বিশ্ব শিক্ষক দিবসে সব শিক্ষকের প্রতি সম্মান জানাতে গিয়ে আমার মন স্বভাবতই ছুটে যায় মা–বাবার কাছে। কারণ, পৃথিবীর কোনো শ্রেণিকক্ষ, বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা পাঠশালার আগে আমার শিক্ষা শুরু হয়েছিল ঘরেই—মায়ের আঁচল আর বাবার শাসনের ভেতর দিয়ে।
আমরা প্রায়ই ভুলে যাই, শিক্ষার সূচনা বই কিংবা বোর্ডে নয়; বরং ঘরের ভেতরেই। ‘প্রথম শিক্ষা মায়ের কোলেই শুরু হয়’, এই সত্য ইতিহাসের প্রতিটি সভ্যতাই স্বীকার করেছে। প্রাচীন ভারতীয় গুরুকুলে যেমন সন্তানকে প্রথম পাঠ শেখাতেন মা, তেমনি গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসও বলেছিলেন, ‘কোনো রাষ্ট্রের ভিত্তি জানতে চাইলে দেখো, সেই রাষ্ট্রের শিশুরা কেমন শিক্ষা পাচ্ছে।’ আর সেই প্রথম শিক্ষালয় হলো পরিবার।
আজ ভোরে সংবাদমাধ্যমে দেখলাম, ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস আসছে। ভাবতে লাগলাম, প্রতিবছর আমরা কত শিক্ষাবিদকে স্মরণ করি, অথচ যাঁদের হাত ধরে আমাদের চরিত্র, নীতি আর মানবিকতার ভিত গড়ে ওঠে, সেই মা–বাবা সম্পর্কে কত সামান্যই বলা হয়!
আমার শৈশবের শিক্ষা ছিল ভিন্নধর্মী। মা ছিলেন স্নেহময়ী ছাত্রীসুলভ শিক্ষক। লেখাপড়ায় সাহায্য করতেন, কিন্তু খাওয়ার সময় অঙ্কে গরমিল করতেন। আমি এক চামচ ঝোল চাইলে, তিনি ঝোলের সঙ্গে মাছের টুকরা ঢুকিয়ে দিতেন। বাবার কাছে চাইলে তিনি উল্টো বলতেন, ‘যতটুকু পেয়েছো, সেটা আগে শেষ করো, পরে দেখা যাবে।’
মাকে রাগ করে ইংরেজিতে কিছু বললে তিনি হেসে দিতেন, মনে হতো কিছুই বোঝেননি। কিন্তু বাবা ঠিকই বুঝতেন; ভুল ইংরেজি বললে কান ধরে শাসন করতেন।
মা না খেয়ে বলতেন খেয়েছি, খিদে নেই, তোরা খেয়ে নে। পরে বুঝেছি, খাবার কম হলে উনি আমাদের আগে খাওয়াতেন। বাবা নিজের ক্ষুধা গোপন করে বলতেন, ‘তোমরা খাও, আমি পরে খাব।’
মা ছিলেন বোকা, কলুর বলদের মতো রান্নাঘরে ঢুকে আর বেরোতে পারেননি। জীবন কাটিয়েছেন কঠিন সংগ্রামের ভেতর দিয়ে। বাবা ছিলেন কঠিন, ঝড়–বৃষ্টি–রোদে সংসারের ভার কাঁধে নিয়েছেন।
মা–বাবা দুজনই ছিলেন পাহারাদার। সন্ধ্যা হলে বাড়িতে না ফিরলে খবর ছিল। সংসার চালিয়েছেন নীরবে, আমাদের কষ্ট বুঝতে দেননি। কখনো নির্লজ্জ, কখনো বেহায়া হয়ে আমাদের ঘরের বিছানা পর্যন্ত গুছিয়ে দিয়েছেন, খোঁজ নিয়েছেন কেমন চলছে জীবন।
মায়ের কমনসেন্স ছিল কিছুটা কম, বাবার একটু বেশি। মা প্লেট ফাঁকা দেখলেই খাবার ভরতেন, বাবা বলতেন, ‘অতিরিক্ত খেয়ো না।’ মা ছিলেন কেয়ারলেস—নিজের যন্ত্রণা ভুলে যেতেন। বাবা ছিলেন কেয়ারফুল—সংসারের ভার টেনে নিতেন চুপচাপ।
