মেক্সিকোতে শেষ হলো তিন দিনের ক্রিয়েটিভ কমন্স গ্লোবাল সামিট
‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ও কমন্স’ থিম সামনে রেখে তিন দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্মেলন শেষ হলো ৬ অক্টোবর। এবারের এই আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় আমেরিকা মহাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক কেন্দ্রগুলোর একটি মেক্সিকো সিটিতে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সক্ষমতা ও ক্রমবর্ধমান ব্যবহারের সঙ্গে আইনগত এবং নৈতিক সম্পর্ক নিয়ে ভবিষ্যৎ পলিসি তৈরিতে ক্রিয়েটিভ কমন্সের ভূমিকা আলোচনা করতে সেন্ট্রো কালচারাল ইউনিভার্সিটিরিও টেটেলোলকোতে একত্রিত হয়েছিলেন বিশ্বের প্রায় ৩০০ ডেলিগেট।
এই গ্লোবাল সামিটে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে যোগ দেন গবেষক, গ্রন্থাগারিক, শিক্ষাবিদ, আইনজ্ঞ, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, সাংবাদিক, সংগীতজ্ঞ, সাংস্কৃতিক কর্মীসহ অনেকে। কোভিড-১৯ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ২০১৯ সালের পর এই প্রথম সিসি গ্লোবাল সামিট ফেস টু ফেস অনুষ্ঠিত হয়।
বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সক্ষমতা ও ক্রমবর্ধমান ব্যবহার বিশ্বজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। পদার্থবিদ্যার কোয়ান্টাম থিউরি চমৎকারভাবে একটি শিশুকে বুঝিয়ে দিতে সক্ষম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নতুন টুলস। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই নতুন ছবি তৈরি করতে পারে! বিষয়গুলো বিস্ময়ের। এ নিয়ে প্রযুক্তিবিদ, গবেষক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান—সবাই কমবেশি উদ্বিগ্ন। তেমনি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্ট ও কমন্সের সম্পর্কটি বেশ জটিল। এআই এবং ক্রিয়েটি কমন্সের সম্পর্ক উভয়ের জন্য উল্লেখযোগ্য সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
ক্রিয়েটিভ কমন্সের বর্তমান সিইও ক্যাথরিন স্টিহলার স্বাগত বক্তব্য দিয়ে শুরু হয় এবারের সম্মেলন। এরপর কি–নোট স্পিকিং প্রদান করেন ফ্রান্সিসকো জাভিয়ের টিটো। মেক্সিকো ন্যাশনাল সাউন্ড আরকাইভের জেনারেল ডিরেক্টর ফ্রান্সিসকো হলেন মেক্সিকোর একজন শব্দশিল্পী, সংগীতজ্ঞ ও গবেষক। এরপর একই ভেন্যুতে মূল বলরুম ছাড়াও আরও তিনটি পৃথক হলরুমে বিভিন্ন বিষয়ে প্রেজেন্টেশন, প্যানেল ডিসকাশন, লাইটনিং টকস, ওয়ার্কশপসহ নেটওয়ার্কিং সেশনগুলোয়: এআই (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) এবং দ্য কমন্স, ওপেন এক্সেস ওপেন, এডুকেশনাল রিসোর্সেস, কপিরাইট, ওপেন সোর্স সফটওয়্যার, ওপেন লাইসেন্সসহ বিভিন্ন সমসাময়িক বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়।
সামিটে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব
এই গ্লোবাল সম্মেলনে তিনজন বাংলাদেশি বাংলাদেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন। বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার অধ্যাপক মোস্তফা আজাদ কামাল প্যানেল আলোচনায় অংশ নিয়ে বর্তমানে ওপেন এডুকেশনাল রিসোর্সের ক্রমবর্ধমান ব্যবহার এবং বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের প্রয়োজনীয় ভূমিকা নিয়ে আলোকপাত করেন। করোনা মহামারি-পরবর্তী প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থায় কীভাবে ওইআর ভূমিকা রাখছে, বাংলাদেশ সরকারের কৌশল কী ছিল, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ওইআর পলিসি কীভাবে কাজ করবে, এর সঙ্গে কী কী চ্যালেঞ্জ সম্পর্কিত, তা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনায় তিনি বেশ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেছেন।
Eur-Lex ডেটাবেজ হতে পারে বাংলাদেশিদের জন্য মডেল
