স্মৃতিধর আবু হেনা মোস্তফা কামাল
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় কক্ষে, বাংলা বিভাগের স্নাতকোত্তরের শেষ পর্বের ক্লাস। ‘ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই ছোট সে তরী’র অবস্থা। প্রথম ক্লাসে প্রথম দিন স্যার নাম ডাকছেন। প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীর নাম উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মুখচ্ছবি দেখে নিচ্ছেন। খাতায় চোখ রেখে নাম উচ্চারণ করা এবং মাথা তুলে নাম উচ্চারিত ছাত্রছাত্রীকে দেখা ও তাঁর কণ্ঠস্বর স্মৃতিতে রেকর্ড করা এ ধীরলয়ে কয়েক সেকেন্ড সময় অতিবাহিত হয়। নাম ডাকা শেষে খাতা বন্ধ করে বললেন, ‘আমি আর নাম ডাকব না, এটাই প্রথম ও শেষ। ১০ বছর পর আমি মিছিলে ওই কণ্ঠস্বর শুনে বলে দেব, ওইটা আবু ইয়াহিয়া দুলালের কণ্ঠস্বর। যদি বলতে না পারি, তাহলে আমি...’ বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে উচ্চারণ করে বললেন, ‘আমি এটার আবু হেনা।’ আমার সহপাঠীর নাম আবু ইয়াহিয়া দুলাল। কোনো এক কারণে এক বছর ক্লাস হয়নি, এক বছর পর নোটিশ বোর্ডে টিউটোরিয়াল পরীক্ষার তারিখ, সময়, কক্ষ নম্বর ও প্রশ্ন দেওয়া আছে। যথারীতি, যথাসময়ে সেই বিশাল কক্ষে সবাই প্রশ্নের উত্তর লিখতে মগ্ন। স্যার উত্তরপত্রে স্বাক্ষর দিচ্ছেন। স্যার পরম মমতায় আমার পিঠে তাঁর বাঁ হাত রেখে আমার পূর্ণ নাম উচ্চারণ করে স্বাক্ষরের জন্য উত্তরপত্র চাইলেন। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, স্যার, এক বছর হয়ে গেছে ক্লাস নেননি, এখনো আমার নাম মনে আছে? মৃদু হাসি উপহার দিয়ে বললেন, ‘হা হা হা, আমি আবু হেনা! দেন খাতা দেন।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় স্যারের প্রাপ্ত মার্ক দেখে সাক্ষাৎকার পর্বে এক স্যার তাঁকে বলেছিলেন, ‘তোমার এত মার্ক! তুমি তো বাংলায় ভর্তি হলেও পরে এই ডিপার্টমেন্টে থাকবে না।’ স্যার উত্তরে বলেছিলেন, ‘আবু হেনা যুগে যুগে জন্মায় না।’ নিজের প্রতি একজন মানুষ কতটা আত্মপ্রত্যয়ী হলে এমন কথা বলতে পারেন। স্যার যে অসাধারণ প্রতিভা ও স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন, এটা বিরল। স্যারের এই শক্তি নিশ্চয়ই উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত। বংশপরম্পরায় এ শক্তি অবশ্যই তাঁর উত্তরসূরিদের মধ্যেও আছে। তিনি নিজে তাঁর এই শক্তি সচেতনভাবে উপভোগ করতেন।
টিউটোরিয়াল পরীক্ষার উত্তরপত্র ফেরত দেওয়ার সময় স্যার বলে দিতেন কয়টা বানান ভুল হয়েছে এবং কী করা উচিত। ভুল বানানগুলো রঙিন কালিতে দাগ দিয়ে দিতেন এবং এ জন্য নম্বরও কাটতেন। স্যার এমনভাবে বানানের ভুল দেখতেন যে মনে হতো ম্যাগনিফাইং গ্লাসও তাঁর কাছে হার মানবে। আবু হেনা স্যার টিউটোরিয়ালের উত্তরপত্র দেওয়ার সময় এক ছাত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি শুদ্ধ বানানের জন্য কী অনুসরণ করেন?’ ছাত্রী বললেন, ‘স্যার, বানানের জন্য আমি ইত্তেফাক পত্রিকা দেখি।’ স্যার খুব শব্দ করে হেসে বললেন, ‘কোনো পত্রিকা আপনাকে শুদ্ধ বাংলা বানান উপহার দিতে পারে না। এ জন্য আপনি “চলন্তিকা” ও “সংসদ” বাংলা অভিধান ব্যবহার করবেন।’ বিস্ময়জাগানিয়া হৃদয়ে দেখি ও নিজেকেই প্রশ্ন করি, একজন শিক্ষক কী করে এত উচ্চ স্বরে প্রাণ খুলে হাসতে পারেন।
বাংলা বিভাগের স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শেষ বর্ষে, ৮টি কোর্সে ৩২টি টিউটোরিয়াল পরীক্ষা ছিল। এবং চূড়ান্ত পর্বে ৮টি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতো। মোট পরীক্ষা ছিল ৪০টি। আটটি কোর্সের জন্য আটজন শিক্ষক ছিলেন। আবু হেনা মোস্তফা কামাল স্যার, আহমদ শরীফ স্যার, কাজী দীন মুহম্মদ স্যার সবচেয়ে বড় রুমে ক্লাস নিতেন। আবু হেনা স্যার কখনো কোনো ছাত্রছাত্রীকে ‘তুমি’ সম্বোধনে কথা বলেননি। ক্লাসে সবার সঙ্গে ‘আপনি’ সম্বোধন করেই কথা বলতেন। ড. সাঈদ-উর-রহমান স্যারও ‘আপনি’ সম্বোধনে কথা বলতেন। ‘আপনি’ শব্দে আমি আজও আচ্ছন্ন হয়ে আছি।
সেই চম্পা নদীর তীর থেকে স্যার ক্লাসে এসে সব সময়ই গানের চরণ বা কবিতার লাইন বলে ক্লাস শুরু করতেন। ‘হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে ময়ূরের মতো নাচে রে।’ ‘মোর চেতনার রঙে পান্না হলো সবুজ।’ আবু হেনা স্যার আমাদের রবীন্দ্র সাহিত্য পড়াতেন। কবি নজরুল প্রসঙ্গে বললেন, ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রানী দেব খোঁপায় তারার ফুল’, বাংলা সংগীতের জগতে আগামী ১০০ বছরেও এ গান অতিক্রম করার মতো আর কোনো রোমান্টিক গান সৃষ্টি হবে না।
নিজের কবিতা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘টেবিলের ড্রয়ারে আমার লেখা কবিতার যে পাণ্ডুলিপি আছে, সেসব লেখা দিয়ে আমার আরও পাঁচটি কবিতার বই হতে পারে। আমি মনে করি, আমার ওই সব লেখা সূর্যের আলো দেখার অধিকার রাখে না।’ ক্ষণজন্মা, কবি, লেখক, গীতিকার, টিভি উপস্থাপক, স্মৃতিধর আবু হেনা মোস্তফা কামাল স্যারের প্রতি শ্রদ্ধা। তাঁর ছাত্র হতে পেরে আমি আনন্দিত ও গর্বিত।