জাপানের ইয়োকোহামাতে সরস্বতীপূজা উদ্যাপিত
সরস্বতী হলেন জ্ঞান, বিদ্যা, সংস্কৃতি ও শুদ্ধতার দেবী। স্নিগ্ধাবয়ব, শ্বেতবসনা, হংসবাহিনী, পুস্তক ও বীণাধারিণী এই দেবী বাঙালির মনলোকে এমন এক প্রতিমূর্তিতে বিরাজিত, যেখানে নেই কোনো অন্ধকার, নেই কোনো অজ্ঞানতা কিংবা নেই কোনো সংস্কারের কালো ছায়া। সংস্কৃত ভাষায় ‘সরস’ শব্দটির অর্থ হলো পূর্ণতাপ্রদাত্রী বা জ্যোতির্ময়ী অথবা ঐশ্বর্যময়ী। আবার ‘সরস’ শব্দের অর্থ হলো জল বা জীবনের প্রশান্তি। উভয় অর্থেই সরস্বতী হলেন আলোকিত জীবনময়তার প্রতীক। শুভ্রবর্ণা সরস্বতী হলেন শুচিতা, শুভ্রতা, শুদ্ধতা আর পবিত্রতার প্রতীক, যা আমাদের মনকে শুদ্ধ করে। মনশুদ্ধি না হলে চিত্তশুদ্ধি হয় না, চিত্তশুদ্ধি ছাড়া জ্ঞানার্জন সম্ভব নয়।
সরস্বতী দেবীর বাহন হংসের একটি বিচিত্রতা রয়েছে। হংসকে জলমিশ্রিত দুধ খেতে দিলে সে অনায়াসেই জল রেখে সারবস্তু দুধ গ্রহণ করতে পারে। সার ও অসার মিশ্রিত এই জগৎ সংসারে মানুষ যেন সারবস্তু গ্রহণ করতে পারে, এ শিক্ষাই এখান থেকে পাওয়া যায়। দেবীর হাতের পুস্তক জ্ঞানচর্চার প্রতীক। এ জগতে জ্ঞানের মতো পবিত্র কিছুই নেই। সরস্বতী মায়ের হাতের বীণা সংগীতের প্রতীক। মনের ভাব প্রকাশ হয় ভাষায় আর প্রাণের ভাব প্রকাশ পায় সুরে। সুর মানুষকে বিমোহিত করে প্রাণে আনন্দের সঞ্চার ঘটায়। সেই বীণার তারে সা রে গা মা পা ধা নি—এই সপ্তস্বর থাকে বাঁধা। এগুলোর প্রথম দুটি বর্ণ ‘স’ এবং ‘র’ যোগে দেবীর নামের আদ্যাক্ষর সূচিত হয় ‘গ’ এবং ‘ম’ যোগে ঊর্ধ্ব গমন করা বোঝায়। ‘প’ পবিত্রতার পরিচয় বহন করে এবং ‘ধ’ অর্থে ধারণ ও ‘ন’ অর্থে আনন্দকে বোঝায়। এদিকে পূজার শাস্ত্রীয় কাজকর্মটুকুর বাইরে এর রয়েছে এক সর্বজনীন আবেদন। বিশেষ করে সাংস্কৃতিক কর্ম বা অনুষ্ঠান যখন এর সঙ্গে সম্পৃক্ত, তখন শ্রীপঞ্চমীর ওই দিবস হয়ে ওঠে এক মহামিলনের দিন।
আর তাই ২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ জাপানের ইয়োকোহামা শহরে জাঁকজমকপূর্ণভাবে সরস্বতীপূজার আয়োজন করা হয়। আয়োজনে ছিল শান্তিসুধা হিন্দুমন্দির, জাপান। এটি ছিল শান্তিসুধা হিন্দুমন্দিরের দ্বিতীয় সরস্বতীপূজা। এখানে কোনো একটি হল ভাড়া নিয়ে ছুটির দিন রোববারই পূজার আয়োজন করা হয়। তবে এবার ২ তারিখেই পূজা ছিল। তাই এবারের পূজার আনন্দটা যেন একটু বেশিই ছিল। সবাই অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে পূজা খুব উপভোগ করেছেন। স্বতঃস্ফূর্তভাবেই সবাই অংশগ্রহণ করেন।
সকাল নয়টার দিকে ইয়োকোহামার সুরুমি ওয়ার্ডের সুরুমি সিটি হলে পূজারিরা এসে উপস্থিত হতে শুরু করেন। তবে সকাল থেকে আবহাওয়া আমাদের সঙ্গ দেয়নি। তবু পূজারিরা কিন্তু দমে যাননি। প্রচণ্ড শীতে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সবাই আসতে থাকেন ভেন্যুতে। প্রথমেই শুরু হয় মঞ্চ সাজিয়ে নিয়ে প্রতিমা স্থাপনের পালা। তারপর ঠাকুর মহাশয় পূজার কাজ শুরু করেন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে পূজার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। পূজায় পৌরোহিত্য করেন শ্রী চিন্ময় চক্রবর্তী। পূজা শেষে বেলা দেড়টা নাগাদ অঞ্জলি দেওয়া হয়। এরপর প্রসাদ গ্রহণ, আর তারও পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছোটরা বরাবরের মতো তাদের পরিবেশনার মাধ্যমে সবার মন জয় করে নেয়। পরিবেশনার মধ্যে ছিল ছড়া, গান ও নাচ। আয়োজকেরা নিজেরাই তাঁদের পরিবেশনা দিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সাজিয়ে নেন, তাঁদের গান দিয়ে মাতিয়ে রাখে উপস্থিত সবাইকে।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শেষে সন্ধ্যা আরতির পর ঠাকুর মহাশয় পূজার আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষণা করেন। ও হ্যাঁ, আজ কিন্তু চার–চারজন ছোট্টমণি হাতেখড়ি দিয়েছে। চক দিয়ে তারা স্লেটের ওপরে মায়েদের সহযোগিতায় জীবনের প্রথম লেখার পাঠ গ্রহণ করে। আগামী বছর আবার আমরা সফলভবে পূজার আয়োজন করব, এই প্রত্যাশা নিয়ে সবাই বিদায় নেন।
এবারের পূজার অনুষ্ঠানকে সাফল্যমণ্ডিত করতে সার্বিকভাবে বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করেছেন শান্তিসুধা হিন্দুমন্দির জাপানের ড. কিশোর কান্তি বিশ্বাস, ড. অসীমানন্দ মল্লিক, ড. প্রসেনজিৎ ঘোষ, কৃষ্ণ কমল সাহা, অমিত গুপ্ত, অনিক সাহা, ড. শুভেন্দু বিশ্বাস, সৌমিত্র ঘোষ, ঈশ্বরীপ্রসাদ বিশ্বাস, শংকরীপ্রসাদ বিশ্বাস, আনন্দ ঘোষ, স্মৃতি বড়ুয়া, তনুশ্রী বিশ্বাস, জিতু বিশ্বাস, বনানী বিশ্বাস, মিতালী ঘোষ, শর্মিষ্ঠা পাল রাখি, অদিতি বিশ্বাস, মৌমিতা বিশ্বাস মৌ, ড. মন্দিরা রায়, সংগা ঘোষ, মৌসুমী গুপ্ত, জয়িতা মল্লিক, দিয়া, অনামিকাসহ আরও অনেকে।