ক্রিকেট প্রেম

ক্রিকেট খেলা
ফাইল ছবি

তনুকে দেখলে আমার হাত–পা অবশ হয়ে যায়। গলা শুকিয়ে যায়। বুকের ভেতর কে যেন হাতুড়ি পেটায়। তোতলা হয়ে গেছি মনে হয়। আবার প্রচণ্ড একটা হাহাকার জমে ওঠে বুকের বাম পাশে। ইদানীং একটা গর্ত তৈরি হয়েছে। তাকে নিয়েই এই ক্ষত।

ভদ্র ছেলের ট্যাগ লেগে আছে আমার নামের সঙ্গে। এ কারণে অনেক কিছু করার ইচ্ছা থাকলেও করা যায় না, গিলে ফেলতে হয়। তনুকে নিয়েও উথাল–পাতাল ইচ্ছাগুলো গলায় কাঁটা বিঁধলে শুকনো ভাত গেলার মতো চোখ বন্ধ করে গিলে ফেলি। চোখের কোনা স্যাঁতসেঁতে হয়ে ওঠে।

তাই বলে কি স্বপ্ন দেখব না? কেউ তো দেখছে না, মনে মনে স্বপ্ন দেখছি নাকি জিকির করছি। এ সুবিধার সদ্ব্যবহার করে তনুকে নিয়ে নানান স্বপ্ন এঁকে ফেলেছি। এমন মেয়েকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার মধ্যেও আনন্দ আছে।

তনু অসম্ভব রকম সুন্দর। সে যা করে, তা–ই সুন্দর। যা পরে, তা-ই স্মার্ট। চোখ দুটো ড্যাবড্যাব করে তার। তনু হাঁটলে মনে হয় রঙিন প্রজাপতি উড়ছে পাখা মেলে। হাসলে মনে হয় অষ্টম আশ্চর্য নির্মিত হচ্ছে। তার ব্যক্তিত্বে একটা বনেদি ভাব আছে। কেমন মুগ্ধতা ছড়ানো একটা ব্যাপার তাকে ঘিরে থাকে।

আমি একা নই। বলতে গেলে সোসাইটির সব ছেলেই তার জন্য পাগল। একদিন তনুর পাশে একজনকে দেখে মনে হলো আইফেল টাওয়ার থেকে পড়ছি। দূর থেকে লক্ষ করি, তার পাশে সাদাত ভাই! বি ব্লকের সাদাত। তারা কী কথা বলছে!

স্কুলজীবনে মেয়েদের সঙ্গে কোনো ছেলেকে কথা বলতে দেখলে ভাবতাম, প্রেম হয়ে গেছে। তেমনি এখন মনে হচ্ছে তাদের বিয়ে–শাদি, নাতি-পুতিও হয়ে গেছে।

সাদাত আমাদের পাড়ায় এসে প্রেম করবে! তাও তনুর সঙ্গে! এটা তো রীতিমতো অপমান! নো, নেভার। এটা হতেই পারে না! হতে দেব না। সাদাত আমাদের পাড়ার শত্রু। শত্রুর সঙ্গে তনুর বসবাস মানতে পারছি না।

আমাদের শত্রুতা ক্রিকেট নিয়ে। সাদাত গরুর মতো বল করে। মানে অসম্ভব গতি তার বলে। ব্যাটসম্যান ব্যাট প্লেস করার আগেই স্টাম্প মাধুরী দীক্ষিতের মতো নাচতে শুরু করে। তার জন্য উইকেটকিপারের পেছনে আরেকটা ফিল্ডার রাখতে হয়। না হলে নিশ্চিত বাই রান চার। আমার ধারণা, সে একদিন ন্যাশনাল টিমে খেলবে।

আমরা তাদের সঙ্গে নিয়মিত ক্রিকেট ম্যাচ খেলি। ট্যাপ টেনিস ক্রিকেট। টেনিস বলে ট্যাপ পেঁচিয়ে শক্ত করা হয়। খেলায় আমরা সমান সমান। কিন্তু হেরে যাই সাদাতের কাছে। সে একাই পাঁচ উইকেট নেয়। আমাদের মাঠে খেলা, অথচ হেরে গিয়ে আমাদেরই মাথা নিচু করে থাকতে হয়। তারা সাদাতকে মাথায় তুলে নাচতে নাচতে চলে যায়। কী লজ্জা! কী অপমান!

