ইন্দোনেশিয়ায় ১৬ দিনের ভ্রমণ ও মানুষের আতিথেয়তার গল্প

নাম তার দুয়েনাতো (dowenanto), ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপের বাসিন্দা। আমরা সাতজন একসঙ্গে কাজ করি দক্ষিণ কোরিয়ার আনসান সিটিতে। ছয়জন বাংলাদেশির মধ্যে সে–ই একমাত্র বিদেশি, ইন্দোনেশিয়ার লোক। ফ্যাক্টরির ডরমিটরিতে আমার পাশেই তার থাকার সিট। সে বলে আমার পাশে থাকতে তার খুব ভালো লাগে। সে তার মনের ভাব আমার সঙ্গে খুব সহজে আদান–প্রদান করতে পারে। কারণ, আমি ইন্দোনেশিয়ার পুরো ভাষাই জানি। তাদের যে আঞ্চলিক ভাষা, তাও কিছুটা রপ্ত করেছি তার সঙ্গে থেকে।

কাজের শেষে অথবা শনি–রোববার ছুটির দিনে আমরা একসঙ্গে বসে আড্ডা দিই, অনেক গল্পও করি। আমার পরিবার, দেশ সম্বন্ধে জানতে আগ্রহ প্রকাশ করে সে। আমি বাংলাদেশ, আমার পরিবার সম্বন্ধে বলি, সে শুনে খুবই খুশি হয়।

আমিও তার পরিবার, দেশ সম্বন্ধে জানতে আগ্রহ প্রকাশ করি। সে বলে, ইন্দোনেশিয়া আসলে একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। যদিও পৃথিবীর বৃহত্তম মুসলিম দেশ; কিন্তু তাদের পোশাক-আশাক সম্পূর্ণ বিদেশিদের মতো। মেয়েরা স্বল্পবসনা এবং ধর্ম নিয়ে ওরা বাড়াবাড়ি করে না। যার যার ইচ্ছেমতো পোশাক পরিধান করে। তাকে বললাম, তোমার পরিবার সম্বন্ধে কিছু বলো। সে বলা শুরু করল, তার বাবা মুসলিম কিন্তু মা হিন্দু। তারা তিন বোন ও এক ভাই। মধ্যে একজন খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত হয়েছে। তাতে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই।

আমাকে সে দাওয়াত দিল তার দেশে যাওয়ার জন্য। আমিও দাওয়াত গ্রহণ করলাম। একদিন মালিকের কাছে ছুটি নিয়ে উড়োজাহাজের টিকিট কেটে ইনচন বিমানবন্দর থেকে ক্যাথে প্যাসিফিক এয়ারলাইনসে করে সুরাবায়া ইন্টারন্যাশনাল বিমানবন্দরে অবতরণ করি। বিমানবন্দরে তাঁর দুই বোন আমাদের রিসিভ করে। তাদের বাড়ি হলো জাওয়াতিমুর রাজ্যের মালাং জেলার কেপানজেন গ্রামে। সুরাবায়া বিমানবন্দর থেকে একটি ট্যাক্সি নিয়ে দুই ঘণ্টার পথ অতিক্রম করে তাদের গ্রামে পৌঁছাই। এরই মধ্যে আমাকে দেখার জন্য তার আত্মীয়স্বজন এবং গ্রামের অনেক মানুষ জড়ো হয়েছেন ও খুব আনন্দ পাচ্ছেন। আমি যখন তাঁদের ভাষায় কথা বলা শুরু করি, তাঁরা খুব খুশি হন। পরের দিন থেকে তাঁদের আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীর বাড়িতে আমার দাওয়াত খাওয়া শুরু। সবাই মুসলিম। নারী-পুরুষ আলাদাভাবে মসজিদে নামাজ পড়েন। মসজিদে নিয়মকানুন অনেক সুন্দর। আমি একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনাদের মসজিদে ইমামের বেতন কীভাবে দেন। তিনি বলেন, নামাজের বিনিময়ে কোনো বেতন দেওয়া ইসলামে নেই। তাই মসজিদের যে জমি আছে, ইমাম সাহেব জমি চাষাবাদ করে যে অর্থ পান, এটাই তাঁর সম্মানী।

