জেলখানা তো নয় যেন ‘হলিডে ইন প্যারাডাইস’

সুইডেনের পুলিশছবি: সংগৃহীত

দেশটির লোকসংখ্যা মাত্র এক কোটি। আয়তনে দেশটি বাংলাদেশের চেয়ে তিন গুণ বড়। এখানকার লোকসংখ্যার শতভাগই শিক্ষিত। আর্থিক অবস্থা, নাগরিকদের সুযোগ–সুবিধা যেমন অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সব দিক দিয়ে বিশ্বের সেরা দেশগুলোর সারিতে। সেদেশে প্রতি এক লাখ নাগরিকের জন্য রয়েছে ৩০০ পুলিশ। তারপরও জনগণের জীবনের শতভাগ নিরাপত্তা দিতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে দেশটি। কারণ, বেশির ভাগ পুলিশের সময় ব্যয় হচ্ছে সাইবার অ্যাটাক, নারকোটিক ক্রাইম এবং খুনখারাবির পেছনে। সে ক্ষেত্রে ভাবুন তাহলে কী পরিমাণ সমস্যা দেশটিতে বিরাজ করছে। আমি সুইডেনের কথা বলছি।
অন্যদিকে বাংলাদেশ পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে দেশে এক লাখ মানুষের নিরাপত্তায় নিয়োজিত রয়েছেন ১২০ জন পুলিশ সদস্য। সেখানে ভারতে ১৫০ জন, যুক্তরাষ্ট্রে ২৮৪ জন পুলিশ সদস্য নিয়োজিত রয়েছেন। বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল দেশ যেখানে দুর্নীতি এবং অনীতিতে ভরপুর, তারপরও দেশটির পুলিশের দক্ষতা বিশ্বের যেকোনো দেশের চেয়ে ভালো বলে আমি মনে করি। ধন্যবাদ বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীকে তাদের এই বিচক্ষণ পারদর্শিতার জন্য।

এবার আসি সুইডেনের বিচার বিভাগ এবং সাজার ধরনের ওপর। বহিঃশত্রুকে খুন করলে হিরো; আর ঘরের শত্রুকে খুন করলে জিরো। আমার ধারণা ছিল, পৃথিবীর সর্বত্র এমন অবস্থা যখন ছোটবেলায় আমি বাংলাদেশে ছিলাম। বাইরের কেউ যখন নিজের দেশকে আক্রমণ করে তখন দেশ রক্ষার্থে আক্রমণকারীকে খুন করলে আমরা হই বীর বিক্রম, বীর প্রতীক, বীরশ্রেষ্ঠ বা বীর উত্তম। কিন্তু যদি কেউ নিজের পরিবার বা আপনজনকে আক্রমণ করে এবং যদি আক্রমণকারীকে খুন করা হয়, তখন কিন্তু জেলহাজত।
আইন নিজের হাতে নেওয়া বেআইনি বিধায় জেলহাজত অনিবার্য। একটি দেশ বলতে কী বোঝায়? পরিবার, সমাজ, ভৌগোলিক আয়তন। বহিঃশত্রুর মোকাবিলায় হিরো, অথচ দেশের কেউ একই কাজ করলে শাস্তি নিশ্চিত এবং এ আইন সারা বিশ্বে রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বেশ ভেবেছি কারণ, আমার কাছে বিষয়টি পরিষ্কার না।

আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর আগের কথা। আমি তখন স্টকহোমের অদূরে ছোট্ট একটি শহরে বসবাস করি। কোনো এক শীতের সন্ধ্যায় এক বন্ধুর বাড়িতে চোর দরজা খুলে ঘরে ঢুকতে চেষ্টা করছে। বন্ধু টের পেয়ে চিৎকার করে, চোর সিঁড়ি দিয়ে তাড়াহুড়া করে পালাতে গিয়ে বরফের কারণে পিছলে পড়ে পায়ে ভীষণ আঘাত পায়। বন্ধু তাকে ধরে এবং পুলিশে ফোন করে। পুলিশ তৎক্ষণাৎ এসে হাজির হয় এবং তাকে পুলিশ স্টেশনে নিয়ে যায়। জানা যায়, সে পূর্ব ইউরোপের কোনো এক দেশ থেকে এসেছে। সে জেনেছে যে সুইডেনে ঢুকে ছোটখাটো অন্যায় করলে বা চুরি করলে মাসখানেক জেল হয়। তার ধারণায়, সুইডিশ জেলে থাকা মানে নূ৵নতম তিন তারকা হোটেলের সুযোগ–সুবিধা এবং প্রতিদিন তার একটি ভাতার ব্যবস্থা থাকে। সব মিলিয়ে মাসখানেক সুইডিশ জেলে থাকার মতো সুযোগ করে নিতে পারলে হোটেলে থাকা-খাওয়ার পরে যে অর্থ পাবে, তা তার দেশের এক বছরের আয়ের সমান। জেনেশুনেই তারা এ ধরনের অপরাধ করতে সুইডেনে ঢুকে থাকে। মজার বিষয় হচ্ছে, পুলিশের হাতে ধরা পড়া চোর উল্টা আমার বন্ধুর নামে মামলা করে।