মনে হতো দুজনই ছিলেন আনস্মার্ট। মা দামি শাড়ি–গয়না পরতেন না। বাবা গাড়ি, বাড়ি ও আড্ডা নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। তবুও তাঁরা আমাদের স্বপ্ন বড় করতে শতভাগ সাহায্য করেছেন।
দুজনই ছিলেন স্বার্থপর—নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন, নিজেদের ঘাম ঝরিয়ে পরিবারের স্বপ্ন গড়তে।
দূর পরবাসে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই–মেইল: [email protected]
মা–বাবা জীবনভর আমাদের দিয়েছেন শুধু ভালোবাসা। আর আমরা সন্তানেরা? কষ্ট দিয়েছি, অবহেলা করেছি অথচ তাঁরা বদলাননি। প্রতিদিন আমাদের জন্য একই দোয়া, একই মায়া। বড় হয়েও আমরা তাঁদের উপেক্ষার বোঝা চাপিয়েছি। তবুও মা–বাবা প্রার্থনায় বসে আমাদের জন্য হাত তুলেছেন। সারা জীবন তাঁরা শুধু একটাই প্রতিদান চেয়েছেন, দিনে একবার হলেও সন্তানের মুখে শুনতে চান, ‘মা’ বা ‘বাবা’।
আমরা কতটা নির্বোধ! মা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ডাক, বাবা তাঁর সবচেয়ে বড় ছায়া। আসলে মা–বাবা কী জিনিস, সেটা সেই বোঝে, যার কাছে তাঁরা নেই।
মা–বাবার শাসনের ভিন্নতা আমি বড় হয়ে বুঝেছি। মানুষ হতে হলে কী শিক্ষা, কেন শিক্ষা, শিক্ষার ধরন কেমন হবে—এ প্রতিটি প্রশ্নের সঠিক উত্তর তাঁরা তাঁদের জীবন দিয়ে আমাদের শিখিয়েছেন। হয়তো সেই ভিন্নতার কারণেই আমি বাংলাদেশের পাড়াগাঁয়ের সীমা পেরিয়ে বিশ্ব নাগরিক হওয়ার পথে হাঁটতে পেরেছি।
আমার বাবা বাংলাদেশ পুলিশের একজন কর্মকর্তা ছিলেন। চাকরি শুরু করেছিলেন ব্রিটিশ আমলে, শেষ করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা হাতে নিয়ে। তাঁর জীবন ছিল শৃঙ্খলা, ত্যাগ ও সংগ্রামের প্রতীক। মা সামলেছেন পুরো পরিবার, পাশাপাশি সমাজকল্যাণেও যুক্ত থেকেছেন নিঃস্বার্থভাবে।
গতকাল সহধর্মিণীর সঙ্গে মা–বাবাকে নিয়ে কথা হচ্ছিল। আলোচনার শেষে আমি বলি, আমার মা–বাবা অতি সাধারণ পরিবেশে থেকেও আমাদের এতগুলো ভাই–বোনকে সৃজনশীল শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পেরেছেন, যেন পুরো পৃথিবীর অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা আমাদের জন্য সংগ্রহ করেছেন। তাঁরা জীবনের প্রায় শেষ ২০ বছর বাংলাদেশ ও ইউরোপ—দুই নাগরিকত্বেই কাটিয়েছেন, যা একটি গরিব পরিবারের জন্য সত্যিই বিরল।
আমার সহধর্মিণী মারিয়া সরাসরি উত্তর দিলেন, ‘তাঁরা ডিজার্ভ করেন। তাঁদের ত্যাগ, কঠোর পরিশ্রম ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তোমাদের বিশ্বনাগরিক বানিয়েছেন। তাঁদের জীবন ব্যতিক্রম হবে, এটাই স্বাভাবিক।’
কথাটা শোনার পরই আমার মধ্যে অজানা দায়বদ্ধতা আরও গভীর হলো।
