সেলিনা হোসেনের ‘……… গ্রেনেড’ ও রবার্ট কর্মির ‘………ডেথ’
মানুষ চাইলেই যেকোনো কাজ শুরু করতে পারে না। যেকোনো কাজ করতে ইচ্ছা করলে সে জন্য ন্যূনতম যোগ্যতা থাকা দরকার। শুধু একটি কাজ ছাড়া। কী কাজ? কী কাজ? চারদিকে সবার মনে প্রশ্ন জাগবে।
উত্তর হলো, কাজটা ভালোবাসা বা ভালোবাসবার কাজ। ভালোবাসতে চাইলে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জনের প্রয়োজন পড়ে না। যেমন শিশির ভালোবাসব নাকি অঝোর ধারায় বৃষ্টি ভালোবাসব, তার জন্য কবি হওয়ার দরকার পড়ে কি? না, তা বোধ হয় পড়ে না।
ভালোবাসবার জন্য বা ভালোবাসা দেওয়ার জন্য কোনো যোগ্যতা অর্জন করতে হয় না। বৃষ্টির গান শুনতে যেমন কবি হওয়ার দরকার পড়ে না, কাস্তে–হাতুড়ির ক্লান্ত শ্বাস শোনার জন্যও কৃষক-মজুর হওয়ার দরকার নেই।
অঝোর ধারায় ঝরা বৃষ্টির গান ও কাস্তে–হাতুড়ির ক্লান্তিকর বিলাপ শুনতে ভালোবেসে কান পাততে হবে। ভালোবেসে শোনা ও ভালোবাসার দৃষ্টি নিয়ে দেখে যেকোনো বিষয়ে চাইলে আপন অনুভূতি প্রকাশ করা যায়, কাহিনি গাঁথা যায়। শেক্সপিয়ার অভিজাত বা রাজরাজন্যদের কেউ ছিলেন না। তবু কত অনায়াসে, কত অসাধারণ কুশলতায় তাদের গল্প বলে গেছেন। বোধ হয় ভালোবেসে ওই শ্রেণির সুখ-দুঃখ, আনন্দ-উল্লাস, হিংসা-উদারতা, ঘৃণা-ভালোবাসা সব গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখেছেন, হৃদয়ঙ্গম করতে চেয়েছেন। তারই ছবি এঁকেছেন শব্দে ও বাক্যে। তবে এখনো অনেক নাক উঁচু ইংরেজ সন্দেহ পোষণ করে যে আসলে এগুলো শেক্সপিয়ারই লিখেছিলেন কি না।
কেন এত কথা? এমন ভূমিকার অবতারণা? এর পেছনে কারণ হলো, যে কাজটা করতে যাচ্ছি, তা যোগ্যতা আছে বলে নয়। কাজটা ভালোবেসে করছি। বিশ্বনন্দিত সাহিত্যিক লিও তলস্তয় একটি কথা বলেছেন, ‘যা কিছু বুঝি ভালোবাসি বলে বুঝি।’ তবে ভালোবাসলেই সবাই তলস্তয়ের মতো সবকিছু বুঝবে, তা সবার ক্ষেত্রে ঘটে না।
তবু নম্র স্বরে বলব যে ভালোবাসি, তাই বাংলাদেশের সম্মানিত লেখক সেলিনা হোসেন ও মার্কিন লেখক রবার্ট কর্মির দুটি উপন্যাস নিয়ে সামান্য কিছু বলার প্রয়াস এটি। ঠিক তুলনামূলক আলোচনা বলা যাবে না একে। স্বল্প পরিসরে দুটি কাহিনির সংক্ষিপ্ত বয়ান এবং তা পড়ে পাঠক তাঁদের যুক্তি–বুদ্ধি প্রয়োগ শেষে সিদ্ধান্তে পৌঁছাবেন।
সেলিনা হোসেন সুপরিচিত, স্বনামধন্য লেখক। তাঁর খ্যাতি দেশের সীমানা পেরিয়ে অন্য দেশেও বিস্তৃত। লেখকের বহুলপঠিত ও প্রশংসিত মুক্তিযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে লেখা উপন্যাস ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’। যে উপন্যাস ইংরেজিতে অনুবাদ করেন বাংলাদেশের শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব গুণী অনুবাদক কবির চৌধুরী। আমরা শ্লাগা অনুভব করতে পারি যে বাংলাদেশের লেখক সেলিনা হোসেনের সৃষ্ট সাহিত্যকর্ম মার্কিন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্যপাঠের অন্তর্ভুক্ত বা রিডিং লিস্টে রয়েছে।
