জন্ম থেকেই বৈষম্য: দূর হবে কবে?

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

বৈষম্য আন্দোলনের ফসল, স্বৈরাচারের বিদায়, সেটা বাংলাদেশের মানুষ ঘরে তুলে আজ আনন্দে আছে। নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার, যা–ই বলুন না কেন, সেটা আজ সত্যি। সফলতা এ আন্দোলনে এমনিতেই আসেনি। প্রাণ ঝরেছে ছাত্র–জনতার। আহত হয়েছেন আরও হাজারো মানুষ। পালিয়ে বেড়াচ্ছেন অনেকেই, সে সংখ্যাও হাজারের কম নয়। বিদেশে পাচার হয়েছে প্রচুর পরিমাণ অর্থ। সে সংখ্যা হাজারের পরিমাণে লেখা যাবে না। এত কিছুর পরও আমরা বাংলাদেশিরা সুখী ও খুশি। স্বৈরাচার তো বিদায় হয়েছে।

কিন্তু আমাদের সমাজে যে আরও অনেক স্বৈরাচার লুকিয়ে আছে, তাদের কী হবে? যে স্বৈরাচার রয়েছে আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে, ঘরে ঘরে, রয়েছে মিশে আমাদের রক্তে। বৈষম্য নামক ভাইরাস নামে।

জন্ম থেকেই বৈষম্য হয়ে আসছে মেয়েসন্তানের সঙ্গে। বাল্যকাল থেকে কৈশোর পেরিয়ে যুবতী, সেখান থেকে অন্যের সংসারে তার স্থানান্তর। সর্বস্তরেই মেয়েটির সঙ্গে চলে বৈষম্যমূলক আচরণ। এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে এই বৈষম্য ধর্ম বা কৃষ্টির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এ বৈষম্য দৃষ্টিগোচর হচ্ছে সব ধর্মে, সব কৃষ্টিতে, সব আঙিনায়। এর মাত্রা, আকার ও প্রকার যদিও–বা ভিন্ন। অন্ধকার যুগে গলাটিপে মেরে ফেলা হতো সদ্যোজাত মেয়েকে। মধ্যযুগে মেয়েরা ছিল ভোগের উপকরণ আর বর্তমান যুগে মেয়েরা ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন বৈষম্যের শিকার। কোথাও পণ্য, কোথাও ধন্য আবার কোথাও জঘন্য। আমাদের বাংলাদেশি সমাজে মেয়ে মানেই আর একটি খরচের খাতা তৈরি হওয়া। আর্থসামাজিক শ্রেণিবিন্যাস অনুযায়ী সে খরচের খাতাটিকে একটি বড় অংশই কখনো লাভজনক স্থানে পদোন্নতি দিতে পারে না। পারে শুধু তারা, যারা সমাজের উঁচু স্তরে রয়েছে। মানে, যারা সব বৈষম্যের মধু ফুলের কাঁটা সরিয়ে আহরণ করতে পারছে।

বৈষম্য আমাদের শিরদাঁড়ায় এঁটে আছে

বৈকলাঙ্গ যে সন্তানটি আমাদের সংসারে আসছে, তাতে তার কি কোনো দোষ আছে? সে কি তার বৈকলাঙ্গ, মানসিক বা শারীরিক হোক, নিজ থেকে বয়ে এনেছে? দুঃখিত! এখানেও বৈষম্য দেখা দেয়। সুস্থ সন্তানদের সঙ্গে অচেতনভাবে দেখা দেয় বৈকলাঙ্গ সন্তানের বৈষম্য। সচরাচর দেখা যায় না এসব বৈকলাঙ্গ শিশু–কিশোরদের বা যুবকদের আমাদের সমাজে। লুকিয়ে রাখা হয় তাদের দৃষ্টির আড়ালে। সভ্য সমাজ এ ধরনের পরিবারের সঙ্গে আত্মীয়তায় জড়াতে চায় না। পাছে লোকে কিছু বলে! শিক্ষা বা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা অত্যন্ত সীমিত তাদের জন্য। স্কুল–কলেজ নেই বললেই চলে। পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও শূন্যের পর্যায়ে।

