মায়ের আহ্লাদী হতভাগিনী একমাত্র মেয়ে

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ছোট পুত্রবধূ কল্যাণী কাজী ১২ মে ভোরে কলকাতায় ইন্তেকাল করেছেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। তিনি জাতীয় কবির ছোট ছেলে কাজী অনিরুদ্ধের স্ত্রী। কল্যাণী কাজীর মেয়ে অনিন্দিতা কাজী মায়ের স্মৃতিচারণ করেছেন এভাবে—

কানের কাছে উঠতে–বসতে মায়ের যে কথাগুলো বাজছে বার বার, ‘তুই কবে আসবি? তাড়াতাড়ি আসবি তো?’ মনে হচ্ছে, মাকে ছেড়ে কেন এলাম? টানা ছয় মাস মায়ের সঙ্গে কাটিয়ে একটা বিশেষ জরুরি কাজে কয়েক দিনের জন্য আমেরিকা এসেছিলাম। জরুরি কাগজপত্র নিয়ে আবার মায়ের কাছে ফিরে আসব, এমনটাই কথা ছিল। মাকে সে কথা জানিয়েও গিয়েছিলাম। কিন্তু এভাবে ফিরতে হবে তা ভাবিনি। আমার এত বছরের জীবনে ততটা সময় কাটেনি মায়ের সঙ্গে, যা গত বছরের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত।

মায়ের সঙ্গে আমার সময় কেটেছে অন্তরঙ্গতায়। এখানে আসার আগে প্রতিদিন টেলিফোনে আমার সঙ্গে গল্প করে ঘুমাতে যাওয়া মায়ের রোজকার রুটিন ছিল। মা বলত, সারা দিন ধরে অপেক্ষা করি তোর এই ফোনের জন্য। কোনো দিন ফোন করতে দেরি হলে বা না করলে (কদাচিৎ) মা ব্যস্ত হয়ে পড়তেন, আমার বন্ধু চন্দনাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলতেন। আমার অবর্তমানে যখন মাকে দেখার কেউ ছিল না, চন্দনা মায়ের দেখাশোনা করা, ডাক্তার দেখানো থেকে শুরু করে মায়ের সব ইচ্ছাপূরণ করত। মা বেশির ভাগ অনুষ্ঠানে ওকে সঙ্গে নিয়েই যেত। মা ছিল আমার বিশেষ বন্ধু, মায়ের সঙ্গে যত রাগ, ভালোবাসা, মান-অভিমান, মনের কথা ভাগ করে নেওয়া একমাত্র মায়ের সঙ্গেই সম্ভব ছিল। একইভাবে মায়েরও আমি বন্ধু ছিলাম।

গত অক্টোবরের শুরুতে ফোনে মায়ের গলাটা ভালো লাগেনি। ডিসেম্বরে আমার আসার কথা ছিল। কিন্তু হঠাৎ মনে হলো মায়ের কাছে এখনই যাব, মাকে চমকে দেব হঠাৎ। বুঝিনি নিজেই এভাবে চমকে যাব। এরপর অক্টোবরে এসে এই প্রথম অনুভব করলাম মা ভীষণভাবে আমায় আঁকড়ে ধরতে চাইছেন। কোনো ভয়, অনিশ্চয়তা, একাকিত্ব মাকে গ্রাস করছে। দরজায় আমায় জড়িয়ে ধরে বলল, ‘তুই এসেছিস? আমায় ছেড়ে যাবি না তো?’ কোথায় মায়ের চোখেমুখে একটা ভয়ের ছাপ দেখেছিলাম সেদিন। বেশ কিছুদিন শরীরটা খারাপ যাচ্ছিল মায়ের। বলল, ‘আমায় একটা ডাক্তার দেখাবি? বুকের বাঁ দিকে মাঝেমধ্যে খুব ব্যথা করে।’ এরপর ডাক্তার দেখানো হলো। এত রোগ মায়ের শরীরে বাসা বেঁধে ছিল জানতাম না। ডাক্তারি পরীক্ষায় জানা গেল ও তার চিকিৎসাও হলো। সুস্থ করে নতুন বছরের ৫ জানুয়ারি মাকে বাড়ি নিয়ে এলাম। সবই ঠিক ছিল। তারপর ছন্দপতন। শারীরিক কষ্টের চেয়ে মানসিক অনেক কষ্ট নিয়ে মা চলে গেলেন, যা তাঁর প্রাপ্য ছিল না।