মার্কিন, তথা আমেরিকান সাহিত্যিক রবার্ট কর্মি একজন খ্যাতিমান লেখক। তাঁর লেখা মূলত আবর্তিত কিশোরদের (youngadult) ঘিরে, কিশোরদের নিয়ে। এই লেখকের সাহিত্যকর্মও নানা দেশে প্রচারিত, প্রসারিত। রবার্টের বই ‘আফটার দ্য ফার্স্ট ডেথ’ অস্ট্রেলীয় স্কুলে কিশোরদের জন্য পাঠ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত ছিল। তবে অবাক করার কথা যে বাক্স্বাধীনতার গলাবাজিতে ওস্তাদ যে দেশ, সেই আমেরিকাতে রবার্ট কর্মির বই স্কুলে ও লাইব্রেরিতে নিষিদ্ধ করার জন্য অভিভাবকেরা বাগ্বিতণ্ডা ও আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। এই বিষয়ে লেখক তাঁর জীবনের শেষ সাক্ষাৎকারে যুক্তরাজ্যের গার্ডিয়ান পত্রিকাকে বলেন, ‘আসলে মা-বাবা খবর রাখেন না কিশোরদের জীবনে কী ঘটছে বা এমন ঘটনা ঘটছে, যার বাস্তবতা মেনে নিতে তাঁরা নারাজ, তাই বই নিষেধের আন্দোলন।’ লেখকের পর্যবেক্ষণ মনে হয় যথাযথ। কারণ, তথ্যপ্রবাহের কারণে সবার জানা বন্দুকের গুলিতে ওই দেশে স্কুলগামী কিশোরেরা কীভাবে ভয়ংকর হত্যাকাণ্ড প্রায় ঘটিয়ে থাকে। তার ওপর এটাও জানা, হত্যাকারীর মা-বাবারাও আগে থেকে আঁচ করতে পারেন না কিশোর সন্তানের কর্মকাণ্ডের ধাঁচ কী এবং কী–ইবা কারণ। লেখক রবার্ট কর্মি ৭৫ বছর বয়সে ২০০২ সালে পরলোক গমন করেন।
‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ ও ‘আফটার দ্য ফার্স্ট ডেথ’ দুই দেশের দুই লেখকের দুটি বইতেই দেশপ্রেম রয়েছে, রয়েছে সাধারণ মানুষের অসাধারণ বীরত্বপূর্ণ কর্মগাথা। এই লেখাতে পুরো গল্প তুলে ধরা সম্ভব নয় বা এমন ধারা সঠিক নয়।
শুধু ওই অংশে আলোকপাত করা হবে, যেখানে দেখা যায় যে দুই ক্ষেত্রেই আপন আত্মজকে ভয়ংকরের মুখে পাঠিয়ে দিলেন দুজন মানুষ। একজন হলেন মা, অন্যজন বাবা।
‘হাঙর নদী গ্রেনেড’–এ মা কর্তৃক আপন আত্মজকে দখলকৃত, দলিত নিস্পেষিত দেশের মুক্তির জন্য বলিদান পাঠককে আচ্ছন্ন করে, আপ্লুত করে শোকাতুর মমতায়, বেদনাময় ও গর্ব০মিশ্রিত কান্নায়।
‘আফটার দ্য ফার্স্ট ডেথ’–এ সেনাবাহিনীর উচ্চপদধারী (ব্রিগেডিয়ার) বাবা ‘কথিত’ সন্ত্রাসী দখলকৃত স্কুলবাস উদ্ধারের জন্য নিজ সন্তানকে ভয়ংকরের মুখে ঠেলে দেন। বাবা ছেলেকে আশ্বস্ত করেন যে বাস উদ্ধার হলে দেশ সন্ত্রাসমুক্ত হবে, অতএব এটা দেশেরই কাজ। ছেলেটি আর ফিরে আসে না। মৃত্যুর আলিঙ্গনে সে আবদ্ধ হয়। দেশের নামে সন্ত্রাসী দমনে প্রেরিত কিশোরটির মৃত্যু মেনে নেওয়া কষ্টকর। লেখক রবার্ট কর্মি বইয়ের এক চরিত্রের মুখ দিয়ে এক বিষাদময় প্রশ্ন উত্থাপন করিয়েছেন, ‘Isn’t the country worth that much…’।