আমাদের বাসায় যে মেয়ে বা ছেলেটি গৃহকর্মীর কাজ করে, যে নারী সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে নিজ বাড়ি ও সংসার ফেলে রেখে পায়ে হেটে রওয়ানা করে অন্য বাড়িতে নাশতা তৈরি করে দেওয়ার জন্য, আমরা কজনা খবর রাখি তার বাড়ি ও সংসারের? তাকে ছুটি দিতে আমাদের হাজারো সমস্যা। ‘তোমাকে টাকার বিনিময়ে রাখা হয়েছে, কাজ সাত দিন, তুমি কেন ছুটি নেবে? তাহলে আমাদের কী হবে? আর ছুটি নিলে কাটা হবে টাকা।’ এমনি অনেক ওজর। আর আমি, আপনি? অফিসে ছুটি না পেলে বাড়ি এসে আকাশ–বাতাস একাকার করে ফেলি চিৎকারে। ‘আমি কি গোলাম? আমার ছুটি পাওনা আছে। আমাকে ছুটি কেন দেওয়া হলো না। এটা অন্যায়।’ আমরা তখন ভুলে যাই গৃহকর্মীর নৈতিক দাবির কথা, তার ছুটির কথা। বৈষম্যের শিকলে বাঁধা পড়ি আবার আমরা। কাজে–অকাজে আমরা হাত তুলি নিজ সন্তানের বয়সী কাজের শিশুর ওপর। নিজ শিশুর ওপর শিক্ষক হাত তুললে আমরা পত্রিকায় খবর দিই আর জিডি করি থানায়। হায়রে বৈষম্য!

যে শ্রমিক খাটে আমাদের কলকারখানায়, পোশাক তৈরিতে, ইটের ভাটায়—আমরা তাঁর দৈনন্দিন প্রয়োজনের তুলনায় কতটুকু বেতন দিচ্ছি তাঁকে? তাঁর ন্যূনতম প্রয়োজনের খবর কি নিচ্ছি আমরা? আমাদের নিজেদের বেতনের বেলায় তো আমরা একটুকুও ছাড় দিতে রাজি নই। বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে আমরা হাজারো দাবি নিয়ে দাঁড়াচ্ছি। সরকারকে জিম্মি করে ফেলেছি। ধৈর্যহারা হয়ে গেছি আমরা। অথচ শ্রমিকেরা তাঁদের ন্যূনতম বেতনের জন্য, চিকিৎসার জন্য, ছুটির জন্য আন্দোলন করলে আমরা কারখানা বন্ধ করে তাঁদের ওপর হাত তুলতেও দ্বিধা করছি না। বৈষম্য দেখা দেয় তখন, যখন নিজ প্রয়োজনের সঙ্গে অন্যের প্রয়োজনের তফাত করা হয়। ব্যবধান সৃষ্টি করা হয়। মনে রাখতে হবে, আমাদের সবার ক্ষুধা লাগে, সবার প্রয়োজন হয় বিশ্রাম–বিনোদনের। এটা শারীরিক ও মানসিক মূল চাহিদা। এর সঙ্গে মনুষ্য সৃষ্টি সমাজব্যবস্থা বা শ্রেণির কোনো সংযোগ নেই।

চাকরি পাওয়া নিয়ে বৈষম্য। কিন্তু চাকরি পাওয়ার পর সে বৈষম্য কি এতটুকু কমে? অফিসের প্রধানের সঙ্গে সহকারী প্রধানের বৈষম্য! সহকারী প্রধানের সঙ্গে বিভাগীয় প্রধানদের বৈষম্য। বিভাগীয় প্রধানদের সঙ্গে সহকারীদের বৈষম্য। এভাবে চলতে চলতে অফিস সহকারীর সঙ্গে পিওনের ও পিওনের সঙ্গে দারোয়ানের এবং দারোয়ানের সঙ্গে ঝাড়ুদারের বৈষম্য—প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্থায়ী হয়ে আছে আমাদের প্রশাসনে। কি সরকারি, কি বেসরকারি—সর্বত্র। অফিসের প্রধান আসেন সবার শেষে। তিনি যাওয়ার পর বাকিরা ছাড়বেন অফিস। এটাই অলিখিত নিয়ম। যাঁর বেতন যত কম, সে আসবে তত আগে এবং বাসায় ফিরবেন সবার শেষে। বসার স্থান, চেয়ার–টেবিলের মান, পোশাক–আশাক, সর্বত্রই পরিলক্ষিত হবে এ বৈষম্য। সব কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের পাশাপাশি দাঁড় করালে আপনি মোটামুটিভাবে তাঁদের পদমর্যাদা অনুযায়ী ওপর থেকে নিচ বা নিচ থেকে ওপর পর্যন্ত চিহ্নিত করে ফেলতে পারবেন।

বাংলাদেশে কোথাও কি পাবেন, যেখানে অফিস কর্মকর্তারা ও অন্য কর্মচারীরা একই কক্ষে দুপুরের খাবার খাচ্ছেন বা একই মানের রেস্তোরাঁয় বসে খাচ্ছেন?