সদাচঞ্চল, প্রাণবন্ত, হাসিখুশি আমার মা যে এভাবে স্তব্ধ হয়ে যাবে ভাবিনি। আড়ালে চোখের জল ফেললেও, ধৈর্য ধরে সব কষ্ট বুকে চেপে রেখে, সবার সব দোষ তিনি আড়াল করে রাখতেন, বিশেষ করে তাঁর কাছের মানুষদের। মায়ের কাছ থেকে এটাও আমার শিক্ষা। দাদুকে, কাজী নজরুল ইসলামকে তিনি ধারণ করেছিলেন। আষ্টেপৃষ্ঠে নিজের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে রেখেছিলেন। তাঁর জীবনে বাঁচার অবলম্বন ছিল দাদুর কাজ, গান, তাঁকে নিয়ে গবেষণা। খুব ছোট বয়সে বাবাকে হারিয়েছি। একজন গৃহবধূ হয়ে কীভাবে সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে, অনেক অভাব–অনটন কাটিয়ে মা তাঁর তিন ছেলেমেয়েকে বড় করেছিলেন, তা ঈশ্বরই প্রত্যক্ষ করেছেন সেই সময়। শত কষ্টেও নিজের ও এই পরিবারের আত্মসম্মান খুইয়ে তিনি তাঁর বিত্তবান প্রকৌশলী বাবার আর্থিক সাহায্যও নেননি। যে সম্মান, ভালোবাসা তিনি পরিবারের কাছে খুঁজেও পাননি, তা আপনারা, আপনাদের মতো তাঁর বহু সহৃদয় শুভাকাঙ্ক্ষী তাঁকে শ্রদ্ধা করেছেন, অন্তর দিয়ে ভালোবেসেছেন তাঁকে, তাঁর গান ও তাঁর কাজকে। পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ ছাড়িয়ে প্রবাসের মানুষ তাঁকে যেভাবে ভালোবেসেছেন, তা ছিল তাঁর কাছে অমূল্য। যে যখন যেখানে তাঁকে ডেকেছেন দাদুর কাজে, মা নির্দ্বিধায় গেছেন মনের আনন্দে। দাদুর সৃষ্টিকে সবার মধ্যে বিলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। নাম, যশ, অর্থের প্রত্যাশায় মা কখনো কিছু করেননি। ‘বিষের বাঁশি’ মায়ের স্বপ্ন। এটি শুধু একটি গানের দলই নয়, বিষের বাঁশির মেয়েরা ছিল মায়ের পরিবার। মা ছিলেন তাদের ‘গুরুমা’... আমার অবর্তমানে মায়ের ছাত্রীরা, সোমঋতা ও তার মা, চন্দনা, প্রতিবেশী স্বপনদা, যারা মায়ের বাড়ির কাজকর্ম করত এবং মায়ের প্রচুর ভক্ত—এরাই ছিল মায়ের পরিবার। মা উজাড় করে তাঁর ভালোবাসা দিয়েছেন সবাইকে। পেয়েছেনও অনেক। কাজী পরিবারের বউ হিসেবে নিরলস পরিশ্রমে তিনি সযত্নে লালন করেছেন তাঁর জীবনে কাজী নজরুল ইসলাম ও তাঁর পরিবারকে। রক্তের সম্পর্ক নয়, বাড়ির বউ হিসেবে মা আগলে রেখেছিলেন সযত্নে এই পরিবারকে তাঁর ভালোবাসায়, শ্রদ্ধায় ও কাজের মধ্যে।

