কাজলরেখা-শিকড়ের কাছে ফেরা
বাংলা ছবি নিয়ে একটা স্মৃতিকথা দিয়ে লেখাটা শুরু করি। গ্রামে সিনেমা বা চলচ্চিত্রকে এখনো ছবি বলা হয়। গত শতকের আশির দশকে আমাদের গ্রামীণ মায়েরা হলে গিয়ে বাংলা ছবি দেখতেন। হলে নতুন ছবি এলেই প্রতিবেশী চাচিদের নিয়ে পরিকল্পনা করা হতো। আমাদের বাবা–চাচারা এই পরিকল্পনায় বাগড়া না দিলেও দাদিরা বাগড়া দিতেন। দাদির চোখ ফাঁকি দিয়ে ছবি দেখতে যেতে হতো। আর অবধারিতভাবেই আমরা ওনাদের সঙ্গে যেতাম।
রিকশার ছই কাপড় দিয়ে ঘিরে হলে যাওয়া হতো। একবার মায়ের সঙ্গে গিয়েছি রূপবান ছবি দেখতে। আমরা ছবির কিছুই বুঝতাম না। আমাদের আগ্রহ ছিল খাবার নিয়ে। বিরতির সময় চোঙা করে মোড়ানো বাদামওয়ালা আসত। আমরা বেশির ভাগ সময়ই ঘুমিয়ে পড়তাম। সেদিনও যথারীতি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ জেগে উঠলাম বাঘের গর্জনে। গাছ থেকে একটা বাঘ নেমে আসছে রহিম বাদশাকে খাওয়ার জন্য। এটা দেখেই আমি তারস্বরে চিৎকার করে উঠলাম। হলের পিনপতন নীরবতা ভেঙে খান খান হয়ে গেল। এরপর মায়ের আঁচলে মুখ লুকিয়ে দেখলাম রূপবান গান ধরেছে, খায়ো না খায়ো না বাঘো রে। বাংলা ছবি তখন দেশের সব শ্রেণি–পেশার মানুষেরই বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম ছিল।
এরপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ছবি তার জৌলুশ হারিয়ে ফেলেছিল। নির্মল বিনোদনের জায়গায় এসেছিল অশ্লীলতা আর কাটপিসের দৌরাত্ম্য। অনেকটা সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর আবারও বাংলা ছবি যেন গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াচ্ছে। গিয়াস উদ্দিন সেলিম নির্মিত কাজলরেখা ছবিটা দেখে আমার সে কথাই মনে হয়েছে বারবার। গীতি চিত্রনাট্য ধাঁচের এই ছবিটা দেখে বারবারই আমার শৈশবে দেখা রূপবান ছবির কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। দৃশ্যের বর্ণনায় একটু পরপরই গানের অবতারণা। কাহিনি নিয়ে আলাদাভাবে কিছু বলার নেই।
আমরা বড় হয়েছিলাম নানা–নানি, দাদা–দাদিদের কাছে কিচ্ছা শুনে শুনে। মা নায়রে নানি বাড়িতে গেলে আমাদের সব মামাতো–খালাতো ভাইবোনের জন্য উঠানে বারোয়ারি বিছানা পাতা হতো। তখন নানি এসে জিজ্ঞেস করতেন সেদিন কার কিচ্ছা শুনতে চাই। নানির কাছ থেকে শুনতে শুনতে সুচ রাজার গল্প আমাদের অনেক প্রিয় হয়ে গিয়েছিল। বড় হয়ে গল্পের বই পড়ে জানলাম সেই সুচ রাজার গল্প আসলে ময়মনসিংহ গীতিকার কাজলরেখা।
