‘মানুষ’ কবি কাজী নজরুল ইসলাম

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম

কাজী নজরুল ইসলাম যখন বেঁচে ছিলেন, তখন বেচারার সমস্যা ছিল এই যে অনেকে তাঁকে ডাকতেন ‘কাফের’ এবং হিন্দুরা বলতেন ‘যবন’। যেহেতু তিনি বিলেতফেরত ছিলেন না, তাই বিদ্বানেরা তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখার দৌড় নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতেন। পুরুষেরা গালি দিতেন, তিনি নাকি প্রচণ্ড নারীঘেঁষা এবং নারীরা তাঁকে জ্ঞান করতেন নারীবিদ্বেষী হিসেবে। তাঁর কবিতায় উর্দু–ফারসি শব্দের ছড়াছড়ি ছিল, ছিল অস্ত্রের ঝনঝনানি, তাই পণ্ডিতেরা তাঁকে নিয়ে করতেন সমালোচনা, ‘শনিবারের চিঠি’তে চলত হাসাহাসি।

শুধু এ–ই নয়, ইংরেজরা যে তাঁকে জেলে ভরে দিত, সেটা তো আমরা সবাই জানি, কিন্তু যাঁরা স্বরাজ আন্দোলন করতেন, তাঁরাও যে ধরে নিতেন, কবি কাজী একজন পাজি, যে স্বরাজে নিমরাজি, এটা কত জন জানেন? মোট কথা, তখনকার যুগে, সেই সমাজে যত রকমের উপগোত্র ছিল, সবাই ছিল এই কবির ওপর খ্যাপা। সবাই তাঁর দোষ ধরতেন, গালাগালি করে দূরে ঠেলে দিতেন।  তারপর তিনি হলেন বাংলাদেশের জাতীয় কবি। জীবিতাবস্থায় যে সম্মান আর ভালোবাসা তাঁর প্রাপ্য ছিল, বোধশক্তি হারানো ও দৈহিক মৃত্যুর পর সেটা পেলেন। তবে সমস্যা এখনো দূর হয়নি। দৃশ্য উল্টে গেছে, তবু লেন্সের ফোকাস জুম আউট করলে বোঝা যায়, মূল চিত্র পাল্টে যায়নি।

সে যুগে নাস্তিকেরা তাঁকে আস্তিক বলে গালাগাল করলেও বর্তমান নাস্তিকেরা দাবি করেন, নজরুল ছিলেন ধর্মবিদ্বেষী। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, যে লোক জিন্দেগিতে নজরুলের একটি কবিতাও পড়েনি, সে তাঁরই কবিতার এক–দু লাইন কোট করে বলে, ‘এই যে দেখুন, নজরুল এই যুগে জন্মালে মার খেতেন।’

উদাহরণ,
‘বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে আমরা তখনো বসে
বিবি-তালাকের ফতোয়া খুঁজেছি ফেকা ও হাদিস চষে!’
কিংবা,
‘...মূর্খরা সব শোনো,
মানুষ এনেছে গ্রন্থ;—গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।’

প্রথম উক্তিটি কবির ‘খালেদ’ কবিতা থেকে নেওয়া। ‘খালেদ’ মানে আমাদের মুসলিমদের অতিপ্রিয় খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.), সাহাবি, ইসলামের ইতিহাসের সর্বকালের সর্বসেরা জেনারেল, বিশ্ব বিজয়ী বীর। এ কবিতা সেই মহাবীরের প্রতি একজন ‘সিপাহী’ কবির শ্রদ্ধার্ঘ্য। পুরো কবিতা পড়লে যে লোক দাবি করছিল বা করে বা করবে যে নজরুল ধর্মবিদ্বেষী কিংবা নাস্তিক, সেই একই লোক বলবে, ‘এই কবি তো জঙ্গি! জিহাদের ডাক দেয়! তরবারি হাতে শহীদ হতে চায়!’

দ্বিতীয় কবিতাটি কবির ‘মানুষ’ কবিতা থেকে নেওয়া। বিশ্বসাহিত্যের রত্নভান্ডারে এমন কোহিনুর হীরা দ্বিতীয়টি আছে কি না, কে জানে! সাত দিন ধরে ক্ষুধার্ত এক ভুখারির আর্তনাদ এই কবিতার চরণে ফুটে উঠেছে। একবার শুধু পড়ে দেখুন। যদি ‘মানুষ’ হয়ে থাকেন, আগামী হাজার বছর পরও এ কবিতা পাঠককে মানসিকভাবে ভীষণ নাড়া দেবে, আবেগ ছিন্নভিন্ন করে দেবে, চোখের বাঁধে বিস্ফোরণ ঘটাবে।

