন্তু পা হড়কে যাবে! বাড়িওয়ালিকে ডেকে আচ্ছা করে বকা দিতে ইচ্ছা করছে! নিজে তো ভেতরে কফির মগ হাতে বসে আরাম কেদারায় বসে আছে। আর এদিকে আমরা বরফের ভয়ালদর্শন পথের যাত্রী হয়ে পথ চলছি! কোনোমতে ওভাবেই পার হয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লাম ওই দিনের মতো।
এখন আগামী দিনের চিন্তা!
কী হবে কে জানে?
ব্ল্যাক আইসের হাত থেকে বাঁচার পথ হচ্ছে, লবণ প্রয়োগ করা, যা মিউনিসিপ্যালিটির গাড়ি থেকে ছিটানো হয়। তবে সব জায়গায় ছিটানো সম্ভব হয় না। আর দ্বিতীয়ত, বিশেষ ধরনের জুতা পরিধান করা। তৃতীয়ত, পারতপক্ষে ওই রাস্তা এড়িয়ে চলা।