ঘুরে এলাম নিউইয়র্ক শহর

ছবি: লেখক

খালাতো ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে জুন মাসের শেষাশেষি ছুটি নিয়ে রেখেছিলাম কাজে। আমাদের সান্তিয়াগো শহর থেকে আলাস্কা বিমানবন্দরে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা সময় লাগে নিউইয়র্কের জন এফ কেনেডি বিমানবন্দর যেতে। সফর শুরুর আগের রাত পর্যন্ত কাজ ছিল। কাজ থেকে ফিরে হুড়োহুড়ি করে স্যুটকেস গুছিয়ে বেশ রাত করেই আমরা ঘুমাতে গেলাম। ইদানীং আবহাওয়ার কারণে বা কম্পিউটার ইস্যুতে প্রায়ই ফ্লাইট ক্যানসেল হচ্ছে আর প্রতিটি ফ্লাইট তাই যাত্রীতে ভরা আর যেকোনো কারণে গেটে পৌঁছাতে দেরি হলেই আর সেই ফ্লাইটে উঠতে দিচ্ছে না ওরা। সুতরাং ভোরে উঠে তৈরি হয়েই উবার নিয়ে চলে গেলাম বিমানবন্দরে। এক স্যুটকেসের ওজন দুই পাউন্ড বেশি হওয়াতে অন্য স্যুটকেসে ওই দুই পাউন্ড ওজন সরানো ছাড়া আর কোনো সমস্যা হয়নি পথে।

ঝকঝকে রৌদ্রোজ্জ্বল একটা দিনে জন এফ কেনেডি বিমানবন্দরে নামলাম আমরা। তেমন গরম পড়েনি এখনো। খালু আমাদের নিতে এসেছেন। রাস্তার দুই পাশে সবুজ গাছপালা দেখতে দেখতে প্রায় ৪০ মিনিট পর আমরা পৌঁছালাম লং আইল্যান্ডে খালামণির বাসায়। রাতের খাবার খেয়ে একটু গল্প করে চলে গেলাম হোটেলে। পরের দুদিন বিয়ের কোনো আনুষ্ঠানিকতা নেই।

পরদিন সকালে হোটেল থেকে বাসে করে এমিটভিল রেলস্টেশন পৌঁছালাম। ট্রেনের টিকিট অনলাইনে করা যায়, অ্যাকটিভেট করতে হয় ট্রেনে, কিন্তু টিকিট না করলেও ম্যাক্সিমাম ভাড়া দিয়ে টিকিট করা যায় ট্রেনে। প্রায় ৪০ মিনিটের মতো লাগে লং আইল্যান্ড থেকে ট্রেনে করে নিউইয়র্ক সিটির পেন স্টেশনে পৌঁছাতে। ট্রেন থেকে আমেরিকার সবচেয়ে জনবহুল শহরের কিছু অংশ দেখতে দারুণ লাগল।

ট্রেন থেকে নেমে আমরা গেলাম অ্যাম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং দেখতে। পথে টাটকা ফল খেলাম, অনেকটা দেশের ঝাল-লবণ দিয়ে পেয়ারা বা আমড়া কিনে খাওয়ার মতো। শুধু মসলাটা টাহিন (মেক্সিকান ঝাল-লবণ)। নিউইয়র্ক শহরের ডাকনামে অ্যাম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং, যেটা ১০২ তলা, তৈরি হয়েছিল ১৯৩০-৩১ সালে। ইচ্ছা ছিল, ওপরে উঠব, কিন্তু কন্যা বেঁকে বসল, সে অত ওপরে উঠবে না। কিছু ছবি তুলে আমরা অলিগলি ঘুরে দুপুরের খাবার খেলাম। শহরে খাবারের দোকানগুলো ভীষণ মজার খাবারে ভরা। দেখলাম, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার, বিকেলে আমাদের একটা ব্রডওয়ে শো দেখার কথা। আমরা টিকিট কেটেছিলাম ডিজনি মুভি আলাদিনের। রাস্তার দুই পাশে সব নামী ব্র্যান্ডের জিনিসে ঠাসা।

সান্তিয়াগো থেকে যাওয়ার আগেই কাজের বন্ধুরা বলে দিয়েছিল, একটা ব্রডওয়ে শো দেখে তারপর যেন অন্য কোথাও যাওয়ার পরিকল্পনা করি। সময়ের আধা ঘণ্টা আগেই পৌঁছে গেলাম শো দেখতে। খুব সুশৃঙ্খলভাবে তাঁরা সবাইকে বসাচ্ছেন। আমাদের সিট তিনতলার ব্যালকনিতে। বসলাম, একটু পর শুরু হয়ে গেল শো। গান, নাচ, পটপরিবর্তন এবং অভিনয়, এ এক অনবদ্য ছন্দময় পারফরম্যান্স। মুগ্ধ হয়ে দেখলাম, ছেলের ভাষ্যমতে, আমি নাকি শিল্পীদের সঙ্গে হোল নিউ ওয়ার্ল্ড চিৎকার করে গেয়েছি। আলাদিন ছিল আমাদের গায়ের রঙের একটি ছেলে। শো শেষে বের হয়ে আবার ঝলমলে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার দেখে হোটেলে ফিরলাম আমরা। পুরো রাত মুগ্ধতা কাটল না। পরদিন রেড বাস ট্যুরের টিকিট কাটলাম শহরেরই। বাচ্চারা একটু বিরক্ত হয়েছিল এত হুড়োহুড়ি করে কেন টিকিট কাটতে গেলাম। ওরাই সঠিক ছিল, বলছি আমি কেন ভুল করেছি।