উল্লিখিত চরণগুলোর ঠিক পরের লাইনগুলোই পড়ুন,
‘আদম দাউদ ঈসা মুসা ইব্রাহিম মোহাম্মদ
কৃষ্ণ বুদ্ধ নানক কবির,—বিশ্বের সম্পদ,
আমাদেরি এঁরা পিতা-পিতামহ, এই আমাদের মাঝে
তাঁদেরি রক্ত কম-বেশী করে প্রতি ধমনীতে রাজে।
আমরা তাদেরি সন্তান, জ্ঞাতি, তাঁদেরি মতন দেহ।
কে জানে কখন মোরাও অমনি হয়ে যেতে পারি কেহ
হেসো না বন্ধু! আমার আমি সে কত অতল অসীম,
আমিই কি জানি—কে জানে কে আছে আমাতে মহামহিম।’

এরপর শুধু পড়তে থাকুন এবং অবাক হয়ে ভাববেন, এ কী লিখে গেলেন কবি! আমরা কেন কখনো এভাবে ভেবে দেখি না! আমরা সহজ সত্যটাই বুঝি না! মোট কথা, যারা দাবি করে, নজরুল নাস্তিক ছিলেন, ধর্মবিদ্বেষী ছিলেন, তারা জীবনেও তাঁর লেখা পড়েনি। পড়েনি তাঁর লেখা ইসলামি গজল, গান, কবিতাগুলো। পড়েনি তাঁর ‘এক আল্লাহ জিন্দাবাদ’, ‘অনাগত’সহ অসংখ্য কবিতা। নজরুল সারা জীবন আরাধনা করে গেছেন ‘শহীদ’ হওয়ার মধ্য দিয়ে পৃথিবী ছাড়তে, এ কথা অস্বীকার করবে কীভাবে? ‘আমপারা কাব্য’ নামে কোরআন শরিফের শেষ অধ্যায়টি যে এ কবি আস্ত তর্জমা করে ফেলেছেন এবং এ জন্য তাঁকে প্রচণ্ড পরিশ্রম করে একই সঙ্গে আরবি ও ফারসি ভাষা শিখতে হয়েছে, তা তারা জানেই না। এ সূত্র ধরেই একবার একজন আমাকে বললেন, ‘নজরুলের রেফারেন্স নেওয়া উচিত নয়। তাঁর ইমানের ঠিক নেই।’

আমি বলেছিলাম, ‘তাহলে ওনার সমপর্যায়ে বাংলা সাহিত্যে ইসলামি লেখা কেউ লিখেছেন কি না, আমাকে জানান। ১০০ বছর পেরিয়ে গেল, বাংলার এত এত মুসলিম সাহিত্যিক “রমজানের ঐ রোজার শেষে” বা “তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে” কিংবা “ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ” গানগুলোর বিকল্প তৈরি করতে পারল না, আর আপনারা ফতোয়া দিয়ে দিচ্ছেন, তাঁর ইমানের ঠিক নেই?’

নজরুলের জীবনকালে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমেরই এ ধারণা ছিল। তাঁর কাব্যে দেব–দেবীর নাম উল্লেখ করা হয়, কাজেই তিনি মুমিন হতেই পারেন না। তা ছাড়া বিয়েও করেছেন হিন্দুকে। এখন আবার উল্টো দৃশ্য। লোকজন দাবি করেন, তিনি এক্সক্লুসিভলি ইসলামের কবি। এর পক্ষে রেফারেন্সের অভাব নেই। আগেই বলেছি, তাঁর পর্যায়ে ইসলামিক কবিতা বাংলার কোনো বাপের ব্যাটা সাহিত্যিক লিখতে পারেনি, পারবেও না। সেই ভাষা, সেই অলংকারই গত হয়েছে বহুদিন হলো। তবে ওরা যেটা ভুল করে, তা হচ্ছে নজরুলের আরও অন্যান্য সাহিত্যকর্মকে তারা ঢেকে রাখে। ‘আনন্দময়ীর আগমন’, ‘শ্যামাসংগীত’ ইত্যাদি থেকে নজরুলকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন। তিনি যে হিন্দু রমণী বিয়ে করেছিলেন, সেটাও চেপে যান। এইটাও তো আরেক পর্যায়ের এক্সট্রিমিজম।

