মা দিবসে মাকে লেখা খোলাচিঠি
মা দিবস পালিত হয়েছে ১২ মে। প্রবাস থেকে পাঠানো পাঠকের লেখা থেকে বাছাই করা লেখা প্রকাশিত হচ্ছে দূর পরবাসে।
আমার মা, নিঃসন্দেহে দেখতে বেশ সুন্দর, কেন জানি সুন্দরী শব্দটি ব্যবহার করতে আমি খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি না। আমার মনে হয়, সুন্দরী একটা বিশেষণমাত্র, যা অনেকেই হতে পারে। কিন্তু সবাই সুন্দর হতে পারে না। সুন্দর হতে গেলে সুশ্রী চেহারার পাশাপাশি কিছু অভ্যন্তরীণ গুণাবলি লাগে।
আমার মায়ের প্রথম ছবিটি যে সময়ের, তখনো তিনি ঠিক মা হয়ে ওঠেননি, তাঁর বিয়ের কিছুদিন আগের ছবি, দ্বিতীয়টি বিয়ের পর... এবং শেষেরটা মা, শাশুড়ি, নানি, দাদি হয়ে যাওয়ার পর।
অনেকেই আমাকে আমার মায়ের কার্বন কপি বলেন। সম্ভবত তাঁরা আমার বাবাকে দেখেননি। অনেকে বলেন, আমি অনেকটা মায়ের মতো, কিন্তু আমি খুব ভালো করেই জানি, আমি দেখতে আমার মায়ের মতো না। না দেখতে, না স্বভাবে কোনো কিছুতেই মায়ের সঙ্গে আমার খুব একটা মিল নেই। খুব চিন্তা করে বললে আমি আমার মায়ের কাছ থেকে গায়ের রং ছাড়া (সেটাও লেটার মার্কস ৮০%, ২০% ঘাটতি) তেমন কিছুই পাইনি। আমার মায়ের প্রায় ফটোগ্রাফিক মেমোরি, তিনি কিছুই ভোলেন না আর আমার প্রায় কিছুই মনে থাকে না।
মা এমন একজন মানুষ, যিনি কোনো দিন কোনো বিষয়ে আমার সঙ্গে একমত হননি, হতে পারেননি।
আমি কিছু বলামাত্র তিনি আমার ঘোর বিরোধিতা করেছেন, এখনো করেন। একসময় আমার দৃঢ় ধারণা হলো, আমার যাবতীয় ভুল ধরার জন্য তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং কিছু কঠোর বিধান দিয়ে আমার পুরো জীবন আটকে ফেলতে তিনি সদা সচেষ্ট। আমার কোনো কিছুই তাঁর পছন্দ হয় না, কিছুই না, বই পড়া তো দুচোখের বিষ, আমার ঘর সাজানো, কাপড় ভাঁজ করা, হাতের লেখা, সূচের কাজ, রান্না, লেখালেখি, গান করা, নামাজ পড়া, গাছপালার যত্ন নেওয়া, শাড়ি কেনা ইত্যাদি কোনো কিছুই তাঁর পছন্দ না, এমনকি আমি চুপ করে থাকলেও তাঁর অসহ্য, কেন কিছু বলছি না। মায়ের ভাষায় আমার মাথায় বুদ্ধিশুদ্ধি এত কম যে আমি কীভাবে চাকরি/ব্যবসা, সংসার, সন্তান সামাল দিয়ে এত গাছপালা পালি, রান্না করি, লিখি যে কিনা নিজের মাথার চুলের যত্ন নিতে পারে না, এসব চিন্তায় তাঁর প্রেশার যুগ যুগ ধরে লো।
আমার সেই মা যখন অস্ট্রেলিয়া বেড়াতে এলেন তখন আমাকে দেখে, আমার কাজকর্ম দেখে, ১২০ কিলোমিটার/ঘন্টায় গাড়ি চালানো দেখে, আমার রান্না খেয়ে, লেখা পড়ে, সন্তান পালা দেখে আমাকে বলেছেন, তুই এগুলো কবে কখন শিখলি??! তুই তো সারা দিন গল্পের বই পড়তি, পরীক্ষার আগের দিন রাতেও!
