বাংলা বাজার ভ্যাঙ্কুভারে কানাডায় বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরছেন নুরুল ইসলাম

কানাডায় সামগ্রিক আর্থসামাজিক কাঠামোয় ইমিগ্রেন্ট বা অভিবাসীরা দীর্ঘ সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। সাংস্কৃতিক বহুমাত্রিক ও বহুত্ববাদ (মাল্টিকালচারিজম) প্রতি উদারতা কানাডার সামগ্রিক প্রেক্ষাপটকে করেছে বৈচিত্র্যময়। অভিবাসী বাংলাদেশিরা শিক্ষা, খাদ্য, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি—বিভিন্ন খাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। সেই রকম আত্মপ্রত্যয়ী একজন বাংলাদেশি কানাডিয়ান নুরুল ইসলাম। সফল উদ্যোক্তা হিসেবে তিনি কানাডায় নিরলসভাবে অবদান রাখছেন। জন্মভূমির ঐতিহ্যকে হৃদয়ে লালন করে দেশাত্মবোধের আদর্শে কানাডার ভ্যাঙ্কুভারে গড়ে তুলেছেন বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান ‘বাংলা বাজার ভ্যাঙ্কুভার’। নুরুল ইসলাম বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক, ঢাকা সরকারি তিতুমীর কলেজ থেকে বিএ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট জাপানিজ ভাষাশিক্ষা অর্জন করেন। কর্মজীবন শুরু হয় ঢাকায় বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটিজিক স্টাডিসে (বিআইআইএসএস) অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে এবং ব্রিগেডিয়ার আবদুল হাফিজের সঙ্গে প্রায় তিন বছর কাজ করেন। ১৯৮৯ সালে বাহরাইনের একটি মানি এক্সচেঞ্জের আমন্ত্রণে অথরাইজ কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন। সেখানে তিন বছর কর্মরত ছিলেন (অগ্রণী ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ ব্রাঞ্চ)।

১৯৯২ সালে দেশে ফিরে জীবনসঙ্গী নির্বাচন করেন। পরে ১৯৯৩ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য জাপান যান। ১৯৯৬ সালে দেশে ফিরে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তারপর তিনি আবার উচ্চশিক্ষার্থে জাপান যান। আট বছর জাপানে উচ্চতর অ্যাসোসিয়েট ডিগ্রি অব কম্পিউটার সায়েন্স এবং ডিপ্লোমা অন কুলিনারি আর্টস ডিগ্রি লাভ করেন। ২০০৪ সালে সপরিবার ইউরোপে আসেন। মালটায় তিন তারকা হোটেল আমন্ত্রণে হেড শেফ ছিলেন। বিশ্বখ্যাত র‌্যাডিসন হোটেলসহ বিভিন্ন পাঁচ তারকা খচিত হোটেলগুলোয় কাজ করার সময় তিনি ‘ইন্টারন্যাশনাল ফুড প্রোডাক্ট অ্যান্ড প্রিপারেশন’ বিষয়ে প্রশিক্ষণ লাভ করার পারদর্শিতা অর্জন করেন। পরে কানাডায় চার তারকা এক হোটেলের আমন্ত্রণে সপরিবার কানাডা আসেন এবং হোটেলে চার বছর কাজ করেন। এরপর কিছু সময়ের জন্য কানাডায় নিজস্ব রেস্তোরাঁ শুরু করেছিলেন।

বাংলাদেশের খাদ্যজাত পণ্যের স্বতন্ত্র স্বাদ এবং বাংলাদেশের অভিবাসী ও কানাডার মূলধারা জনগণের প্রয়োজন মেটাতে দেশজ পরিচয় প্রসারের অভিপ্রায়ের অদম্য স্বপ্ন তাঁকে সব সময় তাড়িত করত। সেই অনুসারে কানাডা সরকার ও সিটি কাউন্সিলের স্থাপনা বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান শুরুর সুনির্দিষ্ট নীতি অনুসরণ করে নিজ প্রতিষ্ঠান ‘বাংলা বাজার ভ্যাঙ্কুভার’ যাত্রা শুরু করে। তাঁর দীর্ঘ লালিত স্বপ্নকে বাস্তবায়নের নিরিখে কোনো শর্ত বা প্রতিবন্ধকতা নুরুল ইসলাম দমিয়ে রাখতে পারেনি।