আমাদের পুরা সোসাইটিতে খেলার একটা প্রভাব পড়েছে। সাদাতের একটা ইমেজ তৈরি হয়েছে। চারদিকে তার নামডাক। সে হাঁটে সালমান খানের মতো বুক টান টান করে। আর এখন তো দেখি, কলিজা ধরে টান দিয়েছে। ব্যাটা সাদাইত্যা! আমার মেজাজ চড়ে গেছে ভীষণ। হাতে পারমাণবিক বোমা থাকলে এতক্ষণে তার মাথায় মেরে দিতাম।

নাহ। ভদ্র ছেলের ভাত নাই। ভিলেন হয়ে যাব। তবু চোখের সামনে তনুকে কারও সঙ্গে দেখতে পারব না। বুদ্ধি বের করলাম। সাদাতের রুট হচ্ছে ক্রিকেট। সেটা বন্ধ করতে হবে। সেটা বন্ধ হলে সে জিরো।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু নাইমকে সব খুলে বললাম। সে রাজনীতি করে। তাকে বললাম সাদাতের পা ভাঙতে হবে। হাঁটু থেকে নিচে পেটাতে হবে কাচের বোতলে পানি ভরে। ঝাঁঝরা করে দিলে আমি পৈশাচিক আনন্দ পাব। তারপর দেখব, হুইলচেয়ারে বসে সে কীভাবে বল করে। বল বন্ধ মানে প্রেম বন্ধ। বল করে করে তনুকে পটাবি! এইবার পটা!

নাইম বলল, ‘চল, তোকে আরিবের কাছে নিয়ে যাই।’ আমি বললাম, ‘আরিব কি বড় গুন্ডা? একজনে পারবে না কিন্তু। তিনজন লাগবে তার পা ভাঙতে। সাদাতের পা অনেকটা বিল্ডিংয়ের পিলারের মতো।’

নাইম হাই তুলে বলল, ‘আরিব ক্রিকেট খেলে। ওর প্র্যাকটিসে নিয়ে যাব তোকে।’
—স্টাম্প দিয়ে মারবে! ব্যাট দিয়ে মারলেই কাজ হবে। চল যাই।
নাইম বলল, ‘সে মারবে না। মারবি তুই। তনুর সামনে। দর্শকের সামনে।’
—মানে?
—মানে তুই আজ থেকে এক সপ্তাহ টানা প্র্যাকটিস করবি, শুধু গতির বল কীভাবে খেলতে হয়। তারপর সাদাতের বল বাউন্ডারি পার করাবি। তনু সেই দৃশ্য দেখবে। কি পারবি না?
—না, পারব না। সাদাতের বল ব্রাডম্যানও খেলতে পারবে না।
—তোকে পারতে হবে। দেখ, একবার জিতলে আর তুই সাদাতের বল পেটাতে পারলে তোর অবস্থান কোথায় যাবে বুঝতে পারছিস? মুকুটটা তখন সাদাতের মাথা থেকে তোর মাথায় উঠবে। চারদিকে হইচই পড়ে যাবে। দৃষ্টি আকর্ষণের এটাই মোক্ষম সুযোগ। পা ভাঙলে ওর প্রতি সিম্প্যাথি আরও বাড়বে। এই চিন্তা বাদ দে।

অলংকরণ: তুলি

নাইমের এককথা। তাই আমি চুপসে গেলাম। চাইলাম কী আর হলো কী! যাক, তার কথা যে পছন্দ হয়নি, তা নয়। আমি কনফিউজড আমার সামর্থ্য নিয়ে।