কাজলরেখার গল্প নিয়ে ছবি বানানো হচ্ছে জেনেই মনের মধ্যে একটা অকৃত্রিম ভালো লাগা কাজ করছিল। এই ছবি নির্মাণসংক্রান্ত যত খবর বেরিয়েছে সবই পড়েছি অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে। ছবির কুশীলবদের নিয়ে কিছু ছবি দেখে খুবই ভালো লাগল। এরপর সেটের কিছু ছবি দেখে মনে হলো দারুণ একটা কাজ হতে যাচ্ছে। এরপর একসময় ছবির গানগুলো ইউটিউবে মুক্তি পেল। তার পর থেকে আমাদের বাসায় এই গানগুলোই বেজে চলেছে অবিরাম। আমাদের সপ্তাহান্তের সকাল শুরু হয় কাজলরেখার গান দিয়ে। ঘুমাইলা ঘুমাইলা রে বন্ধু পান খাইলা না, কি কাম করিল সাধু, বাপ মোরে কই লইয়া যাও গো, কে তুমি সুন্দরী কইন্না কোথায় তোমার ঘর, কইন্না আঁকে গো আলপনা, হলুদ রে তুই কোন কোন কাজে লাগিস একটার থেকে একটা সুন্দর গান। আবহমান গ্রামবাংলায় একসময় সুন্নতে খৎনা, বিয়ের মতো অনুষ্ঠানে দল বেঁধে গীত গাওয়ার চল ছিল। সারা গ্রামে যেখানেই কোনো অনুষ্ঠান হতো, আমার দাদিকে ডাকা হতো গীত গাওয়ার জন্য। আর দাদি আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। কাজলরেখার গানগুলো আমাদের হারিয়ে যাওয়া সেই গীতগুলোকে যেন পুনর্জীবন দিয়েছে।
এরই মধ্যে বাংলাদেশে ছবিটা মুক্তি পেল। পত্রিকার পাতায় বিভিন্ন মানুষের প্রতিক্রিয়া পড়তে থাকলাম। ছবিটা কবে অস্ট্রেলিয়া আসবে, সেটা জানতে খুদে বার্তা দিলাম পথ প্রোডাকশনের ফাইয়াজ ভাইকে। তিনি বললেন এলেই আপনাকে লিংক দেব। এরপর একদিন রাতে তিনি লিংক পাঠালেন। ঘুমের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু টিকিট না করে ঘুমাই কীভাবে। দেশি ইভেন্টের ওয়েবসাইটে প্রথম টিকিটটা করে ফেললাম। এরপর শুধু অপেক্ষা। পরিচিতদেরও দেখার জন্য উৎসাহ দিলাম। তার মধ্যে আমার বন্ধু নন্দিতা টিকিট করে ফেলল। আমাদের দুজনেরই বেড়ে ওঠা বাংলাদেশের একই আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে একই সময়ে। তাই আমাদের বোঝাপড়াটা দারুণ। দুজনেই ছবিটা নিয়ে দারুণ উৎসাহী ছিলাম। ছোটবেলায় শোনা গল্পের চিত্রায়ণ দেখতে পাব, তাই আমরা আরও বেশি আগ্রহী ছিলাম। ছবি দেখে বের হয়ে আমরা দুই বন্ধু অনেক বিষয় নিয়ে আলাপ করলাম।
হাজার বছর আগেরকার গল্পকে চিত্রায়ণ করাটাই ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, আমি বললাম। সেট নির্মাণে সেকালের আবহ তৈরি করাটাও অনেক কঠিন কাজ ছিল। কাঁচা রাস্তাঘাট, বাঁশের আর খড়ের বাড়িঘর, সেই পুরোনো আমলের কাঁসার তৈজসপত্র, চরিত্রদের পরিধেয় বস্ত্র, তাদের কথা বলা সবকিছুই ছিল খুবই স্বাভাবিক। আমার কাছে একটুও খটকা লাগেনি। বনবাসের গভীর বন, কচুপাতায় করে পানি নিয়ে আসা, আগুনকে সাক্ষী রেখে বিবাহ করা—সবই ছিল সাবলীল। আমার কথা শুনে নন্দিতা বলল, হ্যাঁ, আর চরিত্রের জন্য অভিনেতা–অভিনেত্রী নির্বাচনও দারুণ হয়েছে। কাজলরেখার বোকা বোকা বাবা–মা, কুটিল