অন্টারিওর লন্ডনে বাংলাদেশিদের একদিন

অনুষ্ঠানে আসা অতিথিদের একাংশ
ছবি: লেখক

বাংলাদেশ যখন গরমে হাঁসফাঁস করছে, ঠিক তখনই কানাডায় একটু একটু গরমের আমেজ পড়তে শুরু করছে। দীর্ঘ ৫-৬ মাসের ঠান্ডার আবরণ থেকে কানাডাবাসী আস্তে আস্তে বের হতে শুরু করছেন, গাছপালাও জানান দিচ্ছে তাদের সবুজ লতাপাতা গজানোর মধ্য দিয়ে। ঠিক এমন সময় স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়গামী ছাত্রছাত্রীরাও ব্যস্ত সময় পার করে এখন ফুরফুরে মেজাজে ঘোরাঘুরি করতে শুরু করছেন।

গত ৭-৮ মাসে এ শহরে এসেছে অনেক নতুন মুখ, ছাত্রছাত্রীসহ নতুন অভিবাসী। আবার এরই মধ্যে হয়ে গেল আমাদের দুটি বড় বড় উৎসব, ঈদ ও বাংলা নববর্ষ। আমাদের প্রবাসে এসব উৎসবগুলোই সাধারণত সবার মাঝে মেলবন্ধন তৈরি করে থাকে, বিশেষ করে নতুনদের সঙ্গে পুরোনোদের। একসঙ্গে অনেক মানুষের দেখা হয়, ভাবের বিনিময় হয়, ভালো–মন্দ কথা আদান-প্রদান হয়। বন্ধুত্ব তৈরি হয়। এরাই হয়ে ওঠে বিপদের বন্ধু। আর এভাবেই ধীরে ধীরে প্রবাসের বিভিন্ন শহরগুলো হয়ে ওঠে একেকটা ছোট বাংলাদেশ।

শিশুদের খেলা ও পুরস্কার বিতরণীর একাংশ
ছবি: সংগৃহীত

এবার উৎসব দুটি পরপর হওয়াতে সময় স্বল্পতায় আলাদা করে কমিউনিটির সবাইকে নিয়ে এক এক করে পালন না করে একসঙ্গে পালন করাই শ্রেয় মনে হয়েছে। তাই তো কানাডার লন্ডন শহরের বাংলাদেশিদের অনেক বছরের ভালোবাসায় গঠিত বিডি লন্ডন কমিউনিটি অন্টারিও, কানাডা এবারের অনুষ্ঠানটির নাম রাখে, ঈদ ও বৈশাখের আমেজে ‘পুনর্মিলনী ’২৪’।

অনুষ্ঠানটি যে আমাদের মিলনমেলায় পরিণত হয়, তার কয়েকটা যথাযথ কারণ আছে। অনুষ্ঠানে কয়েকজন নতুন, পুরোনো মুখের সঙ্গে কথা হলো। নতুনদের কেউ এসেছেন ফ্যানশো কলেজে পড়াশোনা করতে, কেউবা ওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে, আবার কেউবা নতুন অভিবাসী হিসেবে। নতুনদের একজন আকিব বললেন, এই শহরে তিনি এসেছেন গত ফল সেমিস্টারে ওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। আসার পর ক্লাসের, গবেষণার ব্যস্ততা, এরপর আবার বরফাচ্ছন্ন কানাডীয় শীত। একে তো দেশে মা-বাবাসহ আপনজনদের সদ্য রেখে আসা, আবার এখানে খুব বেশি দেশি মানুষকে না চেনার কারণে শুরুতেই তাঁকে এসবে মানায় নিতে বেশ কষ্ট করতে হচ্ছে। আর আজ একসঙ্গে অনেকগুলো দেশি মানুষের মুখ দেখে, তাদের আন্তরিকতা, ভালোবাসা দেখে এখন তাঁর মনে হচ্ছে, এটা দূরের কোনো শহর না, কানাডার লন্ডন শহরে একখণ্ড বাংলাদেশ। নিজে আর একা না, এরাই আমার বন্ধু, এরাই আমার আত্মীয়।