কানাডার পশ্চিমের ব্রিটিশ কলাম্বিয়া প্রভিন্সের ভ্যাঙ্কুভারে শহরে ৬৬৫৭ মেইন স্ট্রিটে সড়ক দিয়ে কিছুটা অগ্রসর হলেই চোখে পড়বে লাল–সবুজের আবহে ঘেঁষা উজ্জ্বল সাইনবোর্ড ‘বাংলা বাজার ভ্যাঙ্কুভার’। পরিচ্ছন্ন ও সুপরিসর অভ্যন্তরীণ পরিবেশে দেয়ালে বাংলাদেশ ও কানাডার পতাকার শোভা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত এই সমৃদ্ধ সম্ভার দেশের কথা স্মরণ করিয়ে। সারা দিনের জীবনসংগ্রামের অবসানে কর্মক্লান্ত অভিবাসী ক্রেতা তাঁর দোকানে বাংলা বাজারে খুঁজে পান জন্মভূমি বাংলাদেশের স্মৃতিময় আনন্দের আশ্রয়। ভ্যাঙ্কুভারে নবাগত কোনো অভিবাসী অথবা শিক্ষার্থীরা যখন তাঁর দোকানে আসেন, তখন তাঁদের অনেকেই জন্মভূমিতে মা–বাবা অথবা তাঁদের একান্ত প্রিয়জনকে দেশের কোনো পণ্য অনলাইন ভিডিও কলের মাধ্যমে দেখিয়ে মন্তব্য করার হৃদয়স্পশী পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।

নুরুল ইসলামের একান্ত আন্তরিকতা ও সার্বিক তত্ত্বাবধানে সব ক্রেতাবিশেষ মুগ্ধ এবং তাঁর প্রতিষ্ঠান ‘বাংলা বাজার’–এ ভ্যাঙ্কুভার অভিবাসীসহ বৃহত্তর কানাডার জনগণের মধ্যে ইতিমধ্যে যথেষ্ট আস্থা ও গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। কানাডার জীবনে প্রায় দুষ্প্রাপ্য বাংলাদেশ থেকে প্রতি সপ্তাহে আমদানি করা পণ্য মেলে এখানে। সজীব সবজি, কচুর লতি, লটকন, পটোল, আমড়া, আম, কাকরোল, গন্ধরাজ লেবু, কচুর মোরা, পুঁই শাক, লাল শাক, কাঁচা মরিচ, ইলিশ, টেংরা, পাবদা, পুঁটি, গলদা চিংড়িসহ সব ধরনের মাছ, হালাল গরু ও খাসির মাংস, বাংলাদেশে উৎপাদিত মসলাজাত পণ্য, বিস্কুট, মুড়ি, খাবার, বগুড়ার মিষ্টি দই, টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ীর চমচম, বালুশাহী, অন্যান্য মিষ্টি, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য, বিছানা চাদর, গামছা, পরিধেয় লুঙ্গি, পিঁড়িসহ আরও অনেক কিছুই তাঁর প্রতিষ্ঠানে সহজলভ্য। সম্প্রতি এই প্রদেশের রাজধানী ভিক্টরিয়াসহ বিভিন্ন শহরে ক্রেতার চাহিদা অনুসারে জিনিস পৌঁছে দেওয়ার সুব্যবস্থাও করেছেন। এ ছাড়া নিরাপদে বাংলাদেশ ও বিভিন্ন দেশে অর্থ পাঠানোর জন্য তাঁর প্রতিষ্ঠান সুব্যবস্থা নিয়েছে।

বাংলা বাজারের এই উদ্যোগে সার্বক্ষণিক সহায়তা করছেন নুরুল ইসলামের সুযোগ্য সহধর্মিণী রুমা ইসলাম। এ ছাড়া তাঁর তিন সন্তান বিভিন্নভাবে তাঁকে সহায়তা করে। বর্তমানে সফররত তাঁর ভায়রা ভাই শরিফুল আলম তাঁকে প্রচার ও সহায়তা করছেন। নুরুল ইসলামের বড় মেয়ে কানাডায় একটি ব্যাংকে কর্মরত। ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ে এবং তৃতীয় ছেলে গ্রেড সিক্সের শিক্ষার্থী।