আমার ব্যাটিং প্র্যাকটিস চলছে খুব গোপনে। আরিব আমাকে বোঝাল ফুটওয়ার্ক, টাইমিং, লাইন, লেংথ। একটা গতিময় বোলার এনে আমাকে লেলিয়ে দিল। আমি মোটামুটি খেলছি। মনে সাহস বাড়ছে বৈকি। ক্রিকেটে যে এত কৌশল, তা জানাই ছিল না। প্র্যাকটিস করছি, সঙ্গে তনুকে নিয়ে নানা রঙের স্বপ্ন ডালপালা মেলছে।

চলে এল ম্যাচ ডে। এমন অবস্থা হয়েছে যে খেলার উত্তেজনা ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার ফুটবল খেলাকেও হার মানাবে। মাঠের চারপাশে বিল্ডিং, তাই নারীরাও চলে আসে খেলা দেখতে। মুরব্বিরা আগে উঁকিঝুঁকি মারত, এখন সরাসরি দেখে। আবার উপদেশও দেয়। মাঝবয়সী আন্টিও কত কৌশল শেখায়, কীভাবে ব্যাট করব, কীভাবে বল করব! আসলে খারাপ সময়ে ছাগলও লাত্থি দেয়।

আমি ব্যাটিংয়ে নামলাম। যা শিখেছি, মনে মনে ভেবে নিলাম। সঙ্গে দোয়া–দরুদ যা জানি, সব পড়ছি। এবার উড়িয়ে দেব সাদাইত্যারে। তার প্রেম এবার গাছের আগায় ঝোলাব।

সাদাত বল হাতে দৌড় শুরু করেছে। মনে হচ্ছে রাস্তা দিয়ে মালবোঝাই ট্রাক চলছে। এদিকে আমার হাঁটু কাঁপা শুরু হয়ে গেছে। এত দিন যা শিখেছি, সব ভুলে গেছি। মিডল স্টাম্প বরাবর বল ছুড়েছে সাদাত। কিন্তু আমি দেখলাম, ছুটে আসছে একটা বন্ধুকের গুলি। সঙ্গে সঙ্গে তাদের দর্শকের উল্লাস–চিৎকার। পেছন ফিরে দেখি, আমার স্টাম্প নেই। বেলটা তখনো ওলট–পালট করছে বাতাসে। আমি ব্যাট প্লেস করার আগেই বল উড়িয়ে দিয়েছে স্টাম্প। সাদাতের পৈশাচিক সেলিব্রেশন। আমি মাথা নিচু করে হাঁটা ধরেছি। ড্রেসিংরুমের পাশেই দর্শকসারিতে তনু। আমার দিকে কটমট চোখে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে, গুলি মেরে দেবে। আহা, এত সুন্দর মেয়েও এভাবে তাকাতে পারে! গুলি তো আগেই মেরেছে। ক্ষত হয়ে গেছে হৃদয়। এখন আর কী মারবে!

আমি চোখ সরিয়ে নিলাম। চোখে চোখ রাখার মতো সাহস বা খেলার পারফরম্যান্স কোনোটাই আমার নেই।

আসলে কে চায় হারতে! তনুও তো আমাদের ব্লকের। কিন্তু সাদাতের উইকেট পাওয়াতে সে খুশি হলো না কেন? মনের প্রেমের চেয়ে এলাকার প্রেম বড় নাকি! আহা, তনু কত মিষ্টি মেয়ে! এটা ভেবে দেখার বিষয়।

ইচ্ছা করছে এই মুহূর্তে একটা তুফান এসে সব লন্ডভন্ড করে দিক, নাহয় একটা বোমা এসে পড়ুক! তবু যদি তাদের জয়রথ থামে। যদি বন্ধ হয় সাদাতের উদ্ধত সেলিব্রেশন।

এত দিন তারা জিতেছে, আমি উন্মত্ত হইনি। এখন তো তনুর প্রশ্ন!! তাই খেলাটা আমার কাছে বিশ্বকাপের মতো। ট্রফিটা হচ্ছে তনু।

আমরা আবার হারলাম। আবারও সাদাত একাই আমাদের ধসিয়ে দিয়েছে। হঠাৎ দেখি, আরিবের হাত আমার কাঁধে। খেলা দেখতে এসেছে। নাইমও আছে। আমি তার সঙ্গে কথা বলছি না। সাদাতের পা ভেঙে দিলে কি আজ এই অপমান সইতে হতো! নাইমের জন্য আজকের হার। বন্ধু হয়ে এই কাজ করলি!