সুইডেনে যদি কেউ খুন করে এবং যদি সে অন্য দেশের হয়, তবে সে বিনা খরচে আইনি সাহায্য পাওয়ার অধিকার রাখে। সোজা কথায়, অভিযুক্ত ‘অপরাধীর’ অপরাধ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত সে আইনি সহায়তা পাবে এবং রাষ্ট্র সেটি নিশ্চিত করে থাকে।
বন্ধু কোর্টে গেল এবং কারণ জিজ্ঞাসা করল তার অপরাধের। জানতে পারে যে চোর ভয়ে দৌড়ে পালাতে গিয়ে সিঁড়ি থেকে পড়ে পা ভাঙার জন্য বন্ধু দায়ী। বন্ধু প্রতিবাদ করে এবং কারণ জানতে চায়। জজ সাহেব উত্তরে বলেছিলেন, ‘তুমি যদি সিঁড়ির বরফ পরিষ্কার করে রাখতে তাহলে সিঁড়ি পিচ্ছিল হতো না এবং বেচারার পা ভাঙত না।’ বন্ধু জজ সাহেবকে প্রশ্ন করে, ‘আপনি সুস্থ আছেন তো? আমার বাড়িতে চোর চুরি করতে এসেছে, আমাকে দেখে দৌড়ে পালাতে গিয়ে সে পড়েছে। তার তো আমার বাড়ির সামনে আসার কথাই না।’ জজ সাহেব বলেছিলেন, ‘তার জন্য তার শাস্তি হবে। তবে তোমার দুই হাজার ক্রোনার জরিমানা। কারণ, বরফ পরিষ্কার করোনি সময়মতো।’
বন্ধুর সব কথা শুনে আমার মেজাজ সেদিন সত্যিই খারাপ হয়েছিল এবং ইচ্ছা হয়েছিল, নতুন করে পড়াশোনা শুরু করি আইনের ওপর। সুইডেনের আইনের বিশ্লেষণ হলো, আইন মানুষের জন্য। অতএব তার ব্যবহার ন্যায্য হতে হবে।

আমার বন্ধু তার উকিলের মাধ্যমে সেদিন ২ হাজার ক্রোনার জরিমানা মওকুফের জন্য ১০ হাজার ক্রোনার খরচ করেছিল। আইনের ওপর ভালোই রাগ হয়েছিল তার সেদিন এবং প্রেস্টিজে লেগেছিল। তাই সেদিন অর্থনৈতিক দণ্ড দিয়েছিল, তবু জরিমানা দেয়নি। বন্ধুর কথা শুনে আমি ভেবেছিলাম চোর বিদেশি এবং সুইডেনে থাকার পারমিশন নেই, মরে গেলে বা বড় ধরনের ক্ষতি হলেও কিছু হবে না। কারণ, সে বহিঃশত্রু। কিন্তু না, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে। বেআইনি কোনো কিছুর বিশেষ কোনো জায়গা নেই সুইডেনে।
আমরা একই পৃথিবীতে বাস করছি। কিন্তু ভাবতে অবাক লাগে যখন মাঝেমধ্যে দেখি, বাংলাদেশে নিরাপরাধ অনেক মানুষ বছরের পর বছর জেলে পড়ে আছে বিনা বিচারে এবং বিনা কারণে।

এদিকে সুইডেনে বড় বড় অপরাধী হওয়া সত্ত্বেও মানবিক সাহায্যসহ হাজারো সুযোগ–সুবিধা ভোগ করছে। এ কেমন বিচার বা অবিচার! অমানুষিক কাজ করার পরেও বিচার–বিবেচনার কাঠগড়ায় বিবেচিত হওয়ার সুযোগ যদি হিউম্যান রাইটস হয়, তাহলে সুইডেনে সেটি আছে। যা পৃথিবীর অন্য কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই।
সুইডেনে সাজার ধরন তুলনামূলক কম কঠোর। সবচেয়ে গুরুতর অপরাধীদের কারাদণ্ডও কদাচিৎ ১০ বছর অতিক্রম করত অতীতে সেটা এখন বাড়ানো হয়েছে। যাবজ্জীবন সাজা পেলেও তা কমিয়ে নির্দিষ্ট মেয়াদে কারাভোগের আবেদন জানানোর সুযোগ রয়েছে। বিশ্বের নানা দেশের মানুষের বসত সুইডেনে তারা যখন জানতে পেরেছে সাজা কম, জেলখানা তো না, এ তো হোটেল। সমস্যা কি জেলে ঢুকতে? আমি নিজের চোখে দেখেছি, সাজাপ্রাপ্ত রুশ আসামি সারা দিন পার্টি করছে। কারণ, সে সুইডেনের জেলে ঢুকবে এক মাসের জন্য। তার অপরাধ মদ খেয়ে গাড়ি চালিয়ে দুর্ঘটনা ঘটায় এবং পালিয়ে মস্কোয় ফিরে যায়। পরে রুশ পুলিশ তাকে খুঁজে বের করে এবং সুইডেনে ফেরত পাঠায়। ভদ্রলোক জানতেন না তখন সুইডেনের কারাগার ও শাস্তি সম্পর্কে। পরে যখন আদালতে বিচার হয় এবং দোষী সাব্যস্ত হয়ে সুইডেনে সাজা খাটতে আসেন, সাজা শেষে রাশিয়ায় ফেরার পথে বলেছিলেন, জেলখানার সময়টি ছিল তাঁর ভাষায়, ‘হলিডে ইন প্যারাডাইস।’