কাতারে আজান ও নামাজে পর্যটকদের আকর্ষণ

কাতার বিশ্বকাপের আমেজ শেষ হতে আর মাত্র কয়েক দিন। ৭ ও ৮ ডিসেম্বর বিরতির দুই দিন পর কোয়ার্টার ফাইনালের খেলা হয়েছে গতকাল শুক্রবার রাতে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে হাজারো পর্যটকের অনেকে কাতার থেকে নিজ নিজ দেশে ফিরে গেছেন, অনেকে নতুন করে দোহায় আসছেন।

বিশ্বকাপের খেলা দেখতে যাঁরা কাতারে আসছেন, তাঁরা ম্যাচের সময়টুকু ছাড়া বাকি সময়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন নানা জায়গায়। ছোট্ট দেশ কাতারে ঘুরে বেড়ানোর জায়গা এমনিতেই হাতে গোনা এবং এর অধিকাংশই আবার বিশ্বকাপ উপলক্ষে সাম্প্রতিক সময়ে তৈরি করা। তবু দর্শক ও পর্যটকদের পছন্দের তালিকায় রয়েছে সুক ওয়াকিফ, লুসাইল বলিভার্ড, কাতারাসহ বেশ কিছু দর্শনীয় জায়গা।

তবে এবার বিশ্বকাপ দেখতে আসা অনেক দর্শকের নজর কেড়েছে কাতারের দৃষ্টিনন্দন কিছু মসজিদ। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ্য কাতারের জাতীয় মসজিদ এবং সাংস্কৃতিক পল্লি কাতারার প্রধান মসজিদ। দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য ও ইতিহাস–ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার পরিকল্পিত ও পরিমিত সমন্বয় এসব মসজিদকে অনন্য স্থাপনা হিসেবে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে।

কাতার ওয়াক্‌ফ ও ইসলামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বিশ্বকাপ উপলক্ষে ইসলামের মাহাত্ম্য তুলে ধরার জন্য যে বিশেষ কয়টি পরিকল্পনা করা হয়, সেগুলোর মধ্যে বিভিন্ন মসজিদে বিদেশি দর্শকদের জন্য আজান ও নামাজ দেখার সুব্যবস্থা রাখা অন্যতম একটি উদ্যোগ। আর এ উদ্যোগ যে মোটামুটি সফল, এর প্রমাণ প্রতিদিনই দেখা যাচ্ছে জাতীয় মসজিদ এবং কাতারা সাংস্কৃতিক পল্লির এই মসজিদে।

দুপুরের পর থেকে জোহর, আসর, মাগরিব ও এশার ওয়াক্তে আজানের সুমধুর সুর শোনা এবং আজান দেওয়া দেখতে কাতারার মসজিদটিতে ভিড় করেন অনেক বিদেশি পর্যটক। তাঁদের কেউ কেউ তা মুঠোফোনে ধারণ করেন, আবার অন্যরা নীরবে তা শুনতে থাকেন। একইভাবে নামাজের সময় হলে দূর থেকে নামাজের দৃশ্য দেখছেন অনেকে।

কাতারের জাতীয় মসজিদে দেখা গেছে, বিদেশি পর্যটক ও দর্শকেরা যাতে নামাজ আদায়ের দৃশ্য দেখতে পারেন, সে জন্য একটি বিশেষ কর্নার তৈরি করে সারি সারি চেয়ার পেতে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন বাণী ও নির্দেশনাসংবলিত বোর্ড টানিয়ে রাখা হয়েছে, যাতে এ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় ধারণা পেতে পারেন আগ্রহী যে কেউ। প্রয়োজনীয় প্রশ্নের উত্তর দিতে ওয়াক্‌ফ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে রয়েছেন বিদেশি ভাষায় পারদর্শী ধর্মীয় পণ্ডিতেরা।

জাতীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে কথা হলো আর্জেন্টিনা ও মেক্সিকো থেকে আসা দুই তরুণের সঙ্গে। প্রথম আলোকে মেক্সিকোর তরুণ মাইকেল বলেন, একটি নতুন ধর্মের ব্যাপারে জানার আগ্রহ থেকে তাঁরা এখানে এসেছেন। কয়েক দিন আগে তাঁদের বন্ধুরাও এসেছিলেন। ফিরে গিয়ে তাঁরা সামাজিক গ্রুপে ছবি ও ভিডিও শেয়ার করেছেন, তা দেখে উৎসাহী হয়ে তাঁরাও এসেছেন। তাঁর কথায় সায় দিলেন আর্জেন্টিনা থেকে আসা স্যামুয়েলও।

কাতারার প্রধান মসজিদে আজান শুনতে যাঁরা আসেন, তাঁদের বেশ সমাদর করে ভেতরে নিয়ে যাচ্ছেন মসজিদের স্টাফরা। পুরো ব্যাপার তদারক করছেন ওয়াক্‌ফ মন্ত্রণালয় ও কাতারা কর্তৃপক্ষের কয়েক কর্মকর্তা।

নাম না প্রকাশের শর্তে কাতারা কর্তৃপক্ষের এক প্রতিনিধি জানান, বিশ্বকাপ চলাকালে এ মসজিদ যাতে সব সময় খোলা থাকে এবং অবাধে যে কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়, সে জন্য বাড়তি নির্দেশনা রয়েছে।

কাতারে বিশ্বকাপের দর্শকদের মধ্যে আরেকটি বেশ জনপ্রিয় জায়গা লুসাইল বলিভার্ড। প্রতিদিন সন্ধ্যার পরপরই এখানে সমবেত হন হাজারো পর্যটক। কাতারে প্রচলিত রীতির বাইরে এখানে প্রতিদিন মাগরিব ও এশার সময়ে চলমান গান ও সাংস্কৃতিক পরিবেশনা থামিয়ে আজান প্রচারিত হয় সড়কজুড়ে স্থাপিত সব শব্দযন্ত্রে।

গত ২০ নভেম্বর থেকে শুরু হয়ে ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলছে কাতার বিশ্বকাপের মাসব্যাপী আসর। এর মধ্যে প্রথম পর্বের ম্যাচগুলো চলাকালে প্রতি শুক্রবার বিভিন্ন স্টেডিয়ামের চত্বরে জুমার নামাজের ব্যবস্থা করা হয়েছিল সুবিশাল পরিসরে। প্রচলিত আরবি ভাষায় খুতবার পরিবর্তে এসব জুমার জামাতে খুতবা দেওয়া হয়েছে ইংরেজি ভাষায়। খোলা আকাশের নিচে সম্মিলিত এমন খুতবা প্রদান ও নামাজ আদায়ের দৃশ্য দেখতে চারপাশে ভিড় দেখা গেছে উৎসুক বিদেশি দর্শকদের।

এসব ছাড়াও প্রায় সব আবাসিক হোটেলের রুমে বিশেষ কিউআর কোড–সংবলিত স্টিকার লাগানো হয়েছে ওয়াক্‌ক মন্ত্রণালয় এবং দোহায় অবস্থিত ইসলামি কালচারাল সেন্টারের (ফানার) উদ্যোগে। ইসলাম ধর্ম ও আরব জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে প্রয়োজনীয় তথ্যসংবলিত বিশেষ প্রকাশনা বিভিন্ন ভাষায় ডাউনলোডের জন্য এসব কোড।

এখন পর্যন্ত কাতার বিশ্বকাপে কোনো রকমের চুরি-ডাকাতি কিংবা শ্লীলতাহানি ঘটনা ঘটেনি। কোথাও কোনো নারী ইভ টিজিংয়ের শিকার হয়েছেন—এমন অভিযোগও আসেনি। বিশ্বকাপ দেখতে আসা হাজারো পর্যটকের কাছে কাতারের এই নিরাপদ আয়োজন যেমন স্মরণীয় হয়ে থাকবে, তেমনিভাবে বিশ্বকাপ দেখতে এসে একটি নতুন ধর্ম ও জাতির ইতিহাস–ঐতিহ্য সম্পর্কে জানার সুযোগ অনেকের জ্ঞানভান্ডারকে সমৃদ্ধ করছে নিঃসন্দেহে।