‘ইরান-খোমেনির ইসলামি বিপ্লব ও তারপর’—বইটি কেন পড়া জরুরী

ইরানের ইসলামী বিপ্লবের নিয়ে বদরুল আলম খানের লেখা একটি বই ‘ইরান-খোমেনির ইসলামি বিপ্লব ও তারপর’। আধুনিক পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবারের মত ধর্মীয় আধ্যাত্মিকতাকে ব্যবহার করে কিভাবে এই রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল সম্ভব হল, এ প্রশ্নের গভীর পুঙ্খানুপুঙ্খু বিশ্লেষণ আছে এই বইয়ে। ১৯৭৯ সালের ১৬ জানুয়ারি ৩৮ বছরেরও বেশি সময় ধরে দোর্দন্ড প্রতাপে শাসন করার পর ইরানের প্রধানমন্ত্রী রেজা শাহ পাহলভি দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হন। শাহের বিদায়ের ১৪ দিন পর ৭৬ বছর বয়সী ধর্মীয় নেতা আয়াতোল্লাহ খোমেনি দীর্ঘ ১৫ বছর নির্বাসন জীবন কাটিয়ে ইরানে ফিরে আসেন। সেই থেকে ইসলামিক ইরানের যাত্রা শুরু হয়।

লেখক কেবল ক্ষমতা দখল পর্যন্তই থেমে থাকেন নি, ইরানের পরবর্তীকালীন সামাজিক নানা দ্বন্দ্ব সংঘাত ও বিভিন্ন রাজনৈতিক সমীকরণ নিয়েও বিশদ আলোচনা করেছেন। ফলে বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এই বিপ্লবের প্রভাব কি ছিল, পাঠক তার তুলনামূলক বিশ্লেষণের সুযোগ পাবেন। বিপ্লবের শুরুর দিকে ইরান কেন এগিয়ে গেল, এর পেছনে লেখক চারটি প্রধান কারণ চিহ্নিত করেছেন।

প্রথমত, পশ্চিমা বিশ্বের অনুকরনে ১৯৬৩ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত শাহের নেওয়া দ্রুত আধুনিকায়ন কর্মসূচি ইরানের ধর্মীয় ঐতিহ্যভিত্তিক জীবন ধারাকে ব্যাহত করে।

দ্বিতীয়ত, রেজা শাহ মুসলিম বিশ্বের বন্ধু নয় এমন দুই দেশ- যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। ১৯৬৭ সালের মিশর-ইসরাইল যুদ্ধের পর সমগ্র মুসলিম বিশ্ব ইসরাইলকে বর্জন করলেও তিনি ইসরাইলে তেল রপ্তানি অব্যাহত রাখেন। শাহের এই নীতি ইরানের জনগন গোলামির সম্পর্ক বলে চিহ্নিত করেছিল।

তৃতীয়ত, তিনি ইসলাম ধর্মের প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করেছিলেন। রেজা শাহ প্রাক ইসলামী ইরানের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাসকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন যা ইরানি জনগনের কাছে ধর্মের অবমাননা বলে মনে হয়েছিল। ১৯৭১ সালে শাহ নতুন ইরানি ক্যালেন্ডার প্রবর্তন করেন। হিজরি ৬২২ খ্রিস্টাব্দ থেকে শুরু না করে সেই ক্যালেন্ডার শুরু হয়েছিল খৃষ্টপূর্ব ৫২০ সাল থেকে যা প্রাক ইসলামী শাসক সাইরাসের কাল বলে পরিচিত।

চতুর্থত, গণতান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ, অত্যাচার, নিপীড়ন এবং নির্যাতন চালিয়ে তিনি তাদের প্রতিবাদকে স্তব্ধ করতে চেয়েছিলেন। সেটি তার শাসনের জন্য হিতে বিপরীত হয়ে দেখা দিয়েছিল। ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ, আমেরিকার সিআইএ ও এফবিআই–এর সহায়তায় রাজতন্ত্র বিরোধী যে কোনো বিরুদ্ধ মতকে দমনের জন্য ‘সাভাক’ নামের দুর্ধর্ষ, নিষ্ঠুর পুলিশ বাহিনী গঠন করেন।

ইমাম খোমেনি কার্যতই ইরানের অনৈতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ও জনগণের দুর্দশার জন্য সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোকে অভিযুক্ত করেন। এমন কি তিনি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও সোভিয়েত রাশিয়াকে ‘দুই শয়তান’ বলে অভিযুক্ত করেন। এর বিপরীতে ইসলামী মূল্যবোধ ও আদর্শকে ইরানের ইপ্সিত লক্ষ্য বলে বিবেচনা করেন। ‘রেজা শাহের বিরুদ্ধে আলেম-ওলামাদের ওপর নির্যাতন চালানো, ইসলামী সংস্কৃতি ধ্বংস ও বিদেশী শক্তির কাছে আত্মসমর্পণের অভিযোগ আনেন খোমেনি’ (পৃঃ৭৩)। শাহকে ইয়াজিদের সাথে তুলনা করে তাকে ইরানের শত্রু বলে ঘোষণা করেন। কোরআন ও হাদিসের আলোকে দেশ শাসনের দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন ।

১৯৭৯ সালে খোমেনির নেতৃত্বে ইরানে ইসলামিক বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর পাল্টে গেছে পুরো মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি। ইরান এক প্রধান শক্তি ও অন্যতম রাজনৈতিক খেলোয়াড় হিসেবে সেখানে আবির্ভূত হয়েছে। ইরানের নিজের ভেতরেও রক্ষণশীল ও উদারপন্থী আলেম-ওলামাদের মধ্যে রয়েছে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব-সংঘাত। এসবকে বিবেচনায় নিয়েই বদরুল আলম খান তার গন্থ-আলোচনাকে সম্প্রসারিত করেছেন।

মোট পাঁচটি অধ্যায়ে ২০৮ পৃষ্ঠার এই বই আমাদের অনেক প্রশ্নের উত্তর দিয়ে চিন্তার জগতকে যে ঋদ্ধ ও আলোড়িত করবে তাতে কোন সন্দেহ নাই। ইরানের এই বিপ্লবের পেছনে চিন্তাশীল বুদ্ধিজীবীর অবদান, তাদের আত্মত্যাগের বর্ণনা সুন্দর করে লেখক লিপিবদ্ধ করেছেন।

এ বই লিখতে গিয়ে লেখককে প্রচুর পড়তে হয়েছে, ঘাটতে হয়েছে অসংখ্য বই, জার্নাল, পত্র-পত্রিকা। দিতে হয়েছে অযুত সময়। সেজন্য লেখক নির্দ্বিধায় ধন্যবাদ পেতে পারেন। প্রকাশনী হিসেবে প্রথমা তার মান বজায় রেখেছে সর্বাংশে, তা কি প্রচ্ছদে, কি ছাপায়, কি বিন্যাসে। যারা সমাজ ও রাজনীতি নিয়ে ভাবেন, দেখেন, আগ্রহ রাখেন এ বই তাদের কেবল পড়া নয়, রেফারেন্স হিসেবে হাতে রাখাও জরুরী।