চরিত্রের কঙ্কণ দাসী, উদাস রাজা, তার ধুরন্ধর বন্ধু, বুদ্ধিমান মন্ত্রী সবার অভিনয়ই অসাধারণ ছিল। আমি বললাম, কিন্তু পুরো ছবির চাবিকাঠি কিন্তু ছিল আমাদের পাভেল ভাই মানে আজাদ আবুল কালামের হাতে। কী দারুণভাবেই না তিনি প্রতিটি চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। কখনো সন্ন্যাসী, কখনো মন্দিরের পুরোহিত, কখনো নৌকার মাঝি, কখনো জেলে। আমি নিশ্চিত অনেকেই ওনাকে চিনতে পারেননি।
আমি বললাম, এবার তোকে সাম্প্রতিক একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। এক সপ্তাহ আগে আমরা একটা নৌবিহারে গিয়েছিলাম। একেবারে আদি আমলের পালতোলা জাহাজে যেমনটা আমরা ছোটবেলায় দেখেছিলাম। তখন তো আর ইঞ্জিন ছিল না। আমি জাহাজের ক্যাপ্টেনকে কাজলরেখার বাবার নৌকার ছবিটা দেখিয়ে বললাম এমন নৌকা একসময় বাংলাদেশে ছিল। এখন অবশ্য ইঞ্জিন এসে পাল বিলুপ্ত হয়ে গেছে। জাহাজের ক্যাপ্টেন খুবই অবাক হয়ে বলল, সি ইজ গর্জিয়াস। এই নৌকার কি কোনো নাম আছে। আমি বললাম, সাধারণ অর্থে এগুলো বাণিজ্যিক নৌকা, তবে আমাদের দেশে অনেক রকমের পালতোলা নৌকা ছিল। কিছু নৌকা মাছ ধরার কাজে ব্যবহার করা হতো আবার কিছু নৌকা শুধু যাত্রী পারাপার করত। এরপর ক্যাপ্টেন তার সমাপনী বক্তব্যে বলল, আজ আমি বাংলাদেশের নৌকা সম্বন্ধে জেনেছি এবং আরও জানার ইচ্ছা আছে। আমি তখন মনে মনে গিয়াস উদ্দিন সেলিম এবং তাঁর পুরো কাজলরেখা টিমকে ধন্যবাদ দিলাম আমাদের শৈশব স্মৃতি ফিরিয়ে আনার জন্য।
আমি নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি, এই ছবি আমি আরও বহুবার দেখব, কোনো প্রকার ক্লান্তি ছাড়াই। এই ছবির সবুজ আমাকে চোখের আরাম দেবে। এই ছবির পাত্রপাত্রী আমাকে আমার পূর্বপুরুষদের স্মরণ করিয়ে দেবে। এই ছবির সেট থেকে শুরু করে সবকিছুই আমাকে আমাদের হারানো ঐতিহ্যের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। একসময় বাংলা ছবি যেমন সর্বস্তরের মানুষ সপরিবার দেখতে হলে যেত, তেমনি কাজলরেখা দেখতে মানুষ দলে দলে হলে যাবে। তারা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে শোনাবে আমাদের ঐতিহ্যের গল্প। সভ্যতার যান্ত্রিকতায় এখন তো আর আমাদের দুদণ্ড বসে বাচ্চাদের ঠাকুরমার ঝুলি বা ময়মনসিংহ গীতিকা পাঠ করে শোনানোর অবসর নেই। এখন অন্ততপক্ষে কাজলরেখা ছবিটা তাদের দেখিয়ে বলতে পারব কতটা সহজ–সরল, অনাড়ম্বর ছিল আমাদের জীবন। আর কাজলরেখা ছবিটা দেখে অন্য নির্মাতারাও আশা করি উৎসাহিত হবেন এমন গল্পের ছবিতে টাকা লগ্নি করতে। কাজলরেখার হাত ধরে বাংলা চলচ্চিত্র আবারও ফিরে পাক তার হারানো শৌর্যবীর্য।
দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]