কানাডা আমেরিকার ওপর আরোপিত অধিকাংশ পাল্টা শুল্ক তুলে নিল

যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কানাডার অধিকাংশ পাল্টা শুল্ক গতকাল সোমবার (১ সেপ্টেম্বর) থেকে প্রত্যাহার করেছে। প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নির ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে এটি ঘটেছে। কার্নি ঘোষণা করেছিলেন, কানাডার সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার যুক্তরাষ্ট্রের ওপর আরোপিত বহু শুল্ক, যেগুলো কানাডা-আমেরিকা-মেক্সিকো (CUSMA) বাণিজ্যচুক্তির আওতাভুক্ত, তা ১ সেপ্টেম্বর থেকে প্রত্যাহার করা হবে। তিনি জানান, এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে স্থগিত বাণিজ্য আলোচনা ‘তীব্রতর’ করার চুক্তির পর নেওয়া সিদ্ধান্ত।

ফেব্রুয়ারিতে ট্রাম্প একটি নির্বাহী আদেশে কানাডার বিরুদ্ধে ব্যাপক শুল্ক আরোপ করেন। এর পরপরই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ওয়াশিংটনের বিরুদ্ধে পাল্টা শুল্ক ঘোষণা করেন।

কার্নি বলেন, ‘খুব কম দেশই’ যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে শুল্ক আরোপ করেছিল। তিনি যোগ করেন, কানাডার এই পদক্ষেপ মূলত মার্কিন শুল্কের সঙ্গে ‘মিলিয়ে’ দেওয়ার জন্য, যা সম্প্রতি ২৫ শতাংশ থেকে ৩৫ শতাংশে বাড়ানো হয়েছে। যদিও কানাডা–যুক্তরাষ্ট্র–মেক্সিকো চুক্তির আওতায় কানাডাকে কিছু ছাড় দেওয়া হয়েছে, তবে এখনো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কানাডার কিছু গুরুত্বপূর্ণ শিল্প খাতে শুল্ক আরোপ করছে।

কানাডার পাল্টা শুল্ক এখনো যুক্তরাষ্ট্রের অটো, স্টিল ও অ্যালুমিনিয়াম খাতে বহাল আছে।

কার্নি বলেন, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্র ‘আমাদের অধিকাংশ পণ্যের ক্ষেত্রে আবারও মুক্ত বাণিজ্য প্রতিষ্ঠা করেছে।’ তিনি আরও যোগ করেন, যদিও বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কানাডার গড় শুল্ক হার গত বছরের তুলনায় বেশি, তবু ‘এটি অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় ভালো।’

‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

অটোয়ায় সাংবাদিকদের কার্নি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চলমান বাণিজ্য সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করতে গিয়ে কানাডার কর্মী ও ব্যবসার জন্য এই বিশেষ সুবিধা রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’

কার্নির ঘোষণার পর হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের ট্রাম্প বলেন, এটি একটি ‘ভালো পদক্ষেপ।’ তিনি জানান, শিগগিরই আবারও কার্নির সঙ্গে কথা বলবেন। তিনি বলেন, ‘আমরা কিছু নিয়ে কাজ করছি। আমরা কানাডার জন্য ভালো কিছু চাই। আমি কার্নিকে অনেক পছন্দ করি। তিনি ভালো মানুষ এবং আমাদের মধ্যে গতকাল খুবই ভালো আলোচনা হয়েছে।’

মুদিপণ্য কি সস্তা হবে?

এই শুল্ক প্রত্যাহারের ফলে কানাডিয়ানরা শিগগিরই কিছু মুদিপণ্যের দামে পতন দেখতে পারেন, বলেন গ্যুয়েল্ফ বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য অর্থনীতিবিদ মাইক ভন মাসো। প্রথম যেসব পণ্যের দাম কমতে পারে, তার মধ্যে রয়েছে ফ্লোরিডার কমলার রস। ভন মাসোর মতে, ‘কমলার রসের দাম খুব দ্রুত কমবে; কারণ, এটি নষ্ট হয়ে যাওয়ার মতো পণ্য। তবে দীর্ঘস্থায়ী পণ্যের (যেমন মার্কিন আচার বা চিনি) ক্ষেত্রে দাম কমতে বেশি সময় লাগবে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা মার্কিন চিনির ওপর শুল্ক দিয়েছিলাম, তাই চিনিযুক্ত পণ্যের (যেমন ক্যান্ডি) দামও কিছুটা কমতে পারে। তবে এটি কমলার রসের তুলনায় ধীরে হবে; কারণ, এগুলো দীর্ঘমেয়াদি পণ্য।’

