রিং মাস্টার

১২ মে মা দিবস হিসেবে পালিত হয়। প্রবাস থেকে পাঠানো পাঠকের লেখা থেকে বাছাই করা লেখা প্রকাশিত হচ্ছে দূর পরবাসে।

মা দিবসের জন্য সন্তানদের উপহারছবি: লেখক

আমাদের পরিবারটাকে আমি বলি সার্কাস পরিবার। আর সেই সার্কাসের একটা গালভরা নামও দিয়েছি—দ্য নিউ অপেরা সার্কাস। সিডনির অধিবাসী হিসেবে এমন নামকরণ আমার কাছে খুবই যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে। এই সার্কাস পরিবারে আমি অভিনয় করি ভাঁড়ের চরিত্রে। পৃথিবীর কোনো কিছুই আমাকে বিচলিত করতে পারে না। চরম দুঃসময়েও হাসার একটা সহজাত প্রবণতা আমার মধ্যে আছে। বাচ্চা দুটি হচ্ছে সার্কাসের আসল চরিত্র, যারা বিভিন্ন কলাকৌশল দেখিয়ে দর্শকদের আনন্দ দেয়। তাদের বাস্তবিক কাজকর্মের মধ্যে সার্কাসের কাজের খুবই মিল পাওয়া যায়। আর রিং মাস্টার হচ্ছেন বাচ্চাদের মা, যিনি আমাদের এ মঞ্চের একক কর্তৃত্বের অধিকারী। আমরা মাঝেমধ্যে ভাবি, আমরাই সর্বেসর্বা, কিন্তু দিন শেষে আমরা সবাই একমত হই যে রিং মাস্টারই আমাদের সরদার এবং আশ্রয়দাতা। রিং মাস্টারের হাতে যদিও সার্কাসের মতো চাবুক নেই, তবু আমরা তাঁকে ভয় পাই, সম্মান করি, শ্রদ্ধা করি। আসলে প্রতিটি পরিবারের মায়ের চরিত্রই তো এমন—পুরো পরিবারকে একই সুতায় গেঁথে রাখা। আমরা যেন রসুনের একেকটা কোয়া আর পরিবারের মা হচ্ছেন শিকড়।

জীবনকে আমি ব্যক্তিগতভাবে কখনোই সিরিয়াসলি নিইনি। আমার নীতি হচ্ছে, যা হবে দেখা যাবে।

জানি না এ তত্ত্ব আমি কোথা থেকে পেয়েছিলাম। তবে আমার ধারণা, পাঠ্যবই ব্যতিরেকে অতিরিক্ত বই পড়ার ফলে আমার মধ্যে এ দর্শন তৈরি হয়েছিল। এ দর্শনের ফলে আমি জীবনকে প্রতিমুহূর্তে উপভোগ করতে চেষ্টা করি, যেখানে সবাই জীবনের বোঝা বয়ে বয়ে ক্লান্ত হয়ে যায়। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পাস করে তখনকার দিনের সর্বোচ্চ বেতন ও সুবিধার চাকরিতে যোগ দিয়েছিলাম।

বহুজাতিক মোবাইল কোম্পানি থেকে মাসে মাসে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা বেতন পেতাম। কিন্তু ব্যাংকে-ব্যালান্স সব সময়ই থাকত শূন্য বা ঋণাত্মক। কারণ, টাকা খরচ করতাম একেবারে অবিবেচকের মতো। মোটামুটি অত্যন্ত আনন্দময় উড়নচণ্ডী একটা জীবন পার করছিলাম। এভাবেই বাকি জীবনটা পার করে দিতে পারব—এমন একটা ছেলেমানুষি ভাবনা মনে কাজ করত।