‘হাঙর নদী গ্রেনেড’–এর মূল চরিত্র মা। সে মায়ের নাম বুড়ি বা তিন্নি। বুড়ির বাড়িতে হঠাৎ মুক্তিযোদ্ধারা আশ্রয় নিলেন একদিন। যে ধরনের ঘটনা যুদ্ধের সময়ে গেরিলাযোদ্ধারা সচরাচর করতেন। গণমানুষও আন্তরিকভাবে তাঁদের সাহায্যে হাত বাড়িয়ে দিতেন। সেদিনই দখলদার বাহিনী বুড়ির বাড়ির দরজায় হাজির। মুক্তিযোদ্ধাদের শত্রুর হাত থেকে বাঁচাতে বুড়ি আপন প্রতিবন্ধী ছেলেটিকে অস্ত্র হাতে দিয়ে শত্রুর সামনে পাঠায়। বুড়ির অনেক সাধনা দোয়া তাবিজ, মাদুলি মানতের ফলে পাওয়া বোবা, কালা ছেলেটি শত্রুর হাতে প্রাণ হারায়। বুড়ির ছেলেটির জীবনের বদলে দুজন মুক্তিযোদ্ধা ওই সময়ে প্রাণে বেঁচে যান। অবরুদ্ধ, অপমানে জর্জরিত, লাঞ্ছিত দেশের জন্য যোদ্ধাদের বেঁচে থাকা খুব জরুরি ছিল তখন। বুড়ির ছেলের প্রাণের বিনিময়ে মুক্তিযোদ্ধারা বেঁচে রইলেন লড়াই করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার জন্য। বুড়ি কারোর হুকুমে নয়, কোনো কৌশল চিন্তা থেকে নয়, শুধু দেশের জন্য যোদ্ধাই তখন প্রয়োজন, এই বোধ থেকে আপন হাবা–গোবা প্রিয় সন্তানকে বিসর্জন দেয়। বুড়ির কাছে কেবল ওই দুজন যোদ্ধা কৃতজ্ঞ নন, দেশের আপামর মানুষ ঋণী বুড়ি ও তাঁর ছেলের কাছে।
কারও কাছে মনে হতে পারে, কী পাষাণ মা! যাঁরা যুদ্ধের ভয়াবহতা জানেন, পরাধীনতার গ্লানির ইতিহাস শুনেছেন, তাঁরাই জানেন স্বাধীনতা আনতে রক্তের সাগর পাড়ি দিতে একটি–দুটি নয়, কতশত প্রাণ বলিদান হয়েছে। সেসব অসংখ্য অমূল্য জীবনের বিনিময়ে দুঃখ, দারিদ্র্য, অভাব সত্ত্বেও আমরা আমাদের আজকের নিরাপদ, ভীতিশূন্য ও অপমানহীন স্বাধীন এক জীবনে বসবাস করছি।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চরম দুঃস্বপ্ন ও দুঃখের এক বিষাদগীতি, আবার একই সঙ্গে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পরম গৌরবের অপরূপ এক গাথা।
আমরা আক্রান্ত হয়ে প্রতিরোধ গড়ার লড়াইয়ে জড়িয়েছি, প্রাণপাত করে যুদ্ধ করেছি। আত্মজারা যুদ্ধে পাঠিয়েছেন। তাঁরা, মানে সেই মায়েরা চেতনে-অবচেতনে এই নিদারুণ সত্য জানতেন যে মুক্তির লড়াইয়ে গিয়ে সন্তান না–ও ফিরতে পারেন। সেলিনা হোসেনের জাদুমাখা কলম এই মর্মস্পর্শী ঘটনা বয়ন করে পাঠকের হৃদয়ে কান্নার বান ঝরিয়েছেন।
রবার্ট কর্মির ‘আফটার দ্য ফার্স্ট ডেথ’–এর কাহিনি দানা বেঁধেছে আমেরিকার ম্যাসাচুসেটের সাবেক এক রেলসেতুর ওপর। ‘কথিত’(শব্দটি আমি নির্বাচন করেছি) সন্ত্রাসী কর্তৃক ছোট বাচ্চাদের বহনকারী একটি বাস হাইজ্যাক বা ছিনতাই করে আটকে রাখাকে ঘিরে ঘটনার শুরু। প্রায় কিশোরীচালিত ছোট বাচ্চাদের নিয়ে ক্যাম্পগামী বাসটি সন্ত্রাসীদের কবল থেকে উদ্ধার করার নানা কর্মকাণ্ডের বর্ণনা।
