আলো ছড়ানো মানুষদের সান্নিধ্যে

সততা, সাহস ও পরিশ্রম জীবনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সমাজের আলোকিত মানুষদের কাছে এ বিষয়গুলো শিখতে হয়। নম্রতা, ভদ্রতা, বিনয় ও সুশিক্ষায় শিক্ষিত আলোকিত মানুষেরা নিজেদের যেমনটা সুন্দর করে তৈরি করেন, আশপাশের মানুষগুলোর জন্যও তাঁরা একইভাবে আলো ছড়ান। সৌভাগ্যক্রমে এমন কিছু আলোকিত মানুষকে খুব কাছে থেকে দেখার ও মেশার সুযোগ হয়েছে।

আলোকিত মানুষের আলো ছড়ানো বিষয়কে না বোঝার ছোট্ট বয়সে আমার ছোটবেলাটা মায়ের সঙ্গেই কেটেছে। কাজের জন্য এই শহর সেই শহরে সময় কাটাতেন বাবা। শুনেছি, ঢাকাতেই তাঁকে থাকতে হতো বেশি। মা একলা হাতে সংসার সামলে সন্তানদের বর্ণমালা আর সংখ্যা শেখাতেন। কয়েক সপ্তাহ বা মাস পরপর কিছুদিনের জন্য বাবা ঘরে ফিরতেন।

বাড়ির পথে ফিরতে বাবা নিজ জেলা শহরে আত্মীয়ের বাড়িতে দেখা করতেন। সেখানকার নুরুল-নজরুল চাচা তখন জেলার সেরা স্কুল হরিমোহনের ছাত্র। তাঁরা যমজ ভাই। দুজনের একই চেহারা, আর তাঁদের হাতের লেখাও একই রকমের, অসাধারণ সুন্দর সে লেখা। অত্যন্ত ভালো ছাত্র হিসেবে শহরে তাঁদের খুব নামডাক। তাঁদের হাতের সেই সুন্দর লেখা এক পাতা-দুই পাতা আমাদের দেখানোর জন্য বাবা সেগুলো নিয়ে আসতেন। সে সময় আমি প্রাইমারি স্কুলের নিম্নস্তরের ছাত্র।

কয়েক বছর পর, অন্য শহরে কাজ কমিয়ে বাবা নিজ বাড়িতে সন্তানদের বড় করার কাজে বেশি মনোযোগী হলেন। ফলে, গ্রামের স্কুলে পড়ে তেমন বেশি কিছু না শিখে, আর ভালো ছাত্র না হয়েও বাবার এই সন্তান কীভাবে যেন শহরে হরিমোহন স্কুলের ভর্তি পরীক্ষায় টিকে যায়। ভর্তি-ইচ্ছুক ছাত্রদের জন্য ভর্তিযুদ্ধ নামক ভীতিকর পরীক্ষায় পাস করে জেলার এই সেরা স্কুলে পড়ার সুযোগ হলো। সেখানে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে সেই থেকেই মা-বাবা পরিবার ছেড়ে শহরে বসবাসের শুরু।

পরিবার ছাড়া হলেও শহরে পড়তে সেই আত্মীয়ের বাড়িতেই থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। সেটা বাবার চাচা ভিখু বিশ্বাসের বড় বাড়ি, তাঁর খানদানি পরিবার। বেশ বড় এই সংসারে অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র নুরুল চাচা, নজরুল চাচা তাঁরই সন্তান। আরেকজন মেধাবী সন্তানের নাম সাবানী, তবে স্কুলের লেখাপড়ার চেয়ে সে সময় ক্রিকেট খেলা আর ঘোরাঘুরিই তাঁর বেশি পছন্দের ছিল। জেলা পর্যায়ের ক্রিকেটে পেস বোলার হিসেবে তাঁর খুব ভালো পরিচিতি।

শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া মহানন্দা নদীর তীরে অবস্থিত এই এলাকায় তখন যুবকদের মাঝে ক্রিকেট খেলাটা আসলেও খুব প্রিয় ছিল। আর আমার প্রিয় ছিল এখানকার শিক্ষিত মানুষগুলো। মাওলানা বাহারউদ্দিনের অনেক সন্তান, তাঁর ছেলেমেয়েরা সবাই উচ্চশিক্ষিত। বুয়েট, মেডিকেল ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া তাঁর সন্তানেরা এখন দেশে-বিদেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আর অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। প্রিয় এই মানুষগুলো জোফার, নাসার, আসার, কামাল, মোবাশ্বের—যাঁদের সবাইকে আঙ্কেল বলে সম্বোধন করি। গিয়াসউদ্দিনের ছেলে নুর মামা ও ওদুদ মামা অমায়িক মানুষ। দুজনেই তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। মাস্টার জালালউদ্দিনের ছেলে বিপ্লব ভাই যেমন সুদর্শন তেমন স্মার্ট।

শহরে আমার বসবাসের জায়গায় স্মার্ট এই মানুষগুলো সবাই উচ্চশিক্ষিত, নামকরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁদের লেখাপড়া। নম্রতা, ভদ্রতা ও সুশিক্ষায় আলোকিত হয়ে সমাজে তাঁদের অনেক উঁচু স্তরে অবস্থান। এই উঁচু স্তরে যাওয়ার আগে ও পরে তাঁদের সঙ্গে আমার অনেক সুন্দর সময় কেটেছে। জীবনপথের সংগ্রামের জন্য সব সময়ই তাঁরা সুন্দর ও সঠিক পরামর্শ দিয়েছেন।

আলোকিত এই মানুষগুলোর সান্নিধ্যে থেকে সততা, সাহস ও পরিশ্রম কী, তা শেখা হয়েছে। কোনো কিছুতে অকৃতকার্য অথবা পিছিয়ে পড়লে সেখান থেকে কীভাবে উঠে আসতে হয়, সেগুলো তাঁরা শিখিয়েছেন। স্কুল ও কলেজজীবনে অমনোযোগিতা আর অসচেতনতায় অন্তত দুবার হঠাৎই খুব বেশি পিছিয়ে পড়েছি। সেই দুরবস্থায় নুরুল-নজরুল চাচা ও ওদুদ মামা সাহস জুগিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফিরিয়েছেন, শেষ পর্যন্ত ফল ভালো হয়েছে। এই আলো ছড়ানো মানুষগুলোকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি।

সব সমাজে সুশিক্ষার আলো ছড়াতে আলোকিত মানুষ খুব দরকার। তাঁদের শৃঙ্খলিত জীবনের চলাফেরা দেখেই অনেক কিছু শেখা যায়। সততার সঙ্গে, সাহস জুগিয়ে অনেক পরিশ্রম করে জীবনকে সুন্দর পথে এগিয়ে নিতে এই গুণীজনদের মূল্যবান পরামর্শ কাজে লাগে।