বলেছিলাম, যখন সারা দিন আমার সঙ্গে বকাঝকা করতে তখনই হয়তো, কিন্তু তুমি সারাক্ষণ চিৎকার করতে বলে বুঝতে পারনি। তোমার অতিরিক্ত চিৎকার–চেঁচামেচির জ্বালায় আমি হয়তো আজ তেমন কিছুই হইনি, কিন্তু আমার সন্তানেরা যেন হয়, সেই দোয়া করো। কারণ, আমি তোমার মতো সারাক্ষণ বকাঝকা করে তাদের জীবন তেনা তেনা করে দিইনি। তাদের জীবন তাদের মতো চলে...সারা জীবন দেখেছি, মায়েরা মেয়েদের বন্ধু হয়, তুমি ছিলে আমার ঘরের শত্রু বিভীষণ।
মা, এখনো আমার ছোটবেলা মনে পড়লে আমি কখনোই চাই না তোমার মতো মা কেউ তার জীবনে পাক! শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য সব দুর্বিষহ করে দিয়েছিলে; আবার এ কথা শতভাগ সত্য যে আজকে আমি যতটুকু বা যতখানি, সেই অবদানও সম্পূর্ণ তোমারই।
এত কড়া শাসনে বড় করেছ বলেই হয়তো এখনো নিয়মশৃঙ্খলা মেনে চলতে কষ্ট হয় না, এত আদেশ–নিষেধ ছিল বলেই হয়তো এখন নিজেও আদেশ–নিষেধে বড় হওয়া আর ছেড়ে দিয়ে বড় করা মানুষের কথার পার্থক্য বুঝতে পারি। অনেক বেশি আচার-ব্যবহারের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে বলেই এখন যখন আচার-ব্যবহারবিহীন মানুষদের কথা শুনে কষ্ট পাই, তখন নিজেকে সামাল দিতে পারি, তাদের মতো করে উত্তর দিই না। অনেক বেশি নৈতিকতা শিখিয়েছ বলেই এখনো অনৈতিক মানুষদের ঘৃণা করি সর্বোপরি তোমার যন্ত্রণায় সারাক্ষণ বই পড়তাম বলেই যেকোনো চরিত্রের মানুষ দেখলে তার অভ্যন্তর সহজে পড়ে ফেলতে পারি।
মা, তোমার মতো বড় সমালোচক আমার কখনো কেউ ছিল না, এখনো নেই। তোমার জন্যই এখনো যখন যেটাই করি যথাসম্ভব ঠিকমতো করার চেষ্টা করি এবং কোনো ভুল হলো কি না সেই ভয়ে নিজ জগতে নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকি। কখনোই অন্যদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে মাথা ঘামাই না, ইচ্ছেও করে না; তাই কেউ ঘাঁটাতে এলেও প্রচণ্ড বিরক্ত হই।
আমি সাধারণত আমার পরিবারের কারও ছবি পোষ্ট করি না বা তাঁদের নিয়ে জনসম্মুখে লিখি না, নিজের ব্যক্তিগত জীবন ও ব্যক্তিগত জীবনের মানুষদের পর্দার আড়ালে রাখতে পছন্দ করি। আজ নিয়মের ব্যতিক্রম করলাম। আমার মা বেশ অসুস্থ, বেশ কিছু শারীরিক সমস্যায় তিনি অনেক দিন ধরে ভুগছেন; সঙ্গে প্রেশার লো এবং এসব দেখতে দেখতে আমার প্রেশার হাই।
এখন মায়ের তিন ছেলেমেয়েই তাঁর থেকে দূরে থাকে। মায়ের আগের মতো চিৎকার–চেঁচামেচি করতে হয় না, এখন যতটুকু করেন অসুস্থ আব্বার সঙ্গে! এ ছাড়া অখণ্ড অবসর। মা, দোয়া করি তোমার আর আব্বার ব্যথাবিহীন, চিৎকারবিহীন স্বস্তির জীবনের। আল্লাহ তোমাদেরসহ পৃথিবীর সব মা-বাবার নেক হায়াত বৃদ্ধি করুন।
লেখক: শায়লা জাবীন, মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া
*দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]