উল্লেখ্যযোগ্য আলোচনাগুলোর মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অফিশিয়াল টেক্সটগুলোয় ওপেন অ্যাকসেসের আইনি ইস্যু ও Eur-Lex ডেটাবেজে এআই ব্যবহারের প্রভাব নিয়ে আমি একটি আলোচনা সেশনে অংশ নিই। এ আলোচনায় দুজন বুলগেরিয়ান প্রতিনিধি আলোচনা করেন। অফিশিয়াল টেক্সট বলতে সরকারি আদেশ-নির্দেশাবলি, আদালতের মামলার সিদ্ধান্ত, অফিশিয়াল জার্নাল ইস্যু, ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যান্য পাবলিক নথিগুলোকে বোঝায়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পাবলিক নথির অফিশিয়াল ওয়েবসাইট হলো Eur-Lex। এ ডেটাবেজ ইইউর ২৪টি অফিশিয়াল ভাষায় প্রকাশিত। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অফিশিয়াল জার্নালও EUR-Lex-এ প্রকাশিত হয়। অফিশিয়াল টেক্সটগুলোয় একজন নাগরিকের অধিকার রয়েছে ফ্রি অ্যাকসেস করার। এ ধারণা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশেও ব্যাপক বিপ্লব ঘটানো সম্ভব।
এই প্যানেল আলোচনায় আরও অংশগ্রহণ করেন, জাপানের হোক্কাইডো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মোহাম্মদ গালিব হাসান আবীর।
মেক্সিকান স্ট্রিট ফুডের সন্ধানে
সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন আমরা তিন বাংলাদেশি সন্ধ্যায় হাঁটতে বের হই। আমরা যে হোটেলে ছিলাম, সেটি মেক্সিকো সিটির রিফর্মায় অবস্থিত। ট্রিপ অ্যাডভাইজার অনুযায়ী রিফর্মা মেক্সিকো সিটি, মেক্সিকো সিটির সবচেয়ে নিরাপদ এলাকার একটি। মেক্সিকো সিটির সবচেয়ে বিলাসবহুল হোটেলগুলো এখানেই। আশপাশের এলাকায় প্রচুর ট্যুরিস্ট। সুতরাং হাঁটাহাঁটির জন্য নিরাপদ। আমাদের হোটেলের এত কাছে মেক্সিকান বিপ্লবের স্মৃতিস্তম্ভ তা জানা ছিল না। রঙিন বর্ণে বর্ণিত এই আঁধারে বিপ্লবী মনুমেন্ট মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে নিজের বিজয়ী ভঙ্গিমায়। বিপ্লবী মনুমেন্টের সিমেন্ট বাঁধানো বিশাল খোলা প্রান্তরে হাঁটতে হাঁটতে পেয়ে যাই মেক্সিকান স্ট্রিট ফুড।
জ্বলন্ত আগুনে পোড়া ভুট্টার চেহারা দেখে লোভ সামলানো দায়। অন্যদিকে বাষ্পযুক্ত ভুট্টা কিংবা মেক্সিকান বড় বড় টর্টিলা দেখে খাবার লোভ পেলেও পেটে কারোই তেমন জায়গা খালি নেই।
হঠাৎ বোলভর্তি তাজা আম কাটা দেখে আমাদের সবার জিহ্বায় জল লকলক করে বেরিয়ে আসে। এবার লোভ সামলাতে না পেরে কিনে ফেলি। এক ফালি আমের টুকরা জিভে দিতেই পেয়ে যাই বাংলাদেশি স্বাদ। দামেও খুব সস্তা।
বাংলাদেশ দূতাবাস পরিদর্শন
সম্মেলনের তিন দিন হয়ে গেলেও তখন পর্যন্ত হোটেল আর সামিট ভেন্যু ছাড়া আমরা কেউ মেক্সিকো সিটি এক্সপ্লোর করতে বেরুতে পারিনি। মেক্সিকো সিটিতে যাওয়ার আগে আমি দূতাবাস অফিসে একটি ই–মেইল বার্তা লিখি। ই–মেইলের ত্বরিত উত্তর পাঠিয়ে দেয় দূতাবাস অফিস। এরপর দিনক্ষণ ঠিক হয় ৬ অক্টোবর দুপুর ১২টায় আমাদের নিমন্ত্রণ।
সেই সুবাদে মেক্সিকো সিটিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার আবিদা ইসলামের বিশেষ আমন্ত্রণে বাংলাদেশ দূতাবাস অফিস পরিদর্শনে যাওয়ার সুযোগ হয়। অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত তিনজন অতিথিকে নিয়ে দুপুরের খাবার খেতে খেতে হাইকমিশনার বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেন। কনফারেন্সে এসে এই প্রথম বাঙালি খাবার খেয়ে মনে হয় প্রাণ ফিরে পেলাম। সারা বিশ্বে বসবাসরত বাংলাদেশিরা যে অতিথি পাগল, তা হাইকমিশনার আবারও প্রমাণ করলেন। আমাদের আলোচনার মধ্যে স্থান পায় ক্রিয়েটিভ কমন্স, ওপেন অ্যাকসেস, ওপেন এডুকেশনাল মুভমেন্ট ছাড়াও মেক্সিকো সিটিতে বাংলাদেশিদের জন্য হাইকমিশন কর্তৃক গৃহীত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। এ সময় দূতাবাসের কাউন্সিলর শাহনাজ রানু ও স্থানীয় কর্মকর্তা মারিয়া উপস্থিত ছিলেন।
আমরা জেনে খুবই উচ্ছ্বসিত হলাম যে মেক্সিকো সিটিতে বাংলাদেশিদের জন্য প্রথম শহীদ মিনার রাষ্ট্রদূত আবিদা ইসলামের একনিষ্ঠ প্রচেষ্টার ফসল। মেক্সিকোর সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যসহ উচ্চশিক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও জ্ঞান–বিজ্ঞানের দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতামূলক বিভিন্ন প্রচেষ্টা সম্পর্কে আমাদের অবহিত করেন।
শেষের দিনের সন্ধ্যায় সেন্ট্রো কালচারাল ডি এস্পানা এন মেক্সিকোতে রেপআপ আলোচনায় উঠে আসে কীভাবে ক্রিয়েটিভ কমন্স ক্রমবর্ধমান আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভূমিকা রাখতে পারে। এ আলোচনায় চারজন বিশেষ কমনার্স অংশ নেন। তাঁরা হলেন আলবার্তো লোপেজ কুয়েনকা, ব্রিজিট ভেজিনা, বুকোলা জেমস ও প্যাট্রিসিয়া দিয়াজ। এরপর সংগীত পরিবেশন করেন মন্টাও-ইভান মার্টিনেজ। ডিজে পার্টি, নাচে–গানে আর অনেক আনন্দ উল্লাসের মধ্য দিয়ে পর্দা নামে ক্রিটিভ কমন্স গ্লোবাল সামিট ২০২৩–এর।