আরেকটা বিষয় লক্ষ করলাম। গ্রামে কোনো টিনের ঘর নেই। আমি কিছু মানুষকে জিজ্ঞাসা করে যা জানতে পারলাম তা হলো, মসজিদের আওতাধীন গ্রামের যে অভাবগ্রস্ত লোক আছে, তাদের একটা তালিকা করে সব মুসল্লির দেওয়া দানে প্রতিবছর একটি অসচ্ছল পরিবারকে পাকা ঘর ও ব্যবসা করার জন্য পুঁজি দিয়ে সাহায্য করা হয়।

আমি ১৬ দিনের মতো এই গ্রামে ছিলাম। সীমাহীন ভালো লাগা আমাকে আচ্ছন্ন করেছে। সকালে পাখির কিচিরমিচির শব্দ, ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে মাদ্রাসায় যাওয়া সে দেশের একটা নিয়ম। ছোট শিশুদের অবশ্যই মাদ্রাসায় যেতে হবে। তাই আমি অনেক মানুষকে দেখেছি, পবিত্র আল কোরআনের বেশির ভাগ সুরাই মুখস্থ বলতে পারেন।

খাবারদাবার অনেকটা আমাদের দেশের মতোই, তবে বেশি খান (নাসি গোরিং) লেলে পিচ্ছেল। সম্বল তাঁদের প্রিয় খাবার, যেকোনো খাবারের সঙ্গে এটা খাবেই। আমারও খুব ভালো লেগেছে।

সকালে ঘুম থেকে উঠে একজনের সঙ্গে আরেকজনের দেখা হলে প্রথমে সালাম দিয়ে কুশলবিনিময় করে পরে তাঁদের ভাষায় বলে (সালামত পাগি), শুভ সকাল ও আপনি কেমন আছেন? ২৭ হাজার দ্বীপ নিয়ে ইন্দোনেশিয়া। তবে কিছু অঞ্চলে গরম অনুভূত হয়। কিন্তু আমি যে শহরে ছিলাম, ঠান্ডা আবহাওয়া। সেখানে প্রচুর আপেলের ফলন হয়। আমি গাছ থেকে নিজের হাতে তুলে আপেল খেয়েছি।

পৃথিবীর অন্যতম কুসংস্কারের দেশ হলো ইন্দোনেশিয়া। তাঁরা ফুঁ, তাবিজ–কবজ খুব বিশ্বাস করেন। ১৬ দিনের ভ্রমণ অনেক আনন্দময় ছিল। এখনো আমি ভুলতে পারিনি। ইন্দোনেশিয়ার মানুষদের আতিথেয়তা আমাকে খুব আপন করে নিয়েছে। যখন কোরিয়ায় ফিরে আসি, দুয়েনাতোর পরিবারের মানুষ নিজের আপনজনের বিদায়বেলায় যে কষ্ট পান, ঠিক তেমনি আমাকে বিদায়ের সময় তাঁদের চোখে পানি দেখতে পেলাম। আমারও খুব খারাপ লাগছিল, কিন্তু কর্মস্থলে তো আসতেই হবে। সেদিনের সেই স্মৃতিগুলো আজও আমাকে তাড়া করে ফেরে। তারপর সব স্মৃতি পেছনে ফেলে আবারও ক্যাথে প্যাসিফিক উড়োজাহাজে দক্ষিণ কোরিয়ায় ফেরার সঙ্গে নিয়ে এলাম অনেক অভিজ্ঞতা।

*লেখক: শাহ হারুন রশীদ, আনসান সিটি, দক্ষিণ কোরিয়া

‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]