টেমস নদীর কূলে সিলেট অঞ্চলের লোকজ ধামাইল উৎসব

টেমস নদীর কূলে লন্ডনের পপলার ইউনিয়নে গত শনিবার (১৯ এপ্রিল) অনুষ্ঠিত হলো সিলেট অঞ্চলের লোকজ ধামাইল সংগীত ও নৃত্যের এক অনন্য উদ্‌যাপন। মুক্ত আর্টসের আয়োজনে তৃতীয় ব্রিট-বাংলা হেরিটেজ ফেস্টিভ্যালে এই বছর বিলেতের বাঙালিরা ফিরে দেখলেন ধামাইলের গীত, নৃত্য ও গল্পের ঐতিহ্য।

অনুষ্ঠানের সূচনা করেন মুক্ত আর্টসের সভাপতি, সংস্কৃতিজন সত্যব্রত দাস স্বপন। এরপর মুক্ত আর্টসের বিগত দিনের কার্যক্রম ও চলতি বছরব্যাপী হেরিটেজ ফেস্টের বিবরণ তুলে ধরেন সংগঠনের সৃজন পরিচালক অসীম চক্রবর্তী।

অনুষ্ঠানের বিশেষ আকর্ষণ ছিল ‘বরাক উপত্যকার সমাজ পরিবর্তন এবং নারী স্বাধীনতায় ধামাইল নৃত্যগীতের ভূমিকা’শীর্ষক একটি পরিষদীয় আলোচনা। লন্ডন অ্যাম্বুলেন্সের ডাইরেক্টর এবং সংস্কৃতিকর্মী রঞ্জিতা সেনের পরিচালনায় আলোচনায় অংশ নেন কার্ডিফ সিটি কাউন্সিলের কাউন্সিলর ও মানবাধিকারকর্মী জেসমিন চৌধুরী, লেখক-সাংবাদিক নজমুল আলবাব এবং মাইক্রোসফটের লন্ডন রিজিওনের হেড অব মার্কেটিং ও বিলাতি বাঙালিদের প্রথম প্রজন্মের প্রতিনিধি সুপ্রিয়া দেব পুরকায়স্থ। আলোচনায় উঠে আসে ব্রিটিশ-বাংলাদেশি নারী এবং বরাক উপত্যকার নারীদের সাংস্কৃতিক মুক্তি, ধামাইলের অন্তর্নিহিত শক্তি ও তার সমাজ গঠনে ভূমিকা।

এরপর শিশুদের পরিবেশনায় ধামাইল গানে মুখর হয় মিলনায়তন। এই পরিবেশনায় ধামাইল সংগীত পরিবেশন করে স্নিগ্ধা রায়, রূপকথা দত্ত, বিন্থি দাস, বৃন্দা দাস ও ঈষা দাস এবং ধামাইল নৃত্য পরিবেশন করে বিরোজা দে, শ্রিয়া গোস্বামী, আরুষী চক্রবর্তী, শতাক্ষী দেব, রুদ্রনীল দেব এবং আনুষা দাস। বিলেতে জন্ম নেওয়া এসব শিশুর প্রধান ভাষা ইংরেজি হলেও তাদের কণ্ঠে ও নৃত্যে ধামাইলের শুদ্ধতা ছিল চোখে পড়ার মতো।

এরপর সুরালয়ের শিল্পীদের সমবেত কণ্ঠে পরিবেশিত হয় দুটি ধামাইল। এই পর্বে সংগীত পরিবেশন করেন রঞ্জিতা সেন, জয়শ্রী পুরকায়স্থ, প্রিয়াঙ্কা ঘোষ, অল্পনা পাল, সুপ্রিয়া দেব পুরকায়স্থ ও শুভাঙ্গী দাম।

অবশেষে শুরু হয় ধামাইলের বিশেষ পরিবেশনা। এ পর্বে ধামাইলের গল্পভিত্তিক গীতি-আলেখ্য ‘ধামাইল কথা’ রচনায় ও নির্দেশনায় অসীম চক্রবর্তী, গল্পসূত্রধর দীপ রায়ের কণ্ঠে প্রবাহিত হয় ধামাইলের বিভিন্ন পর্বের গল্প। ক্রমান্বয়ে উঠে আসে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের কবি চণ্ডীদাস, ধামাইল ঘরানার কিংবদন্তি শ্রী রাধারমন দত্ত, প্রতাপ রঞ্জন, দীন নীরেন কিংবা ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী অথবা বেনারস ঘরানার ঠুমরি। অমিত দের গলায় বন্দনাসংগীত ‘প্রথম বন্দনা যে করি, জয় জয় কিশোরীর’ দিয়ে যাত্রা শুরু করে গৌররূপ, কৃষ্ণরূপ, বাঁশি ও জলের গান হয়ে চলে ভোররাতের দিকে। গৌরী চৌধুরীর গলায় ‘বাঁশি রে পরানের বাঁশি’ গানে মিলনায়তনে নেমে আসে নিঃশব্দ আবেগ। সেই মুহূর্তে কিশোর ময়ুখজিৎ চক্রবর্তীর বাঁশির সুর যেন স্থির সময়কে ভেদ করে প্রাণে বিঁধে যায়।

‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিল ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের সঙ্গে ধামাইলের অপূর্ব মেলবন্ধন। ভ্রমর সংবাদ পর্বে গৌরী চৌধুরীর ‘ভ্রমর কইয়ো গিয়া’ ও অমিত দের কণ্ঠে বড়ে গোলাম আলীর ‘আয়ে না বালাম’ গানটি দর্শকদের মুগ্ধ করে। কোকিল সংবাদ পর্বে লাবণী বড়ুয়ার গলায় ক্বারী আমির উদ্দিনের ‘কুহু স্বরে মনের আগুন’ গান ও পাঁচপাড়া ধামাইল পরিবেশনা ছিল এক অনন্য অভিজ্ঞতা। পপি করের কণ্ঠে ‘চন্দ্রা দাও গো বিদায়’ এবং অপর্ণা ভৌমিকের কোরাসে সংগত গোটা আয়োজনকে দেয় অন্য মাত্রা। গোটা পরিবেশনায় ধামাইল সংগীতের সঙ্গে মৌসুমী সামন্তের নির্দেশনায় ও সুপ্রিয়া দেব পুরকায়স্থর তত্ত্বাবধানে নৃত্য পরিবেশনা করেন সুস্মিতা ভট্টাচার্য কনিকা গোস্বামী, বাপ্পী দাম, সোমা গঙ্গা রায়, সুমা দে, রূপনা রানী দাস ও মুন্নি চক্রবর্তী। বাদ্যযন্ত্রে ছিলেন হিরণ্ময় গোস্বামী (মৃদঙ্গ), তৌকি (রিদম) ও ময়ুখজিৎ চক্রবর্তী (বাঁশি)।

ধামাইল কথার শেষ দৃশ্য যেন রূপ নেয় বরাক উপত্যকার কোনো গ্রামের উঠানে—দর্শকেরাই যেন হয়ে ওঠেন ধামাইল–শিল্পী। রাধা-কৃষ্ণের মিলনসংগীত ‘যুগল মিলন হইলো গো’ গানের সঙ্গে ধামাইল নৃত্যে অনুষ্ঠান পৌঁছায় চূড়ান্ত আনন্দঘন পরিসমাপ্তিতে।

ব্রিট-বাংলা হেরিটেজ ফেস্ট সম্পর্কে জানতে চাইলে মুক্ত আর্টসের সভাপতি সত্যব্রত দাস স্বপন বলেন, ‘এই আমাদের তৃতীয় হেরিটেজ ফেস্টিভ্যাল। আগের দুটি উৎসবে আমরা উদ্‌যাপন করেছি ভাটিয়ালি সংগীত ও বাংলা কীর্তন। এবারের মূল প্রতিপাদ্য ধামাইল সংগীত ও নৃত্য।’

এ বছর মুক্ত আর্টস তৈরি করছে ১৫টি ভিডিও চিত্র, যেখানে থাকবে ধামাইলের ইতিহাস, বিকাশ, পরিবেশনরীতি ও স্মৃতিচারণা। চিত্রশিল্পী মৌনিমুক্তা চক্রবর্তীর তিনটি চিত্রকর্মের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হবে একটি তথ্যচিত্র, যা সংগীত ও গল্পের মাধ্যমে ধামাইলকে তুলে ধরবে। পাশাপাশি প্রকাশিত হবে বাংলা ও ইংরেজি ভাষার একটি গ্রন্থ, যাতে লিখবেন বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের খ্যাতনামা ফোকলোর গবেষকেরা।

বিলেতের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের প্রধান সহযোগী সংস্থা ন্যাশনাল লটারি হেরিটেজ ফান্ডের সহযোগিতায় এই কর্মযজ্ঞের প্রতিটি মুহূর্ত সংরক্ষিত হবে টাওয়ার হ্যামলেট লোকাল হিস্টোরি ও আর্কাইভ মিউজিয়ামে, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ধামাইল সম্পর্কে জানতে পারে। এই গ্রন্থ সংরক্ষিত হবে লন্ডনের আইডিয়া স্টোর লাইব্রেরিতেও।

অনুষ্ঠান যখন শেষ হলো, তখন রাত প্রায় ৯টা। আধফালি চাঁদের আলোয় বিলেতি বসন্তের সেই সন্ধ্যা যেন রূপ নিল এক অনিন্দ্যসুন্দর ধামাইল রজনীতে। অমিত দের কণ্ঠে যুগলমিলনের গানের সঙ্গে শেষ হলো ধামাইল উদ্‌যাপন, দর্শকেরা ফিরে গেলেন ঘরে বুকে আফাল তোলা নিঃসঙ্গ ভালোবাসা আর কল্পনার আকাশের রক্তিম ভোরকে সঙ্গী করে।