আরিব বলল, ‘সাদাতের বোলিং দেখতে এসেছি। কোনো সমস্যা দেখি না। সমস্যা হচ্ছে বলের লাইনে যাওয়া নিয়ে। বলের লাইনে গিয়ে টাইমিংটা হলেই বল মাঠের বাইরে হারিয়ে যাবে। কাল এসো, আমি দেখিয়ে দেব।’

ধুর ব্যাটা তোর লাইন! এটা মনে মনে বললাম।

এসবে আর আমার আগ্রহ নেই। আমি আর ক্রিকেটই খেলব না।

দুই দিন ভার্সিটিতে যাইনি। নাইম এসে তৃতীয় দিন নিয়ে গেল। সোজা আরিবের প্র্যাকটিস গ্রাউন্ডে। পরিচয় করিয়ে দিল প্রশিক্ষক সরোয়ার স্যারের সঙ্গে। তিনি মানসিকভাবে উজ্জীবিত করলেন আমাকে। ক্রিকেট নাকি মানসিক খেলা। তারপর নিয়ে গেলেন প্র্যাকটিসে। বলের লাইনে যেতে কিছু কৌশল শেখালেন। এভাবে খেললে দেখি আপনাআপনি আমার বাম পা চলে যাচ্ছে বলের লাইনে। তারপর বললেন সোজা ব্যাটে খেলতে। এত দিন খেলতাম ক্রস ব্যাটে। স্টিভ ওয়াহ নাকি ১০ হাজারের বেশি রান করেছেন সোজা ব্যাটে খেলে।

বলের লাইন-সোজা ব্যাট। লাইন-সোজা ব্যাট। এমন শট হচ্ছে, মনে হবে ভিভ রিচার্ডস ব্যাটিং করছেন। আরে! আমি নিজেই অবাক!

প্রতি সপ্তাহে একটা ম্যাচ। আবার এসে গেল। খেলা আগামীকাল। সমস্যা হচ্ছে, আমাদের অধিনায়কের পরীক্ষা। সে খেলতে পারবে না। সিলেটে গেছে ভর্তি পরীক্ষা দিতে। দল সামলানোর দায়িত্বটা আমার ওপর পড়ল। আসলে সাদাত ছাড়া আমি ভালোই খেলি। ফিল্ডিং সেন্সও ভালো। গন্ডগোল করে দেয় সাদাত।

উইকেটরক্ষক কামালের বাসা আমাদের দুই বিল্ডিং পরে, তনুদের একই বিল্ডিংয়ে। তাই আমার কাজটা ওর সঙ্গে বেশি। সকাল–বিকাল কামালের সঙ্গে আছি। গেম প্ল্যান তো নয়, যেন যুদ্ধের বাংকার বানাব। ম্যাপ করছি। এই ফাঁকে যদি তনুকে একটু দেখা যায়। নাহ, এই মেয়ের কোনো খবর নেই।

অবশেষে সন্ধ্যায় ছাদে দেখা হয়ে গেল তনুর সঙ্গে। আমার মধ্যে অস্বস্তি শুরু হয়েছে। হাত–পা ঘামছে। কী বলব! কী বলব! আগে একবার রাস্তায় দেখা হলে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘তনু কেমন আছ?’ সে কেবল তাকিয়ে ছিল অদ্ভুতভাবে। জবাব দেয়নি। দেবে কীভাবে? কী বলেছি আমিও তো শুনতে পাইনি। শব্দ হারিয়ে গেছে কোথায় যেন!

তাই আজ একটু জোরের সঙ্গে বলতে হবে। সাহস নিয়ে বললাম, ‘ভালো আছ তনু?’ ও মা! এটা কী করলাম? এত জোরে বলেছি যেন ট্রাকের চাকা পাংচার হয়েছে। কী বিশ্রী! বিকট শব্দ। তাও আবার শেষেরটা শুনতেও পায়নি।

তনু জবাব দিল না। কী জবাব দেবে! এই ভাষার কোনো জবাব হয়! তাই অন্য কথা বলল, ‘কাল নাকি আপনাদের খেলা?’