এমন সময় আমার জীবনে এসে হাজির হলেন রিং মাস্টার। তিনি এসে দেখলেন, এ তো পুরাই উচ্ছন্নে গেছে। এর না আছে চালের খবর, না আছে চুলোর খোঁজ। তখন রিং মাস্টার আমাকে বেলাইন থেকে লাইনে আনার অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এ দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে তুলে নিলেন। ঝুঁকিপূর্ণ বলছি এ কারণে, আমি অত্যন্ত একরোখা স্বভাবের। আরও সহজ করে বললে বলা যায় গোঁয়ার। এর পরের গল্প রিং মাস্টারের সঙ্গে আমার প্রতিনিয়ত বিদ্রোহের এবং যুদ্ধের। অবশ্য দিন শেষে আবার আমাকে তাঁর সঙ্গেই শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করতে হতো। বহুজাতিক মোবাইল কোম্পানির মোটা বেতনের একটা টাকাও আমার ব্যাংক হিসাবে ছিল না। তাই বন্ধুদের কাছ থেকে টাকা ধার করে রিং মাস্টারকে স্বাগত জানানোর প্রক্রিয়া শেষ করতে হলো। আমি শুধু মনে মনে ভাবতাম, কীভাবে সেই টাকা শোধ দেব। কিন্তু রিং মাস্টার কীভাবে কীভাবে যেন একটু একটু করে সেই টাকাটা শোধ দিয়ে দিলেন। আমি হলে জীবনেও এ ধার নিয়ে মাথা ঘামাতাম না। হয়তোবা দেখা যেত, ধারের বোঝা মাথায় নিয়ে পটল তুলতে হতো।

সপরিবারে লেখক
ছবি: সংগৃহীত

এরপর একসময় আমার দলে এক নবীন সদস্য (আমাদের মেয়ে) যোগ দিল। সঙ্গে সঙ্গে তাকে আমি ফুসমন্তর দিয়ে আমার দলে টেনে নিলাম। মানুষ জন্মগতভাবেই স্বাধীনতাবাদী। রিং মাস্টার যতই নতুন সদস্যকে নানান নিয়মকানুনের বেড়াজালে বাঁধতে চান, আমি ততই তাকে মুক্তির উপায় দেখিয়ে দিই।

এভাবেই আমরা দলে ভারী হয়ে গেলাম এবং আমাদের উড়নচণ্ডী কাজকর্ম অব্যাহত রাখলাম। আমরা ঘুরি, ফিরি, খাই আর ঘুমাই। নতুন সদস্য হিসেবে তাকে স্কুলে ভর্তি হতে হবে। সেসব বিষয়ে আমার কোনো গরজ নেই। অগত্যা রিং মাস্টার তাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। আমি তাকে মাঝেমধ্যে স্কুলে নিয়ে যাই। তখন কানে কানে বলি, স্কুল অত সিরিয়াসলি নেওয়ার কিছু নেই। যাবা, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে খেলাধুলা করবা, টিফিন খাবা আর দিন শেষে ফিরে আসবা। এভাবেই চলছিল। তখন আবার রিং মাস্টার দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে নিয়ে নিলেন। একসময় নতুন সদস্যকে স্কুলের পাশাপাশি প্রাইভেট পড়তে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হলো। আমি সেখানেও বাগড়া দিলাম এবং একই বুদ্ধি দিলাম। এভাবেই চলল রিং মাস্টারের সঙ্গে আমাদের ইঁদুর-বিড়াল খেলা।

এরপর একসময় আমাদের দলে আরেক নতুন সদস্য (আমাদের ছেলে) যোগ হলো। এই নতুন সদস্য স্বভাবগতিকে আমাদেরই মতো। তাই তাকেও আমাদের দলভুক্ত করতে বেগ পেতে হলো না। বরং তার কাছ থেকে আমরা ফাঁকিবাজির নিত্যনতুন ধারণা পেতে থাকলাম। তার কাজকর্ম থেকে শুরু করে চলাফেরা, হাসি, কান্না—সবই আমাদের চালের। সে-ও নিয়মের প্রতি অত্যন্ত বীতশ্রদ্ধ। কোনো নিয়মকানুনের কথা বললে সে আমাদের মতো বিদ্রোহ করে না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, সে মেনেও চলে না। তার কাছ থেকেই জানলাম, চিৎকার করে প্রতিবাদ না করে চুপচাপ থেকে না মানলেই আসল প্রতিবাদ করা হয়। এভাবে আমরা তিনজন জোটবদ্ধ হয়ে রিং মাস্টারের কর্তৃত্ব খর্ব করতে আদাজল খেয়ে লেগে পড়লাম। আমাদের যতই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে লাইনে আনার চেষ্টা করা হয়, ততই আমরা তিনজন দল বেঁধে বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়াই। কারণ, আমাদের পূর্বপুরুষ বনেই থাকত। তাই প্রকৃতির কাছ থেকে আমরা পাঠ নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকলাম। কিন্তু দিন শেষে আমাদের খাবারের জন্য ঠিকই বাসায় ফিরতে হতো এবং রিং মাস্টারের সামনে পড়তে হতো।

