ফিরিয়ে দাও সাম্রাজ্য

ডাক্তার
ছবি: সংগৃহীত

পবিত্র রমজান মাস চলছে। হাসপাতালে রোগীদের উপচে পড়া ভিড়। রোজা রেখে দৌড়ে চলার বদলে দ্রুত হাঁটা অভ্যাস করে নিয়েছি, যাতে কোনোভাবেই দুর্বল না লাগে। বেলা একটার সময় একটা অ্যাডমিশন পেলাম গত শুক্রবার। মানে ইমার্জেন্সি ডাক্তার জানালেন, রোগী ভর্তি করা লাগবে। রোগীর চার্টে ঢুকে কোন কোন অসুখ আগে থেকে আছে, তিনি কী কী ওষুধ খান, ইমার্জেন্সিতে কাজ করা ডাক্তার কী কী পরীক্ষা দিয়েছেন এবং সেসব রেজাল্ট দেখে নিয়ে তারপর রোগী দেখতে যাই আমি। রোগীর চার্টে ঢুকতে গিয়ে ওয়ার্নিং পেলাম ব্রেক দ্য গ্লাসের। যেকোনো কারণেই হোক রোগীর আইডেন্টিটি হাইড করার কারণ আছে। ততটা গুরুত্ব দিলাম না, কারণ ভিআইপি রোগী কম আসেন না এ হাসপাতালে। চার্ট দেখে গেলাম রোগী দেখতে।

ওভারহেড টিভি স্ক্রিনেও রোগীর নাম হাইড করা এক্স এক্স দিয়ে। রুমে ঢোকার আগে কঠিন চেহারার চারজন লোকের মুখোমুখি হলাম। না তাকিয়ে রোগীর কাছে গেলাম। দেখে মনে হচ্ছে স্ট্রোকের রোগী। দেহের বাঁ পাশ অবশ হয়ে আছে, কিন্তু তাঁর কথা বলার কোনো সমস্যা নেই। নিজের পরিচয় দিলাম। রোগীর উপসর্গ কবে থেকে শুরু হয়েছে জানতে চাইব, তাঁর আগে কঠিন চেহারার চারজন লোকের একজন এগিয়ে এলেন। বললেন, আমি ওনার দেহরক্ষী (বডিগার্ড)। আমাকে জিজ্ঞেস করুন। তাঁর দিকে তাকিয়ে বললাম রোগী যখন অসুস্থ হয়েছিলেন প্রথম, আপনি ছিলেন সঙ্গে? বললেন, না। বললাম, দয়া করে বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করুন, আমি দরকার হলে আপনাদের জানাব। রোগীর সঙ্গে কথা শুরু করলাম, হিস্ট্রি নিয়ে শারীরিক পরীক্ষা করে বললাম, মূলত ব্রেন এমআরআই না করে বলতে পারছি না ওনার কী হয়েছে। চলে যাব কম্পিউটারে অডার এন্ট্রি করতে। রোগী বললেন, ডাক্তার, কিছু কথা শুনে যাও। এগুলো বলা খুব জরুরি। দেড় ঘণ্টার মধ্যে রোগীর সব ব্যবস্থা করে, কম্পিউটারে টাইপ করে পরবর্তী রোগী দেখতে যেতে হবে। কিন্তু রোগীর কথায় এমন আকুলতা ছিল, আমাকে বসতে হয়েছিল।

বললাম, বলুন। রোজা রেখে একটু দুর্বল লাগছে। বললেন, তিনি একজন ডন। অপরাধজগতের একজন সম্রাট। এত নিরাপত্তা, গোপনীয়তা সে জন্যই। তীব্র ভয় দেখিয়ে এত দিন সবাইকে তিনি বশে রেখেছেন। যত দ্রুত সম্ভব তাঁকে যেন সারিয়ে তুলি। তাঁর একজন বউ আছে আর আছে আরও কয়েকজন বান্ধবী। তাঁর প্রতাপ আর পয়সার এমনই নাকি ক্ষমতা, সবাই খুব খুশি মনে তাঁর আশপাশে থাকেন। আমি অবাক হয়ে শুনলাম, দেখলাম খুব সাধারণ চেহারার একজন মানুষ, হাসপাতালের গাউন পরা, অন্য কোনো রোগীর সঙ্গে ওনাকে আলাদা করতে পারলাম না। তারপর বললাম সব রোগী আমাদের কাছে সমান। দেখছি কী করতে পারি। রুমের বাইরে এসে দেখি ভদ্রলোকের বউ দাঁড়ানো। কী বিষণ্ন চেহারার একটা মেয়ে। চোখ দুটো ভেজা। একটা কোনায় ডেকে নিয়ে বউ জানালেন, সেই কবে মিথ্যা ভালোবাসার অভিনয় করে রোগী তাঁকে বিয়ে করেছিলেন। ভালোবাসার মায়ায় এতগুলো বছর তিনি থেকে গেছেন। তিনি চান তাঁর স্বামী যেন সুস্থ হয়ে ওঠেন। একটা হাত তাঁর কাঁধে রাখলাম। তারপর দ্রুত কাজে ফিরে গেলাম।

