সিটি টু সার্ফ: হেঁটে হেঁটে সিডনি প্রদক্ষিণ

পথে পথে ছিল উৎসাহদাতারাও
ছবি: সংগৃহীত

গত ১৩ আগস্ট ২০২৩ অনুষ্ঠিত হলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফান ওয়াক ‘সিটি টু সার্ফ’। এটা ছিল এই আয়োজনের ৫৩তম আসর। ১৯৭১ সালে মাত্র ২০২৫ জন অংশগ্রহণকারী নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল এই ইভেন্ট। এবার সত্তর হাজারের ওপর মানুষ এই ফান ওয়াকে অংশ নেন। এখন অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষের কাছে অতি প্রিয় এই ইভেন্ট। এটা সিডনি সিবিডি (সেন্ট্রাল বিজনেস ডিস্ট্রিক্ট) থেকে শুরু হয়ে ১৪ কিলোমিটার হাঁটার পর শেষ হয় বন্ডাই সমুদ্র সৈকতে গিয়ে। সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে শুরু হয়ে বিভিন্ন ওয়েভে যাত্রা শুরু করে। বিভিন্ন রঙের মাধ্যমে ওয়েভগুলোকে ভাগ করে দেওয়া হয় কাঠিন্যের ভিত্তিতে। রঙগুলো হলো গোলাপি, নীল, হলুদ ও কমলা।

সিটি টু সার্ফের শেষ পয়েন্ট
ছবি: লেখক

যাঁরা একটু বেশি দক্ষ, তাঁদের জন্য ছিল শুরুতেই দৌড়। এরপর সময়সূচি ধরে একে একে অন্য গ্রুপের মানুষেরাও অংশ নেন। সবশেষে ছিল কমলা গ্রুপ। এই ওয়েভের মানুষেরা গিয়েছিল হাঁটতে। এই ওয়েভে সব বয়সী হাঁটুরেরাই অংশগ্রহণ করতে পারেন।

সিটি টু সার্ফের খবর প্রথম পাই আমাদের বন্ধু আলমের কাছ থেকে। আলম আমাদের বন্ধুদের মধ্যে আয়রন ম্যান নামে পরিচিত। এই বয়সে এসে আমাদের সবারই কম বেশি শরীর মুটিয়ে গেছে। কিন্তু আলম এখনো দেখতে একহারা পেটা গড়নের। আর এটা সম্ভব হয়েছে ওর নিয়মিত শারীরিক কসরত করার কারণে। দৌড়ানো, সাইক্লিং, ব্যাডমিন্টন, ফুটবল—প্রায় সব খেলাতেই আলমের থাকে সরব উপস্থিতি। আমাদের আরেক বন্ধু রায়হানও আলমের মতোই এখনো ফিট আছে। একদিন আলম আমাদের গ্রুপে খুদে বার্তা দিয়ে জানাল যে এই সময়ের মধ্যে নিবন্ধন করলে কর্তৃপক্ষ ‘রেস রিব’গুলো বিনা মূল্যে ডাকে পাঠিয়ে দেবে। রেস রিব হলো সিটি টু সার্ফের ব্যাজ। যেটা পড়ে দৌড়াতে বা হাঁটতে হয়।

সিটি টু সার্ফ শুরুর অপেক্ষায় হাজারো মানুষ
ছবি: লেখক

আমি সাথে সাথেই নিজের জন্য নিবন্ধন করে ফেললাম। এরপর আমাদের মেয়েকে বললাম সেও যেতে চাই কি না? সে রাজি হলে তার জন্যও নিবন্ধন করে ফেললাম। তবে ততদিনে অন্য ওয়েভগুলো শেষ হয়ে শুধু কমলা রঙেরটাই অবশিষ্ট ছিল। তাই আমিও নীল গ্রুপের সাথে না যেয়ে বাপ বেটি একসাথে কমলা ওয়েভের সাথে যাওয়াটাই স্থির করলাম।

সিটি টু সার্ফ এ যাওয়া নিয়ে আমাদের মধ্যে খুবই উত্তেজনা কাজ করছিল। সেই উপলক্ষে জুতা–ট্রাউজারও কেনা হলো। আগের রাত্রে বন্ধুদের আড্ডাও আগেভাগেই শেষ করলাম। আলম শেষ মুহূর্তে একটা টিপস দিল। শুরুতেই তাড়াহুড়ো করে যেন ক্লান্ত না হয়ে যায়। কারণ, শেষের কয়েক কিলোমিটার রাস্তা অনেক উঁচুনিচু। ১৩ আগস্ট সকালে উঠে আমরা তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ট্রেনে উঠে দেখি আমাদের মতো আরও অনেকেই যাচ্ছেন সিটি টু সার্ফে। যেতে যেতে আলাপ করা হলো, কোনো স্টেশনে নামতে হবে, কোনো রাস্তায় যেয়ে জমায়েত করতে হবে। সেইন্ট জেমস স্টেশনে নেমে ম্যাকুয়ারি স্ট্রিটের এক্সিট নিয়ে এগিয়ে গেলাম। সেখানে অনেক সাহায্যকারী সহযোগিতা করছিল কোনো দিকে যেতে হবে এ বিষয়ে। আমরা দ্রুতই রেস রিব পরে নিয়ে এগিয়ে গেলাম। সিটি টু সার্ফের ব্যানারের সামনে দাড়িয়ে একটা ছবি তুলে নিলাম এর মধ্যেই। এরপর শুরুর স্থানের দিকে এগিয়ে গেলাম। আমরা প্রায় আধাঘণ্টা আগেই পৌঁছে গিয়েছিলাম তাই শুরুর দিকেই ছিলাম। জমায়েতকে চাঙ্গা রাখতে রেডিওতে বিভিন্ন ধরনের ঘোষণা আসছিল। আমরা সেই মোতাবেক কখনো হাত নাড়ছিলাম আবার কখনো–বা তারস্বরে চিৎকার করছিলাম।