কানাডার বড় মুদিদোকানগুলো আশা করছে দাম ধীরে ধীরে কমতে শুরু করবে, তবে এতে সময় লাগতে পারে। কানাডার বিজনেস জায়েন্ট লবণ’র ওয়েবসাইটে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে: ‘আগামী দিনগুলোয় শুল্কের কারণে যেসব পণ্যের দাম বেড়েছিল, সেগুলোর দাম কমতে শুরু করবে। তবে এর জন্য দোকানের পুরোনো মজুদ শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।’

মিশ্র প্রতিক্রিয়া

কানাডার ব্যবসা ও শ্রমিক মহলের প্রতিক্রিয়া কার্নির এই সিদ্ধান্তে মিশ্র হয়েছে। কানাডার বৃহত্তম বেসরকারি শ্রমিক ইউনিয়ন ইউনিফর—এই পদক্ষেপকে ‘কানাডিয়ান শ্রমিকদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা’ বলে আখ্যা দিয়েছে। ইউনিফর সভাপতি লানা পেইন বলেন, ‘পাল্টা শুল্ক প্রত্যাহার কোনো সৌজন্য নয়—এটি যুক্তরাষ্ট্রকে আরও আগ্রাসী হওয়ার খোলা আমন্ত্রণ। এটি ভুল বার্তা দিচ্ছে, এবং সবচেয়ে খারাপ সময়ে।’

কানাডার ধাতব শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্বকারী ইউনাইটেড স্টিলওয়ার্কার্সও সমালোচনা করেছে। জাতীয় পরিচালক মার্টি ওয়ারেন বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী কার্নিকে অবশ্যই বর্তমান সময়ের সঙ্গে মানানসই পদক্ষেপ নিতে হবে। ফেডারেল সরকারকে দৃঢ় থাকতে হবে—শুধু কানাডিয়ান শ্রমিকদের রক্ষা নয়, কানাডিয়ান অর্থনীতির জন্য একটি সাহসী শিল্পনীতি গড়ে তুলতে হবে।’

তবে কিছু ব্যবসায়িক সংগঠন এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। কানাডিয়ান আমেরিকান বিজনেস কাউন্সিলের বিবৃতিতে বলা হয়— ‘এই শুল্ক সরিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে কানাডা সরকার যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডাকে আবার আলোচনার টেবিলে ফিরিয়ে আনার সুযোগ সৃষ্টি করেছে।’

কানাডার খুচরা ব্যবসায়ীদের সংগঠনও একে ইতিবাচক বলেছে। রিটেইল কাউন্সিল অব কানাডার ভাইস-প্রেসিডেন্ট ম্যাট পয়ার বলেন, ‘এটি আমাদের জন্য স্বস্তির খবর। খুচরা শিল্প ও কানাডিয়ান ভোক্তাদের জন্যও, যারা গত কয়েক মাস ধরে এই শুল্ক যুদ্ধের খরচ বহন করছে।’

কানাডার বিজনেস কাউন্সিল বলেছে, যদিও এটি ‘ভালো খবর’, তবে সরকারের এখন ভবিষ্যতের দিকে নজর দেওয়া উচিত; কারণ, ২০২৬ সালে কানাডা–যুক্তরাষ্ট্র–মেক্সিকো চুক্তির পুনর্মূল্যায়নের সময় আসছে।

বিজনেস কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট গোল্ডি হাইডার বলেন, ‘যদিও কিছু গুরুত্বপূর্ণ খাতের শুল্ক সমস্যা এখনো সমাধান বাকি, কানাডার অগ্রাধিকার হতে হবে ২০২৬ সালে মার্কিন-মেক্সিকো-কানাডা চুক্তির সফল পুনর্মূল্যায়ন।’ কানাডিয়ান চেম্বার অব কমার্স জানায়, নতুন বাণিজ্য চুক্তিতে কানাডা-মার্কিন সম্পর্কের পূর্বানুমানযোগ্যতা কেন্দ্রে থাকতে হবে। এক বিবৃতিতে তারা বলে, ‘আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত একটি স্থিতিশীল ও পূর্বানুমানযোগ্য বাণিজ্য ব্যবস্থা তৈরি করা—যা ব্যবসা ও ভোক্তাদের শুধু কয়েক সপ্তাহ নয়, বছরের পর বছর আত্মবিশ্বাস দেবে।’

লেখক: কানাডাপ্রবাসী

আরও পড়ুন