দুই ঘণ্টা পরের কথা। মাথার এমআরআই রিপোর্ট এসেছে রোগীর। খুব সম্ভবত ব্রেইন টিউমার, যা মাথার প্রায় একটা পাশ দখল করেছে। আমি, নিউরোলজিস্ট আর নিউরোসার্জন একসঙ্গে গেলাম রোগীর রুমে। রোগীর বউ ছাড়া আর সবাইকে চলে যেতে বললাম। তারপর আমরা জানালাম, বায়োপসি করা লাগবে, কিন্তু প্রায় শতভাগ সম্ভাবনা এটা ক্যানসার। আমাদের তাঁর জন্য খুব সামান্য কিছু করার আছে। রোগী বায়োপসি করতে চান, ক্যানসার–বিশেষজ্ঞর সঙ্গে এক্ষুনি কথা বলতে চান, সব ব্যবস্থা করে দিলাম। বায়োপসি হয়ে গেল। ইফতারের ঠিক আগে আগে বাসায় পৌঁছালাম সেদিন।

পরদিন সকালে রোগী দেখতে গেলাম। যথারীতি রুমের বাইরে গার্ড, ভেতরে বউ আর অন্য আরেকজন নারী বসা। রোগীর মিস্ট্রেস। শুনে ওই মুহূর্তে বের হয়ে যেতে ইচ্ছা করছিল রুম থেকে। কিন্তু রোগীদের পয়সায় আমার জীবনধারণ। মাথা ঠান্ডা করে বসলাম। বললাম, ক্যানসার–বিশেষজ্ঞ আসবেন আজকে। তাঁর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আমরা আরও কিছু স্ক্যান করব ক্যানসার কত দূর ছড়িয়েছে জানতে। তবে মাত্র ছয় মাস বা তারও কম আছে আয়ু। রোগীর তৈরি হতে হবে মানসিকভাবে। রোগী বললেন পৃথিবীর বহু দেশে তাঁর বাড়ি আছে, নিজের কত টাকা আছে তার হিসাব নিজের কাছেও নেই তাঁর। মানুষ যমের মতো ভয় পায় তাঁকে। তিনি ছাড়া তাঁর সাম্রাজ্য অচল। আমি যেন সেটা বুঝি।

রোগী জীবনসায়াহ্নে চলে এসেছেন। এ সময়ে কী কী এক্সপেক্ট করতে হবে এবং কষ্ট কমিয়ে কীভাবে দুনিয়া থেকে চলে যেতে হবে, এখন শুরু হয়েছে সে প্রস্তুতি। আমি প্যালিয়েটিভ কেয়ারকে (ডাক্তার, সোশ্যাল ওয়ারকার, প্রিস্টসহ গ্রুপ) রোগী দেখতে বলে চলে গেলাম, যাঁরা রোগীকে বোঝাবেন যত চিকিৎসা করি, রোগীর হাতে বেশি সময় নিই। তিনি এবং তাঁর পরিবার যেন বুঝেশুনে সিদ্ধান্ত নেন। পরের দুই দিন রোগী মাথায় রেডিয়েশন পেলেন। সার্জারি করবেন বলে জিদ করলেন। আমি আমাদের নতুন হাসপাতালে পাঠানোর অর্ডার দিয়ে বাসায় রওনা হব। এমন সময় নার্স কল করে জানালেন রোগী তোমার সঙ্গে কথা বলতে চায়। গেলাম।

রোগী রুম থেকে সবাইকে বের করে দিয়ে আমাকে বসতে বললেন। তারপর হাপুস নয়নে কাঁদলেন। বললেন, ডাক্তার, ফিরিয়ে দাও আমার জীবন। তুমি তো ১৫ বছর কাজ করছ। আমি আমার সাম্রাজ্যে ফিরে যেতে চাই। বাংলায় বললাম, সব শেষে লাগবে সেই সাড়ে তিন হাত জমি। তারপর ইংরেজিতে বললাম এ পৃথিবী ছোট্ট একটা জার্নি। নিজের একার জন্য পুরো পৃথিবী লাগে না, কারণ সব শেষে শূন্য হাতেই ফিরে যেতে হবে। ওনার সঙ্গে আমার এটাই শেষ দেখা।

সেদিন ইফতারের পর পৌঁছেছি বাসায়। রোগীর কান্না আমাকেও সারা রাত কাঁদিয়েছে।

**এত কষ্টকর সত্য আমি কম লিখি। কিন্তু বঙ্গবাজারে আগুনপরবর্তী লুটতরাজ আমাকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে না পারলে ও একটু মানবিকতা কি দেখানো যায় না? অন্তত ক্ষতি না করি আমরা। যতটুকু রিজিক এর বাইরে কিচ্ছু পাব না, সেটা সৎ বা অসৎ যেকোনো উপায়ে অর্জিত হোক।