আয়োজকদের একাংশ
ছবি: সংগৃহীত

আমাদের এই পুনর্মিলনীতে শত শত পুরোনো মুখের মধ্যে একজন রাকিব হাসানের কথা বলি, তিনি এসেছেন আমাদের সবার সঙ্গে দেখা করার উদ্দেশে দুই শ কিলোমিটার দূরের শহর টরন্টো থেকে। তিনি লন্ডনে অনেক বছর ছিলেন, কিন্তু এখন চাকরির কারণে টরন্টোতে থাকেন। তাঁর কাছে অনুভূতি জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, লন্ডন তাঁর কাছে বাংলাদেশের পরই দ্বিতীয় বাড়ি। এখানকার লোকজন, আলো-বাতাস সবকিছুকে খুবই আপন করে নিয়েছেন, যা তাঁকে মাতৃভূমি বাংলাদেশে পরপরই স্থান করে দিয়েছে। আর সে জন্যই নিজেকে সতেজ রাখতে মাঝেমধ্যে ছুটে আসেন প্রাণের শহর, লন্ডনে।

এটির নাম হয়তো পুনর্মিলনী না রেখে বাংলাদেশিদের মেলাও রাখা যেত, কারণ এখানে যেমন অনেক শিশুদের সমাগম ছিল, ছিল অনেক মানুষের আগমন, ঠিক তেমনি ছিল অনেক খাবারের ও রকমারির জিনিসপত্রের সমারোহ। বাঙালির ঐতিহ্যবাহী নানা পদের খাবারের সঙ্গে ছিল বাঙালির ঐতিহ্যবাহী পোশাক, মেহেদিসহ রকমারির জিনিসপত্রের দোকান। খাবারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো নানা রকমের পিঠা, বিরিয়ানি, ঝালমুড়ি, পেঁয়াজু, নানা পদের ভর্তাসহ হরেক রকমের মিষ্টির সমারোহ। এসব যেমন বাঙালির খাবারের অমৃত স্বাদের কথা বারবার মনে করে দেয়, ঠিক তেমনি টুইগ অ্যান্ড ট্যাসলসের ঘরের সাজসজ্জা বৃদ্ধির জন্য নানা রকমের বাহারি ও আকর্ষণীয় জিনিসপত্র ও হোমওয়্যার হ্যাভেন অ্যান্ড এশিয়ান বিউটি বুটিক দোকানটিও তাদের মাটির তৈরি নানা প্রকারের ঘরের সৌন্দর্যবর্ধনের জিনিসপত্রগুলোও সবার নজর কাড়ে। এসব শৌখিন জিনিসপত্র দেখে সেই সুদূরে মাতৃভূমির কথাই মনে পড়ে, এসব যে আমাদের কারও মা-বাবা, ভাই-বোনদের হাতেই তৈরি হয়েছে।

চা-এর টংয়ের দোকান
ছবি: লেখক

দেশীয় নানা খাবার ও সাজসজ্জার মধ্যে আয়োজক কমিটির পক্ষ থেকে দেশীয় আমেজ তথা বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজজীবনের স্মৃতি নিয়ে নিয়ে আসার জন্য আমাদের কমিউনিটির অন্তঃপ্রাণ মুরাদ ভাই ‘চা–এর টং’ দোকান নামে একটি দোকান দিয়েছিলেন, যার লভ্যাংশ অনুষ্ঠানটি আয়োজনে ব্যয় করা হয়। চায়ের যেমন মজা সবার মন কেড়েছিল, তেমনি তার দোকানের পোস্টারটি সবার নজর কাড়ে।
পুরো অনুষ্ঠানটিকে নানা পর্বে ভাগ করা হয়। অনুষ্ঠানটি মাতিয়ে রাখে শিশুদের অঙ্কন, কবিতা, যেমন খুশি তেমন সাজোসহ বড়দের হাঁড়িভাঙা, নানা অঙ্গভঙ্গি করে বুঝিয়ে বলার মতো মজার মজার সব খেলা, আর পুরস্কার।

অবশেষে নানা কর্মযজ্ঞের পর আয়োজকেরা শিশুদের পারফর্ম করার জন্য প্রস্তুত করা, তাদের অভিভাবকদের সময় ও স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের জন্য, কিছু তরুণ উদ্যমী স্বেচ্ছাসেবক যাঁরা অনুষ্ঠানের অনেক আগে থেকেই নিরলস কাজ করে এসেছেন এবং সর্বোপরি অনুষ্ঠানটির পৃষ্ঠপোষকদের ও প্রাণপ্রিয় দর্শকদের বিশেষ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে এবং আগামী দিনে আবার দেখা হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে অনুষ্ঠানটির সমাপ্তি ঘোষণা করেন।

লেখক: নূর আলম, পোস্ট ডক্টরাল রিসার্চ ফেলো, ইউনিভার্সিটি অব নিউব্রান্সউইক, কানাডা ও আয়োজক কমিটির অন্যতম সদস্য।

দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]