আমি ওপর–নিচে মাথা নাড়লাম।
—রেজাল্ট তো জানা আছে। আর খেলে লাভ কী?
—না মানে, আমরা সিরিয়াসলি নিই না তো, তাই আরকি!
—অহ তাই! এটা জানতাম না কিন্তু।
আমি হাসার চেষ্টা করলাম।
—আচ্ছা একটা কাজ করতে পারেন না?
তড়িঘড়ি বললাম, কী কাজ?
—কাল মাঠে ফুটবল নিয়ে যান। জিততেও পারেন।
—তুমি বললে তা–ই করব। না মানে ইয়ে!!

কামাল আমাকে কনুই দিয়ে গুঁতা মেরে পেট ছিদ্র করে দিয়েছে।

তনু হেলেদুলে চলে যাচ্ছে। আমি তাকিয়ে আছি তার চলে যাওয়ার দিকে। জগতের সব সৌন্দর্য এই ছাদে ভর করেছে। আমি আচমকা তাকে ডাক দিয়ে ফেলি, তনু! এই তনু!

সে অবাক হয়ে ফিরে তাকাল। অবাক হলে মেয়েদের রূপ কি মুষলধারে ঝরে? নাকি শুধু তনুর রূপই এমন হয়!

আমি ফেঁসে গেছি। কী বলব এখন! ইতস্তত হয়ে ঘামছি।
স্বপ্নের কথা বলব?
সে স্মিত হেসে জিজ্ঞেস করল, ‘কিছু বলবেন?’
আমি হ্যাঁ–না দুদিকেই মাথা নাড়লাম। সে হাসতে হাসতে চলে গেল। আহ! চলে যাওয়াটাও কত সুন্দর!

খেলা শুরু হয়েছে। ওপেনিংয়ে নেমেছি আমি। মানসিকভাবে শক্ত থাকার চেষ্টা করছি। সরোয়ার স্যার বলেছেন, বোলার নয়, দৃষ্টি রাখতে হবে বলের ওপর। সাহস বাড়াতে মনে মনে সাদাতকে বললাম, ধুর ব্যাটা তুই ট্রাক না, তুই একটা রিকশা। তোর পেছনে লেখা, ‘আমি ছোট, আমাকে মেরো না।’ না মাফ নাই, তোকেই মারব।

সাদাত বল হাতে প্রস্তুত। দৌড় শুরু করেছে। বল ছোড়ার আগমুহূর্তে আমি ব্যাট তুলে পিছিয়ে এলাম। তার ছন্দ নষ্ট করার কৌশল। দ্বিতীয় বলেও করলাম। সবাই ভাবছে আমি ভয় পাচ্ছি। পরের বলে সরোয়ার স্যারের থিওরি প্রয়োগ করলাম—লাইন, সোজা ব্যাট। স্ট্রেইট খেলে দিয়েছি। বল বিদ্যুতের বেগে উইকেটের পেছনে চার রান। সবাই নীরব। কোনো হাততালি নেই। কেউ বিশ্বাস করছে না বোধ হয়। পরের বলে সোজা খেলেছি আবারও। লং অফ দিয়ে বল আবারও বাইরে। এবার হইচই শুরু। সাদাত নার্ভাস হয়ে এলোমেলো বল করা শুরু করেছে। সে ৫ ওভারে ১০ রান দিত না। আজ ১ ওভারে দিয়েছে ১২। আমি ৭৪ রান করেছি। জিতে গেলাম বিশাল ব্যাবধানে।

আমাদের আনন্দ দেখে কে! অনেক দিন পর জয় এসেছে। তাই নাচানাচি, মিছিল কিছুই বাদ যাচ্ছে না। হাজি সাহেব গাড়ি থামিয়ে খেলা দেখছিলেন। জিতেছি দেখে বললেন, বাচ্চা ছেলেগুলো কত কষ্ট করে খেলে জিতল। এই পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে মিষ্টি খেতে বল। আমাকে আলাদা করে দিলেন ৩০০ টাকা। একটা জয়ে কতজন খুশি।