৮৩ বছর বয়সী চিকিৎসক রাজু ৪৩ বছর ধরে সিটি টু সার্ফে অংশ নিচ্ছেন।
ছবি: সংগৃহীত

ইতোমধ্যেই আমাদের পেছনে একটা বিশাল জনসমুদ্র তৈরি হয়ে গিয়েছিল। যতদূর চোখ যায়, শুধু মানুষ আর মানুষের মাথা। একসময় আমাদের শুরুর সময় ঘনিয়ে এল। রেডিওর সাথে সাথে আমরা সবাই দল বেঁধে গণনা শুরু করলাম। দশ, নয়, আট, সাত, ছয়, পাঁচ, চার, তিন, দুই, এক, শূন্য। এরপর জনসমুদ্র ঢেউ তৈরি করে এগিয়ে চলল। আমাদের পাশেই একটা পরিবার ছিল ডাইনোসরদের থিম নিয়ে। মা–বাবা–দাদি পরেছিল ডাইনোসরের পোশাক। আর বাচ্চা দুটোকেও পরিয়ে দিয়েছিল ডাইনোসরের মুখোশ। সবাই খুব আগ্রহ নিয়ে উনাদের সাথে ছবি তুলতেছিলেন। তার পাশেই দুই তরুণ পরেছিল হাঙরের পোশাক। এছাড়াও কেউ সেজেছিল সুপারম্যান, কেউ হারকিউলিস, কেউ ডাইনি বুড়ি, কেউ সান্তাক্লজ—এমন আরও অনেক বাহারি সাজ এবং রঙের সমাবেশ ছিল পুরো জনসমুদ্রজুড়ে।

ভারতের শিমা হাঁটতে এসেছিলেন ঐতিহ্যবাহী শাড়ি পরে
ছবি: সংগৃহীত

হাঁটা শুরু করার কিছু পরেই মেয়েটা বলল পানি খাবে। তখন আমরা রাস্তার পাশের ওয়াটার স্টেশনে দাঁড়িয়ে পানি খেয়ে নিলাম। সেখানে অনেক স্বেচ্ছাসেবক দাঁড়িয়ে ছিল পানিভর্তি গ্লাস হাতে নিয়ে। এমন ওয়াটার স্টেশন ছিল কিছুদূর পরপরই। এছাড়াও ছিল ফার্স্ট এইড স্টেশন। সেখানে জরুরি চিকিৎসার সব ব্যবস্থার পাশাপাশি ছিল সানস্ক্রিন এবং স্যানিটাইজার। এছাড়াও কিছুদূর পরপরই ছিল প্রসাধন কক্ষের ব্যবস্থাও। আর আমাদের সাথে সাথেই সাইকেলে টহল দিচ্ছিল আরও একদল স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী।

কারও শরীর খারাপ করলেই সাথে সাথে তাঁকে আলাদা করে সেবা শুশ্রূষা দেয়া হচ্ছিল। এছাড়াও অনেক মানুষ এবং সংগঠন নিজ উদ্যোগে পানীয় এবং হালকা খাবার সরবরাহ করছিল। আর বিভিন্ন দেশের মানুষ তাদের দেশের নাচ এবং গানের মাধ্যমে হাঁটুরেদের উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছিল। এছাড়াও খেলার চিয়ারলিডারদের মতো একদল স্বেচ্ছাসেবক কিছুদূর পরপর দাঁড়িয়ে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছিল। রাস্তার দুধারের মানুষও হাততালি দিয়ে আমাদের স্বাগত জানাচ্ছিল এবং উৎসাহ দিচ্ছিল। পুরো সিডনি শহরজুড়ে বিরাজ করছিল উৎসবের আমেজ।