বাসার মধ্যে সার্কাসের দুই মূল শিল্পী আমাদের পুত্র আর কন্যা বিভিন্ন সৃষ্টিশীল (?) ক্রিয়াকর্ম করে বিনোদনের খোরাক তৈরি করে চলেছে। তাদের মধ্যে আসলে যে কী সম্পর্ক বিদ্যমান, সেটা বোধ হয় বিধাতাও নিরূপণ করতে ভয় পান। কখনো সাপে-নেউলে, আবার কিছুক্ষণ পরেই হরিহর আত্মা। একজন অন্যজনকে রেখে কোনো আনন্দ আয়োজনে যোগ দিতে যেতে চায় না। আর যদি যায়ও, সেখানে যে সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে, সেগুলোর প্রায় সবই বাড়িতে থাকা অন্যজনের জন্য বয়ে আনার চেষ্টা করে।

তাদের মধ্যকার উত্তমমধ্যমে এবং চিৎকারের শব্দ অধুনা কুস্তির অনুষ্ঠান ডব্লিউডব্লিউইর কথা মনে করিয়ে দেয়। টিভির অনুষ্ঠান দেখতে বসলে অনুষ্ঠান পছন্দ করা নিয়েও অবধারিতভাবেই লেগে যায় দুজনের মধ্যে।

তখন আমার ভূমিকা হয় হাসিঠাট্টার মাধ্যমে বিষয়টার একটা সহজ সমাধান দাঁড় করানো। বলাই বাহুল্য, সেটা বেশির ভাগ সময়ই কাজে আসে না। তখন রিং মাস্টার আবির্ভূত হন স্বরূপে। তাঁর উপস্থিতি টের পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খেলোয়াড় দুজন যার যার জায়গায় নিশ্চুপ হয়ে যান। আর আমি কোনো এক কোনা খুঁজে বের করে লুকিয়ে পড়ি। আধুনিক রিং মাস্টারের হাতে বেতের লাঠি বা চাবুক না থাকলেও তাঁর উপস্থিতি আমাদের মনে সমীহের ভাব জাগায়। অনেক পরে এসে বুঝেছি, এই সমীহের মধ্যেই আসল ভালোবাসা নিহিত। কারণ, খেলোয়াড় দুজন তাঁর শাসন উপভোগ করার পাশাপাশি তাঁকে গভীরভাবে ভালোও বাসে। কারণ, তাঁর সঙ্গে সামান্য সময়ের বিচ্ছেদে তারা কেঁদেকেটে একাকার করে ফেলে।

আসলে পরিবারের রিং মাস্টারের ভূমিকা তো এটাই। শাসনের সময় শাসন। আদরের সময় আদর।

আমরা তিন ভাই এখনো আমাদের পরিবারের রিং মাস্টারের ক্ষেত্রেও একইভাবে টান অনুভব করি।

এভাবেই যুগে যুগে আমাদের মায়েরা সার্কাসের রিং মাস্টারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে পুরো পরিবারকে ধরে রাখেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, সবকিছুই যেন আব্বার হুকুমে চলছে, কিন্তু একটু গভীরে দৃষ্টি দিলেই টের পাওয়া যায়, পরিবারের আসল নিয়ন্ত্রক হচ্ছেন আমাদের মায়েরা। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে আমাদের মেয়েরা এমনভাবে গড়ে ওঠে যে তারা মা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের চরিত্রের মধ্যে হঠাৎ কোথা থেকে অসীম সাহস, দৃঢ় মনোবল আসে এবং সবাইকে সমানভাবে ভালোবাসার এক অনন্য গুণের অধিকারী হয়ে যায়। বিশ্ব মা দিবসে আমাদের সব মায়ের জন্য অকুণ্ঠ ভালোবাসা; যদিও আমরা তাঁদের নির্দিষ্ট দিবস বাদ দিয়ে সব সময়ই ভালোবাসি। ভালো থাকুন আমাদের মেয়েরা। ভালো থাকুক আমাদের মায়েরা।

*দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]