নাচানাচির ভেতর আমার চোখ একজনকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। না, তনুকে কোথাও দেখছি না। সে কোথায় আজ? সে কি খেলা দেখেনি? নাকি সাদাতের জন্য! কিছুই ভাবতে পারছি না। মন খারাপ হতে শুরু করেছে। যার জন্য জিতলাম, সে নেই।

হাজি সাহেবের টাকার সঙ্গে আরও টাকা যোগ হলো। আবেগ, ভালোবাসা এক হয়ে গেছে, তাই অনেকেই দিয়েছে। এ টাকা দিয়ে পিকনিকের আয়োজন করা হলো। বিজয় পিকনিক। এখনই করতে হবে। ১০টা নাগাদ খাবার রেডি হয়েছে।

কামালকে বললাম, ‘কিছু একটা কর। তনুকে খাবার দিতে হবে।’ কামাল তার বোনকে বলল, তনুর কাছে ফোনটা নিয়ে যেতে। সে ফোন নিয়ে গিয়ে আমাকে ধরিয়ে দিল।

ক্রিকেটের মেন্টাল বুস্টিং কৌশল এখানেও ব্যবহার করলাম। বড় করে নিশ্বাস নিলে বুকধড়ফড় কমে। আর আজ কেন জানি নার্ভাসনেস নেই বললেই চলে। একটা জয় কত কিছু পাল্টে দিয়েছে।

তনু হ্যালো হ্যালো করছে।
—তনু, আমরা তো জিতেছি।
—এ জন্য ফোন করেছেন?
—না, পিকনিকের খাবার রেডি হয়েছে। কাউকে কাউকে বাসায় পাঠাচ্ছি। ভাবলাম, তোমাকেও পাঠাই। আজ খুশির দিন বোঝোই তো!
—অহ থ্যাংকস। খাবার লাগবে না। এমনিতেই খুশি হয়েছি। অভিনন্দন।
—কী বলো! আমি রান্না করেছি। খেয়ে দেখো না। আমি নিয়ে আসছি।

তনুকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে কামালকে নিয়ে চললাম তনুদের বাসার দিকে। আজ সাতখুন মাফ। দরজা খুলে দিল তনু।

না দরজা থেকে বিদায় করেনি। ভেতরে বসতে দিয়েছে। দেবে না কেন? জিতেছি না আজ! এত রান করলাম, একটা ব্যাপার আছে না! আসলে সবাই বিজয়ীরই গান গায়। বিজিতের স্থান নেই, করিম স্যারের কথাই ঠিক।

তনু বলল, ‘আজ আমি খেলা দেখতে পারিনি।’
মনে মনে বললাম, কেন দেখবে! আজ তো আমি ভালো ব্যাটিং করেছি। দল জিতেছে। সাদাত জিতলেই না দেখতে!

সোফায় বসতে বসতে তনুকে বললাম, ‘একটা মিথ্যা কথা বলেছি। রান্না আমি করিনি। বাবুর্চি ছিল।’ তনু বলল, ‘আমি জানি। মিথ্যা বলেছেন, সেটাও জানি। আপনাকে লজ্জা দিইনি।’
—সরি।
—কেন মিথ্যা বলতে হলো?

আমি মাথা নিচু করে আছি। বিব্রত হয়ে হালকা কাশি দিতে গিয়ে এখন থামছেই না বুড়ো মানুষদের মতো।

সে একটু থেমে বলল, ‘মিথ্যা আপনার সঙ্গে ঠিক যায় না। আপনাকে একটা কথা বলি?’