পরদিন সকালে উঠে খেয়াল করলাম, আগের দিন দৌড়ে দৌড়ে ঘোরার কারণে একটু টায়ার্ড লাগছে। ট্রেনে করে মোটামুটি দুপুরে ম্যানহাটন পৌঁছালাম। গরম আর হিউমিডির জন্য টায়ার্ড লাগছিল একটু বেশি যেন। সামনে ফোর্থ অব জুলাইয়ের ছুটি, মানুষের উপচে পড়া ভিড় সব জায়গায়। আমরা খাওয়া শেষে হেঁটে রেড বাস ছাড়ার নির্দিষ্ট জায়গায় গেলাম। আজ আমাদের বোটে করে স্ট্যাচু অব লিবার্টি দেখতে যাওয়ার কথা, যেটা এই বাস ট্যুরের সঙ্গে ইনক্লুডেড। রাস্তায় প্রচণ্ড ভিড়, বাংলাদেশের মতো হর্ন বাজিয়ে পথচারী বা অন্য বাস বা গাড়িতে বকা দিতে দিতে আমাদের বাসড্রাইভার বাস চালাচ্ছেন। শহরের এটাই নাকি রীতি, কিন্তু তিনটি স্টেশন যাওয়ার পর বুঝে গেলাম, দিনের শেষ বোট ছেড়ে দেবে আমরা পৌঁছানোর অনেক আগে। সুতরাং ট্যুরের টিকিট কিনে পুরো ম্যানহাটন এক দিনে দেখে ফেলার চিন্তা করা বোকামি হয়েছে। ডাউন টাইন সাইডই দেখে শেষ করতে পারব না।

আমরা নেমে গেলাম চায়না টাউনে। চায়নিজ দোকানে ঠাসা সব দোকান, একটা লণ্ঠন কেনার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু পেলাম না। এরপর দেখলাম লিটল ইতালি। লোকজন শপিং করছে আর খাচ্ছে। চারদিকে উৎসব উৎসব ভাব। সন্ধ্যা হতে হতে আমরা হোটেলে ফিরে গেলাম সেদিনকার মতো। হোটেলে নান কিং বলে ইন্ডিয়ান আর চায়নিজ খাবারের ফিউশনের দোকান আছে। খাবার মোটামুটি, না পারতে দুই-তিন বেলা খেতে হয়েছে সেখানে।

পরের কয়েক দিন কাজিনের মেহেদি অনুষ্ঠান, পরের দিন গায়েহলুদ আর বিয়েতে গেলাম। বহু বছর পর আমাদের এত বড় পরিবার আবার একত্র হয়েছে। পৃথিবীর কত জায়গা থেকে সবাই এসেছে। শুধু মনে হচ্ছিল, এ আনন্দহাট শেষ না হোক। কাজিনরা সবাই একই রঙের কাপড় পরছি, গাইছি, নাচছি, ছোটবেলায় ফিরে গেছি যেন। এক কাজিন আসিফকে ছোটবেলায় তোপসে হওয়ার জন্য সেধেছিলাম, সে শোনেনি। কী আশ্চর্য, এবারও রাজি হয়নি সে। আমার ফেলুদা হওয়ার স্বপ্ন, স্বপ্নই থেকে গেল। পরদিন ছিল ফোর্থ অব জুলাই। আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস।

আমরা আড়াই ঘণ্টার একটা বোট ট্যুরের টিকিট কেটেছিলাম। আবহাওয়া বলছে, আজ বৃষ্টি হবে। দুপুর নাগাদ পৌঁছে গেলাম হার্ডসন নদীর তীরে। বোট ট্যুরে যাব, দেখব লিবার্টি আইল্যান্ডে স্ট্যাচু অব লিবার্টিকে খুব কাছ থেকে। আজও অনেক মানুষের ভিড়। আমরা বোটের ছাদে চলে গেলাম, কেউ কেউ রোদের ভয়ে ছাতা মেলেছিলেন; কিন্তু গাইড বলে দিয়েছেন, ছাতা কোনোভাবেই ব্যবহার করা যাবে না। কিছু বিখ্যাত স্থাপনা, ব্রুকলিন ব্রিজসহ অনেক কিছু দেখতে দেখতে স্ট্যাচুর কাছাকাছি পৌঁছাতেই শুরু হয়ে গেল তুমুল বৃষ্টি। আমি মোটামুটি ভিজে ভিজেই এই স্ট্যাচু দেখলাম, মুগ্ধ হয়ে দেখলাম বিশ্বকে আলোকিত করা স্বাধীনতার আলোকচ্ছটা। অপূর্ব। ফেরার পথে হার্ডসন নদীতে সূর্যাস্ত দেখলাম। হোটেলে ফিরে রেডি হয়ে গেলাম খালামণির বাসায় শেষবারের মতো সবাইকে দেখতে। কয়েকজন কাজিন চলে গেছে তাদের গন্তব্যে। আমরা যারা তখনো ছিলাম সেখানে, একসঙ্গে কিছু ছবি তুললাম। পরদিন খুব সকাল সকাল সবুজ বনে ঘেরা রাস্তা দিয়ে আবার জে এফ কে বিমানবন্দরে পৌঁছে গেলাম। বাসায় চলে যাব, তবে পরের বার এসে সেন্ট্রাল পার্ক অবশ্যই দেখব।