জিম্মিকারীরা প্রায় সবাই কিশোর। তাদের স্বপ্ন, তাদের লক্ষ্য মাতৃভূমির মুক্তি, যে ভূমি পৃথিবীর কোনো এক প্রান্তে দখলদারদের অধীনে। যে ব্যাপারে আমেরিকাসহ পৃথিবীর মানুষ নির্লিপ্ত। তাদের পরাধীনতার বিষয়টি সবার কাছে উপেক্ষিত, অবহেলিত। এই বাস দখল বা হাইজ্যাক করার ঘটনা সচেতন পাঠককে আরও একটি ঘটনা স্মরণ করাতে পারে।
ঘটনাটা আমেরিকাতে নয়, এটা ঘটেছিল আকাশে। সময়টা ১৯৬৯ কিংবা ১৯৭০। লায়লা খালেদ নামের এক ফিলিস্তিনি মেয়ে একটি বিমান (সম্ভবত ব্রিটিশ বিমান) হাইজ্যাক করে হইচই ফেলে দেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল পৃথিবীর তাবৎ মানুষ যেন ফিলিস্তিনিদের অপমান, অত্যাচার ও তাঁদের দেশ বেদখল হওয়ার অন্যায় ঘটনাটা জানে ও কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করে। বিশ্ববিবেককে নাড়া দেওয়ার জন্য ফিলিস্তানি লায়লা খালেদ বিমান ছিনতাইয়ের মতো ভয়ংকর দুঃসাহসী কাজটি করেন।
‘আফটার দ্য ফার্স্ট ডেথ’–এর ছিনতাইকারী কিশোরেরাও নিজ মাতৃভূমির দখলদারত্বের বিষয়টি সবাইকে জানানোর উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য নিয়ে বাসটি আটক করে।
এক জেনারেল, যার কাজই হলো আমেরিকাকে সন্ত্রাসমুক্ত করে নিরাপদ রাখা। তারই ওপর দায়িত্ব পড়ল হাইজ্যাক করা বাসটি উদ্ধার করা। এখানে লেখক জেনারেল সম্বন্ধে বলেছেন যে সে বেচারা কখনোই জেনারেল হতে চায়নি।
বাস ও সন্ত্রাস নিয়ে অনেক পানি গড়াল। বাসটিতে ছোট্ট একটি শিশু মারাও গেল। তখনও বাস আটক। এর মধ্যে সন্ত্রাসীদের এক নেতা কোথায় যেন ধরাও পড়ল। তবু বাস উদ্ধার হয়নি।
শিশুসহ বাসটি উদ্ধারের জন্য জেনারেল নিজের কিশোরপুত্রকে সন্ত্রাসীদের কাছে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। যে জেনারেল বাবা আপন আত্মজের কাছে বরাবর এক ভীতিকর অস্তিত্ব। সে বাবাই অসহায়ভাবে পুত্রের কাছে আশ্বাস ভিক্ষা চান এই বলে, ‘দেশকে ডুবিও না সোনা’।
জেনারেল তাঁর কূটকৌশল আপন কিশোর পুত্রের কাছেও গোপন রাখেন। ছেলে বিদায়ের আগে তাঁর সামনেই টেলিফোনে জরুরি কিছু শোনার ভান করে সামনে রাখা রাইটিং প্যাডে কিছু লিখলেন। ভাবটা এমন যে, যা তিনি লিখছেন, তা ছেলে যেন না দেখে।
চালাকি করে বা সতর্কিত অসর্তকতায় জেনারেল ছেলের নজরে আনেন ৯:৩০ এএম লেখাটি। লেখাটির মর্মার্থ ছেলেটি ওই মূহূর্তে ধরতে পারেনি, তবে মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে এর রহস্য তার কাছে ধরা দিল।
ছেলেকে যখন সন্ত্রাসীদের কাছে পাঠানোর প্রস্তাব জেনারেল দিলেন, তখন সন্ত্রাসীদের নেতা বলে উঠল, ‘হয় তুমি মহৎ দেশপ্রেমী, না হয় বেহদ্দ বোকা!’