আমি তো উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছি। তাহলে নাইমের কথাই কি ঠিক? কাজ হচ্ছে মনে হয়। মনে মনে বললাম, একটা কেন দশটা বলো। আজ বসন্ত এসেছে দখিনা হাওয়ায় জীবনের পূর্ণতা নিয়ে।

তনু কোনার দিকের সোফায় বসে একটু কী যেন ভাবল। তারপর বলল,
‘এ পাড়ায় অনেক ছেলের অনেক রূপ দেখেছি। অনেক ইঙ্গিতপূর্ণ চোখ, অনেক নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দেখেছি। মেয়েরা এসব বোঝে। আর বোঝে বলেই এড়িয়ে যায় কৌশলে। ভয়ে তটস্থ থাকে। অস্বস্তিতে থাকে। আপনার মধ্যে তেমন কিছু দেখিনি কখনো। তাই আপনাকে রাস্তায় দেখলে বরং ভরসা পেতাম।’

একটু থেমে আবার বলল, ‘একদিন আপনাকে ডেকে নিয়েছিলাম মনে আছে?’
—হ্যাঁ।
—সেদিন তেমন কিছু চোখ থেকে বাঁচতে আপনাকে আমার সঙ্গে রেখেছিলাম। বিশ্বাস বা ভরসা না থাকলে সেটা হতো না। আপনি মূলত একজন ভদ্র ছেলে। আজ এসব বলছি, তার একটা কারণ আছে।

আমার চোখ চকচক করছে। এই বুঝি বলে ফেলবে, সে আমাকে ভালোবাসে। আমি অপেক্ষা করে আছি। এ সময় মিষ্টি নিয়ে এল। নিশ্চয়ই জিতেছি বলে মিষ্টি খাওয়াচ্ছে। বললাম, ‘মিষ্টি আমার খুব প্রিয়।’

তনুর বোন অনু বলল, ‘কিসের মিষ্টি জানেন?’
—জানি। জানব না কেন! আজকের খেলায় জিতেছি তাই বিজয়ের মিষ্টি।
সে খিকখিক করে হেসে উঠে বলল, আপুর এনগেজমেন্টের মিষ্টি।
হয়তো তনুও এটাই বলতে চেয়েছিল।
—কী!??! আমি ডুবে গেলাম অথই জলে। ভেতরটা মনে হয় থেঁতলে গেল!
—আজ আপনারা খেলছিলেন, এদিকে আপুর এনগেজমেন্ট চলছিল। আপু খেলা দেখতে পারেনি এ জন্য।

মিষ্টি মুখে দিয়েছি মাত্র। খাব! কামর বসাব নাকি ফেলে দেব? টেবিলে রাখলাম প্লেট। কিন্তু সাদাত তো মাঠে ছিল। এনগেজমেন্ট কেমনে হলো! মাথায় কিছু আসছে না।

তনু বলল, ‘সেকি! রেখে দিলেন কেন? নিন না প্লিজ। এখনই বললেন না, মিষ্টি আপনার প্রিয়!’

আমি নাহয় বলেছি প্রিয়। সেটা তো বিজয়ের মিষ্টি। পরাজয়ের মিষ্টি তো প্রিয় হতে পারে না। সেটা কীভাবে বোঝাই! আহত গলায় জিজ্ঞেস করলাম, ছেলে কি ক্রিকেট খেলে?

তনু চুপ। অনু শব্দ করে হেসে বলল, না, ক্রিকেট খেলে না। দুলাভাই বিসিএস ক্যাডার।

মনে মনে বললাম, সুন্দর মেয়েগুলোকে মূর্খ রাখাই তো বিসিএসদের কাজ। পড়ালেখা শেষ করতে দিলি না। পাড়ায় পাড়ায় হাহাকার ছড়িয়ে মজা পাস তোরা! যাক সাদাত পায়নি। একটা সান্ত্বনা আছে।

তনু আবার জোর করল, ‘মিষ্টি নেন না ভাইয়া।’

আবার মুখে দিলাম। তনুর মতো মেয়ে বললে বিষ বা ফাঁসও খাওয়া যায়। এটা তো কেবল মিষ্টি।

ইচ্ছেগুলোর মতো চোখ বন্ধ করে না চিবিয়ে, গিলে ফেললাম আস্ত একটা মিষ্টি। চোখের কোনা নাহয় চিকচিক করল একটু।