কোনো কাগজে মাকে নজরুল ইসলামের কন্যা হিসেবে সম্বোধন করায় মা আমায় উত্তেজিত হয়ে বলেছিলেন, ‘আমায় কন্যা লিখেছে, জানিস, পরের জন্মে আমি নজরুল ইসলামের কন্যা হয়েই জন্মাব, দেখিস। আমি বলেছিলাম, দাদুর তো কোনো মেয়ে ছিল না, তুমি তো আসলেই দাদুর মেয়ে। মা বললেন, বলছিস তাই? আমি বললাম, একথা সর্বৈব সত্য।’

অনেক অভিমানে, অনেক দুঃখ–কষ্ট সঙ্গে নিয়ে মায়ের দেহ পৃথিবী ছেড়েছে কিন্তু মা আমার সঙ্গে আছেন এটা অনুভব করি। মায়ের শরীর অসুস্থ হলেও তাঁর মাথা সক্রিয় ও সজাগ ছিল। চিকিৎসক সব সময় তাই বলতেন। মা সবকিছু বুঝতেন, অনুভব করতেন অসহায়তার কষ্টটা তাঁর খুব বেশি ছিল।

যেকোনো অবস্থায় মাকে পাশে পেয়েছি, অনেক সমস্যার সমাধান সহজে করে দিয়েছেন, অসম্ভব মনের জোর নিয়ে জীবনে অনেক লড়াই করেছেন নিজে, হারতে শেখেননি, হারেননি। লড়াই করে বাঁচতে শিখিয়েছেন আমায়। মা আমার সঙ্গে আমেরিকা চলে আসতে চেয়েছিলেন, শরীর সঙ্গ দেয়নি তাই শাহীন ও আমি আনতে পারিনি, মায়ের কবরের মাটি সঙ্গে নিয়ে এসেছি। মা আমার সঙ্গে আছে। মায়ের জামাই শাহীন তাঁর এক বন্ধু ও প্রিয় মানুষ ছিল। তাঁকে বলেছিলেন যে মা আমাদের কাছে আসবে। নিজের সম্মান নিয়ে, কারোর গলগ্রহ হয়ে মা কখনো বাঁচতে চাননি। শেষের কটা দিন যেভাবে কেটেছে, তা বোধ হয় তাঁর প্রাপ্য ছিল না। শেষ কয়েকটা দিন আমেরিকা থেকে পরিবারের কাছে মায়ের কোনো খবর না পাওয়ায় মিডিয়ার মাধ্যমে খবর পাই, ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি অবহেলায়, ফ্রি বেড-এ পড়ে থাকা আমার অসহায় মায়ের শেষ খবর দেন... খুব অসহায় লাগছিল নিজেরও। ভাবছিলাম, কেন মা-কে ছেড়ে এলাম।