ধর্ম থেকে সরে রাজনীতিতে আসা যাক। এ কথা আমরা সবাই জানি যে নজরুল ছিলেন ইংরেজদের জুলুমবিরোধী। কিন্তু এ-ও সত্য, একই সঙ্গে তিনি স্বরাজিদেরও চাঁদা আদায়ের বিরোধী ছিলেন। বিশেষ করে ভারতে যেখানে কোটি কোটি মানুষ না খেয়ে মরছে, সেখানে ‘স্বরাজ এনে দেব’ প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের কাছ থেকেই টাকা তুলে নেওয়াকে নজরুল সমর্থন করতেন না। তিনি নিজে দেখেছেন, ক্ষুধার্ত মা তাঁর শিশুদের না খাইয়ে সেই টাকা তুলে দিয়েছেন নেতাদের হাতে। তিনি দেখেছেন, বাড়িতে ছেলের লাশ ঢেকে রেখে মা গিয়েছেন ভিক্ষা করতে। এসব দৃশ্য তিনি নিতে পারতেন না। রক্তে বিদ্রোহী সৈনিক হলেও, একজন বীর যোদ্ধা হলেও তিনিই তো ছিলেন একজন প্রেমিক কবি। মানবপ্রেমকে নিজের আত্মা থেকে বিচ্ছিন্ন করবেন কীভাবে? তাঁর নিজের ভাষায়, ‘বন্ধু গো, আর বলিতে পারি না, বড় বিষ-জ্বালা এই বুকে!

দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে।’ (আমার কৈফিয়ৎ)

সাহিত্যিকেরা তাঁর কবিতা নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করতেন। মর্মাহত হয়ে তিনি প্রেমের গান বা গজল লেখা শুরু করেন। এই সময়ে তাঁর পাশে এসে দাঁড়ান কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনিই বলেন, ‘ঈশ্বর তোমাকে তলোয়ার দিয়েছেন যুদ্ধ লড়তে, আর তুমি কিনা তা দিয়ে দাড়ি কামানো শুরু করে দিলে?’ গুরুর স্নেহে কবি আবারও তাঁর মনোবল খুঁজে পান। তাঁর হাত ধরে আবারও ঝলসে ওঠে তলোয়ার। কণ্ঠ পায় নিপীড়িতের আর্তনাদ।

এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে, কবি কাজী নজরুল ইসলামের আসল পরিচয়টা তবে কি? তিনি বিদ্রোহী? তিনি প্রেমিক? তিনি আস্তিক? তিনি নাস্তিক? স্বদেশি? বিদেশির গোলাম? তিনি কী?

উত্তরটা তিনিই দিয়েছেন ‘রাজবন্দীর জবানবন্দি’তে। যেখানে তিনি বলেন তাঁর ভগবান হচ্ছে ‘ন্যায়’। তিনি ন্যায়ের পক্ষে কণ্ঠ তুলে গেছেন, তিনি অন্যায়ের বিরোধিতা করে গেছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি যা বলেন, তা তাঁর হয়ে ভগবান বা ঈশ্বর বা খোদা তাঁকে দিয়ে বলান। তিনি বিশ্বাস করেন, অন্যায়ের প্রতিবাদ করে আসামির কাঠগড়ায় তাঁকে যখন দাঁড়াতে হয়, তাঁর পেছনে পরম করুণাময় ঠিক সেভাবেই থাকেন, যেভাবে তিনি ছিলেন যিশু বা গান্ধীর সময়ে।

নজরুল কোনো মহান সাহিত্যকর্ম, সাহিত্যের সেবা, মহাকাব্য রচনা কিংবা সাহিত্যজগতে নিজের নাম চিরস্থায়ী করার উদ্দেশ্যে কলম ধরেননি। তিনি বলেছেন, ওটা তাঁরাই করুন, যাঁরা সুখে–শান্তিতে থাকেন। তাঁর সাহিত্যিক জীবনের ব্রত ছিল একটিই, অন্যায়ের প্রতিবাদ, ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান এবং জালিমের সর্বনাশ ঘটানো। কাজী নজরুল ইসলামকে তাই বিশেষ কোন বিশেষণে বিশেষায়িত না করে এভাবেই গ্রহণ করতে শিখুন। তিনি আমাদের জাতীয় কবি, তাই দোহাই লাগে, ‘নজরুল রচনাবলি’ একবার হলেও পড়ুন। ভাবুন। এতে লাভ ভিন্ন ক্ষতি হবে না।

প্রিয়তম কবি কাজী নজরুল ইসলামের রুহের মাগফিরাত কামনা করছি। শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁকে স্মরণ করছি এবং তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। লিখে দিতে পারি, আসানসোলের দুখু মিয়া যদি পৃথিবীতে না আসতেন, তবে সম্পদশালী বাংলা সাহিত্য তাঁর বিপুলাংশের ঐশ্বর্য, সোনা, রুপা, মণিমুক্তার ভান্ডার হতে বঞ্চিত হতো নিশ্চিত।