যে মানব গোষ্ঠী আমাদের বর্জন করা ময়লা–আবর্জনা পরিষ্কার করে পরিবেশ সুন্দর রাখছে, যে নরসুন্দর আমাদের চুল, গোঁফ–দাড়ি ছেঁটে মাথার আকার ও প্রকার সুন্দর রাখছে, যে মিস্ত্রি আমাদের পানির লাইন ঠিক করে জীবনের অপর নাম পানি পানের নিশ্চয়তা দিচ্ছেন, যে বুয়া আমাদের প্রিয় খাবারগুলো রান্না করে দিচ্ছেন, আমরা তাঁদের অন্তরের খবর কতটুকু রাখছি? তাঁরাও আমাদের মতো মানুষ। তাঁদের পরিবার–পরিজন আছে, সুখ–দুঃখ আছে, আছে আহ্লাদ ও আনন্দ। আমরা কতটুকু সম্মান দিচ্ছি তাঁদের পরিশ্রমের? স্বীকৃতি দিচ্ছি কি তাঁদের পেশাকে?

যে রিকশা চালাচ্ছেন, যে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও ট্যাক্সি করে আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে দিচ্ছেন, যে বাসচালক তাঁর সহকারীদের নিয়ে দিনরাত, শীতে কিংবা গরমে বাস চালাচ্ছেন, আমরা তাঁদের গন্তব্যের খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেছি কি কখনো?

যে মুদিদোকানদার আমাদের প্রয়োজনীয় সামগ্রী হাতের কাছে পাওয়ার জন্য এলাকায় দোকান খুলে আমাদের সেবা করছেন, আমরা কি তাঁর মুদিসামগ্রী ক্রয় করার ক্ষমতা আছে কি না, সে খোঁজ রেখেছি? সকাল–সন্ধ্যা সে কোথা থেকে আসছে আর যাচ্ছে, সেটা কি আমরা জানি?

বিধর্মী বলে আমরা অন্য ধর্মাবলম্বীদের খাটো করে দেখি। তাদের সঙ্গে কৃত্রিম দূরত্ব বজায় রাখি। কে কোন ধর্মীয় পরিবারে জন্মগ্রহণ করবে, সেটা কি সে নির্ধারণ করতে পারবে? এটা একটা দৈবিক ব্যাপার। আমার জন্ম কোথায়, কখন, কোন পরিবারে, কোন ধর্মাবলম্বী মা–বাবার ঔরসে হবে, সেটা কি আমি নির্ধারণ করতে পেরেছি? তাহলে কেন এ বৈষম্য ও বিভাজন?

আমাদের বৈষম্য ও বিভাজনের কথা পাতার পর পাতা লেখেও শেষ করা যাবে না। আপন মেয়ের সঙ্গে ছেলের বউয়ের বৈষম্য। ভাবির সঙ্গে ননদের, শাশুড়ির সঙ্গে বউয়ের, বড় ভাবির সঙ্গে ছোট ভাবির। এ তালিকার কোনো শেষ নেই।

আজ নতুন বাংলাদেশে শুধু নিয়োগের বৈষম্য দূর করলেই চলবে না। দূর করতে হবে সামাজিক সব বৈষম্য ও বিভাজনের। মনে রাখতে হবে, এই বৈষম্য ও বিভাজন আমাদের দেশ, জাতি ও সমাজকে এগোতে দিচ্ছে না, দেবে না। এর সমাধান না হলে বারবার ফিরে আসতে হবে আন্দোলনে। বারবার দিতে হবে হাজারো প্রাণ। বারবার রক্ত ঝরবে রাজপথে। আমাদের মনুষ্যত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হবে বারংবার।

আমরা কি এটা চাইব? না।

প্রতিটি ঘর থেকেই শুরু হোক বৈষম্য বর্জন।

* লেখক: কামরুল ইসলাম, সুইডেন

** দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]