সবাইকে একদিন এই পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিতে হবে। কার কত দিন আয়ু, তা আমরা কেউ জানি না। সেখানে বয়স কোনো বাধা মানে না। মা হয়তো চলে যেতেন কিন্তু মনে কোনো কষ্ট নিয়ে নয়, প্রকৃতির নিয়মে—এটাই চেয়েছিলাম। গত ছয় মাসে যে অন্তরঙ্গ মুহূর্ত কাটিয়েছি ২৪ ঘণ্টা/দিন-রাত একসঙ্গে, তা আমার জীবনের পরম সম্পদ। মা বলতেন, তোকে কিছু দিয়ে যেতে পারলাম না, আমার তো কিছু নেই, নিঃস্ব আমি। আমি বলতাম, দিয়েছ তো, নিজেকে উজাড় করে। মায়ের যত লেখা, কাজ যত্ন করে আমার জন্য রেখেছিলেন, আমার পরম সম্পদ সেগুলো। মায়ের শেষ ইচ্ছা ছিল তাঁর নিজের বাড়ি 74 H Purna Das Road, (Triangular Park)-তে দাদু ও ঠাকুমার স্মৃতির উদ্দেশে একটা আর্কাইভ হবে; যেখানে তাঁর লেখা, তাঁর প্রকাশিত বই, স্বরলিপির বই, দাদুকে নিয়ে লেখা ভারত–বাংলাদেশসহ পৃথিবীর যাঁর লেখা যত বই আর্কাইভে থাকবে। থাকবে দাদুর ব্যবহৃত মূল্যবান সোনার দুটি পদক, অরিজিনাল পাণ্ডুলিপি, দাদুর হাতে লেখা গানের খাতা, ঠাকুমার বিয়ের শাড়ি যা দাদুর দেওয়া ও আরও কিছু মূল্যবান জিনিস, যা মা তাঁর বড় ছেলে কাজী অনির্বানের কাছে রাখতে দিয়েছিলেন। তাঁর এ ইচ্ছাপূরণে ছায়ানট, বিষের বাঁশি এবং নজরুল ও আমার মায়ের অনুরাগীদের সঙ্গে চাই। আশা করি, সঙ্গে পাব। এই আর্কাইভের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা, নজরুল অনুরাগীরা তথা যাঁরা নজরুলকে নিয়ে গবেষণা, চর্চা করছেন তাঁরা উপকৃত হবেন। তিনি এ আর্কাইভের নাম ও ঠিক করে গেছেন। মা সব সময় বলতেন, ‘আমার যে কাজগুলো অসম্পূর্ণ রয়ে গেল, তা তুই শেষ করিস। দাদুকে নিয়ে যেমন কাজ করছিস দেশে–বিদেশে সেটা কখনো ছাড়িস না। দাদুকে, তাঁর কাজকে সবার কাছে পৌঁছে দিস তাঁর ও আমার যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে। লেখা-গান-আবৃত্তি ছাড়িস না কখনো, আমি তাহলে খুব কষ্ট পাব।’ যোগ্য কি না জানি না, তবে মায়ের শক্তি, তাঁর স্নেহ–ভালোবাসা আশীর্বাদের ছোঁয়া পাই সব সময়। সেই বলে বলীয়ান হয়ে মায়ের স্বপ্ন পূরণ করার কাজে অঙ্গীকারবদ্ধ হলাম। মাকে বলতাম, মা তোমার শতবর্ষ পালন করব। মা বলতেন, এত দিন বাঁচব কি? জীবনে কখনো কোনো অবস্থাতেই যিনি আমায় ছাড়েননি, সঙ্গী হয়ে পাশে থেকেছেন সব অবস্থায়, আজ তাঁর চলে যাওয়ায় সঙ্গীহারা অনাথ হলাম।

আরও পড়ুন

মা আছে আমার সঙ্গে আমার সব কাজে, তিনি আমাকে দিয়ে তাঁর সব অসম্পূর্ণ কাজ ও ইচ্ছা পূরণ করিয়ে নেবেন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস। যখন শেষবারের মতো মাকে দেখলাম, তখন মায়ের নিথর দেহ ও মুখের দিকে চেয়ে শুধু মনে হচ্ছিল, মা যেন বলছে—এত দেরি করলি কেন, আর একটু আগে আসতে পারলি না? কত অপেক্ষা করলাম তোর জন্য। মা যেন বলতে চাইছে, ‘আমি প্রেম পেতে এসেছিলাম, প্রেম দিতে এসেছিলাম। সেই প্রেম পেলাম না বলে প্রেমহীন নিরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরবিদায় নিলাম। যেদিন আমি চলে যাব, কত বড় বড় সভা হবে, কত প্রশংসা বেরোবে আমার নামে। ... সেই শ্রদ্ধা নিবেদনের শ্রাদ্ধবাসরে বন্ধু তুমি যেন যেয়ো না, যদি পারো চুপটি করে বসে আমার অলিখিত জীবনের কোনো একটা কথা স্মরণ করো। যদি মাটিতে পড়ে থাকা পায়ে পেষা একটা ফুল পাও, তবে সেটিকে বুকে নিয়ে বোলো, ‘বন্ধু, আমি তোমায় পেয়েছি।’
মেয়ে অনিন্দিতা কাজী