আসলে মা–বাবা শুধু অভিভাবক নন, তাঁরা জীবন্ত পাঠ্যপুস্তক। প্রতিটি ছোট কাজে লুকিয়ে থাকে বড় শিক্ষা। মায়ের নিঃশব্দ ত্যাগ আমাকে শিখিয়েছে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। বাবার কঠোর শাসন আমাকে শিখিয়েছে নীতি, শৃঙ্খলা ও দায়িত্ববোধ। দুজনের মিলিত শিক্ষা আমাকে শিখিয়েছে মানুষ হওয়া, শুধু ডিগ্রি পাওয়া নয়।
আজকের দিনে সন্তানেরা মা–বাবাকে বোঝা ভাবে, প্রযুক্তির ভিড়ে তাঁদের শিক্ষা ভুলে যায়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, স্কুল–কলেজের জ্ঞান হয়তো চাকরি এনে দেবে, কিন্তু মা–বাবার শিক্ষা চরিত্র গড়বে। আর চরিত্র ছাড়া জ্ঞান অন্ধ। তাই যত দিন মা–বাবা জীবিত, তাঁদের শিক্ষাকে সম্মান করতে হবে। কারণ, তাঁরা আমাদের প্রথম শিক্ষক এবং মৃত্যুর পরও তাঁদের শিক্ষা আমাদের জীবনে পথপ্রদর্শক হয়ে থাকবে।
আমি এ লেখাটি আমার মা–বাবার জন্য লিখেছি। তবে এটিকে উৎসর্গ করছি বিশ্বজুড়ে সব মা–বাবাকে, যাঁরা আমাদের হৃদয় দিয়ে শিখিয়েছেন দৈনন্দিন শিক্ষা, মানবিক শিক্ষা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক শিক্ষা, যোগাযোগের শিক্ষা, সর্বোপরি নীতি ও নৈতিকতার শিক্ষা। মা–বাবা আমাদের জন্য শুধু শিক্ষক নন; তাঁরা আমাদের জীবনের প্রথম ও চিরন্তন পথপ্রদর্শক। তাঁদের ভালোবাসা, ত্যাগ ও শিক্ষা আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপে ছায়ার মতো থাকে, যা আমরা হয়তো বুঝি না। কিন্তু যা আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।
আজ যাঁদের মা–বাবা নেই, তাঁদের জন্য এই স্মৃতি হোক সান্ত্বনার আলো। কারণ, তাঁদের রেখে যাওয়া শিক্ষা ও দোয়া অদৃশ্য আশ্রয়ের মতো আজও আমাদের পথ দেখায়। আর যাঁদের মা–বাবা বেঁচে আছেন, তাঁদের জন্য এই লেখা হোক এক মৃদু স্মরণ—একবার হলেও মায়ের হাত ধরে বলুন, ‘তুমি আমার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক’ এবং বাবার চোখে চোখ রেখে বলুন, ‘তুমি আমার জীবনের প্রথম দিশারি।’
বিশ্ব শিক্ষক দিবসে তাই আমার শ্রদ্ধা প্রথমেই মা–বাবার প্রতি, যাঁরা আমাদের শিখিয়েছেন কীভাবে গুরুজনদের সম্মান করতে হয়। এই মুহূর্তে মনে পড়ে গেল কাজী কাদের নেওয়াজের কবিতা ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’–এর শেষ দুটি লাইন—
‘আজ হতে চির–উন্নত হলো শিক্ষাগুরুর শির,
সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ আলমগীর।’
এ কবিতায় শিক্ষকের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রকাশিত হয়েছে। মা–বাবা ও শিক্ষক—উভয়ই আমাদের জীবনের প্রথম ও চিরন্তন পথপ্রদর্শক। তাঁদের শিক্ষা ও ভালোবাসা আমাদের সঙ্গে চলমান থাকুক আজীবন।