জেনারেলের ছেলে পৌঁছালে ওরা তার কাছে জানতে চায়, জেনারেল সত্যিই কি আলোচনা করবে সমস্যা সমাধানের জন্য, নাকি আক্রমণ করবে বাস দখলের জন্য। সরল ছেলেটি বলল, সে কিছুই জানে না।
তখন সন্ত্রাসীরা তথ্য আদায়ের জন্য জেনারেলের ছেলের ওপর প্রয়োগ করে নিষ্ঠুর কৌশল। দুই আঙুলের ফাঁকে পেনসিল রেখে মোচড়ানোর অসহনীয় কষ্ট ছেলেটি ৩০ সেকেন্ড পর্যন্ত সহ্য করে। তারপর আর এই অমানুষিক অত্যাচার সে সহ্য করতে পারছিল না। তখন সন্ত্রাসী দলের এক কিশোর জেনারেলের ছেলের অত্যাচার সহ্য করার ক্ষমতা দেখে অবাক। তারা অত্যাচার সহ্য করার প্রশিক্ষণের সময় পেনসিল দিয়ে আঙুল মোচড়ানোর যন্ত্রণা ছয় সেকেন্ডের বেশি নিতে পারেনি।
তখন জেনারেলের ছেলের বিদ্যুৎ–চমকে মনে পড়ে ০৯:৩০ এএম লেখাটি। অত্যাচারে ভগ্ন, ন্যুব্জ ছেলেটি বলে আক্রমণ করা হবে ০৯:৩০ এএমে। বোকা ছেলে একেবারেই বুঝেনি যে তার জেনারেল বাবা শুধু সন্ত্রাসীদের সঙ্গে খেলছেন না, এই খেলাতে জেনারেল নিজ সন্তানকেও ঘুঁটি হিসেবে চলেছেন।
আক্রমণই ছিল জেনারেলের গোপন উদ্দেশ্য, তবে সন্ত্রাসীদের জ্ঞাত করানোর জন্য নিজের ছেলেকে কৌশলে একটি সময় দেখিয়েছেন। আসল পরিকল্পনা সন্ত্রাসীদের অপ্রস্তুত রেখে অতর্কিতে এর আগেই আক্রমণ চালিয়ে বাস উদ্ধার ও সবাইকে মুক্ত করা। নিজ সন্তানের সঙ্গেও শঠতা করতে জেনারেল পিছপা হলেন না। আক্রমণ আচমকা চালানো হলো ঠিকই, তবে জেনারেলের ছেলেকে বাঁচানো যায়নি বা বাঁচাতে পারেননি। সন্ত্রাসীদের গুলিতে ছেলেটি মৃত্যুবরণ করে। এর পরপরই জেনারেলও আত্মহত্যা করেন। দুজনেই প্রায় একসঙ্গে পরপারে পাড়ি দেন। মৃত্যুর পর পিতা-পুত্রের মধ্যে কথপোকথন চলে। তখন ছেলেটি বাবাকে প্রশ্ন করে, ‘Isn’t the country worth that much dad।’
সেলিনা হোসেনের ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’–এ বুড়ি জানতেন, তিনি মুক্তিযোদ্ধা, তথা দেশকে বাঁচাতে সন্তানকে উৎসর্গ করছেন, বুড়ি বা তিন্নি নামের মা যে নারী, তাঁর মধ্যে কোনো শঠতা ছিল না, ফাঁকি ছিল না। এ ছিল দেশের মাটির জন্য হৃদয় উপড়ে মহৎ উৎসর্গ। যে বা যেসব ত্যাগ ও উৎসর্গের বিনিময়ে দেশ শত্রুমুক্ত হয়েছে, স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে।
রবার্ট কর্মির ‘আফটার দ্য ফার্স্ট ডেথ’–এ জেনারেলের ছেলের ব্যথিত মরণ সবার মনে প্রশ্ন জাগায়, উগ্রপন্থী বা সন্ত্রাসী দমনের নামে শক্তিশালী এক দেশের নিরপরাধ এক কিশোরকে শঠতা ও প্রতারণা করে জোর করে মৃত্যুবরণ করতে পাঠানো কতটা যৌক্তিক? নিরপরাধ কিশোরের মৃত্যু তার বাবাকে গৌরব দেয়নি; বরং ছেলের সঙ্গে প্রতারণার ও শঠতার গ্লানি জেনারেলকে আত্মহননের পথ বেছে নিতে বাধ্য করে।
‘হাঙর নদী গ্রেনেড’–এ মায়ের ত্যাগে অনাবিল সততার উদাহরণ মেলে।
‘আফটার দ্য ফার্স্ট ডেথ’–এ কর্তব্যের খাতিরে জেনারেলের বিবেকহীন শঠতার ছবি পাওয়া যায়।
মনুষ্যের চেয়ে কর্তব্যই জেনারেলের কাছে বড় হয়ে উঠেছিল কি?