কিছুদূর পরপরই ছিল তৃষ্ণা নিবারণের ব্যবস্থা
ছবি: লেখক

হাঁটতে হাঁটতে পরিচয় হলো অনেক রকমের মানুষের সঙ্গে। আমাদের মেয়েটা ক্লান্ত হয়ে গেছে শুনে বুদ্ধি দিচ্ছিল কীভাবে ক্লান্তিভাব দূর করা যায়। এরপর দেখলাম একজন ভদ্রমহিলা শাড়ি পরে আমাদের পাশাপাশি হাঁটছেন। দেখে খুবই ভালো লাগলো। আমি যেচে যেয়ে উনার সাথে পরিচিত হলাম। উনার নাম শিমা, ভারতের মানুষ। তাই শাড়ি পরে নিজের দেশের ঐতিহ্যকে ছড়িয়ে দিতে এসেছেন। সাথে এসেছে উনার মেয়ে। আমি বললাম, আপনি যে শাড়ি পরে চৌদ্দ কিলোমিটার হাঁটার সাহস দেখিয়েছেন এই জন্য আপনাকে আন্তরিক অভিনন্দন এবং মোবারকবাদ। স্মৃতিটা ধরে রাখার জন্য এরপর উনার সাথে একটা ছবি তুলে নিলাম। উনি বললেন, আমার বেশি বেশি ছবি তোলা দেখে আমার মেয়েটা বিরক্ত হচ্ছে। আমি বললাম আমার মেয়েটারও একই অবস্থা।

এরপর দেখলাম আমাদের পাশাপাশি দৌড়াচ্ছেন আরেকজন প্রৌঢ়। আমি জিজ্ঞেস করলাম, স্যার আপনি ঠিক আছেন তো? উনার পেছন থেকে এক ভদ্রমহিলা বলে উঠলেন, উনি একদম ঠিক আছেন। আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকালে উনি বললেন, উনি আমার বাবা। উনার বয়স এখন ৮৩ বছর। উনি গত ৪৩ বছর ধরে সিটি টু সার্ফে অংশ নিচ্ছেন। আমি বললাম স্যার আপনার মতো মানুষেরাই আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা। এরপর উনাদের বাপ–বেটির সাথেও ছবি তুলে নিলাম। উনার মেয়ে বললেন, তুমি গুগলে তাঁকে খুঁজে পাবে। তাঁর নাম ডাক্তার রাজু। এরপর আমি তাঁকে লিংকডইনে খুঁজে পেলাম। উনার পুরো নাম সি কে রাজু। উনি সিডনির একজন জেনারেল প্র্যাকটিশনার। একটা উৎসবের মূল উদ্দেশ্যই আসলে মানুষে মানুষে এই মিথষ্ক্রিয়া। এর মাধ্যমে আমরা একে অন্যকে জানার সুযোগ পাই। জানতে পারি অন্যান্য মানুষের কৃষ্টি এবং সংস্কৃতিও।

পথে পথে ছিল বিভিন্ন রকমের বিনোদন
ছবি: লেখক

এভাবে চলতে চলতে একসময় আমরা বন্ডাই সমুদ্র সৈকতের দেখা পেলাম এবং মনে করলাম আমাদের হাঁটা মনে হয় শেষ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তখনও সৈকত প্রদক্ষিণ করে আরও এক কিলোমিটার হাঁটা বাকি ছিল। হাঁটা শেষ হবার স্থানে একটা গেট বানানো আছে। সেই গেট পার হওয়ার সাথে সাথে আমার মোবাইলে ধন্যবাদ জানিয়ে খুদে বার্তা এল। এরপর আরেকটা গেটে যাঁরা হাঁটা শেষ করলেন, তাঁদের জন্য ছিল অভিনন্দন বার্তা। সেই গেটের সামনেই স্বেচ্ছাসেবকেরা সবার হাতে সিটি টু সার্ফের মেডেল তুলে দিচ্ছিল। আমরা মেডেল নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। তখন আবারও শিমা এবং তাঁর মেয়ের সাথে দেখা হলো এবং আমরা সৈকতকে পেছনে রেখে একটা পারিবারিক ছবি তুলে রাখলাম।  

সপরিবার লেখকের বন্ধু আলম এবং পিয়াস
ছবি: সংগৃহীত

সৈকতে মাইকে ঘোষণা দেওয়া হচ্ছিল পরবর্তী করণীয় বিষয়ে। যাঁরা বাড়ি ফিরতে চান তাঁদের কোথায় লাইনে দাঁড়াতে হবে। আর যাঁরা আরও কিছু সময় থাকতে চান, তাঁদের কোথায় দাঁড়াতে হবে। পুরো সৈকতে যেন তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। এরমধ্যেই বিভিন্ন ধরনের স্টল ছিল খাওয়াদাওয়ার জন্য। আমরা আর দেরি না করে বাসের লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম। এটা ছিল আমাদের জন্য ‘ওয়ান্স ইন এ লাইফ টাইম এক্সপেরিয়েন্স’। আমি মনেমনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম এরপরও অবশ্যই আসবো এবং পরেরবার পুরো পরিবার নিয়েই আসব। তাহলে হাঁটাটা আরও বেশি আনন্দায়ক হবে। উৎসবগুলো আসে আমাদের নিরানন্দ দৈনন্দিন জীবনকে বিভিন্ন রঙে রাঙিয়ে দিতে। মনের ভেতরকার একঘেঁয়েমি দূর করে দিতে।

সেদিক দিয়ে সিটি টু সার্ফ পুরোপুরি সফল একটা উৎসব। মানুষে মানুষে মিথষ্ক্রিয়ার এইসব উৎসব চলতে থাকুক আবহমানকাল ধরে।