প্রেমের শহর প্যারিসে-১
এক দফা দাবিতে ছেলে অনড় ছিল। ১০ বছর বয়সী ছেলে। তাকে প্যারিস নিয়ে যেতে হবে। এক দফা দাবির পেছনে বউয়ের ইন্ধন ছিল। কান টানলে তো মাথা আসবেই। মধ্যবিত্ত মানুষ। কোনো রকম পয়সা জমিয়ে প্যারিসের বুকিং দিলাম। একটা চার তারকা রিসোর্টে। যেখানে বেডরুমের সঙ্গে আছে বসার কক্ষ, রান্নাঘর, ডাইনিং, টিভি, ওয়াই–ফাইসহ সব। চার দিনের জন্য প্যাকেজ ৩৫০ পাউন্ড। মানে প্রায় ৫৫ হাজার টাকা। থাকা ও যাওয়া আসা বাবদ। খাওয়া, হোটেল ট্রান্সফার এসব আমাদের নিজের। বুকিং দেওয়ার পর হঠাৎ মনে হলো—দেখি তো দর্শনীয় স্থানগুলো হোটেল থেকে কত দূর? আসা-যাওয়ায় কত খরচ পড়বে, সময় কত খরচ হবে—এসব। ইন্টারনেটে সার্চ করার পর তো মাথায় হাত। একি করলাম! দারুণ বোকা আমি! সস্তায় ভালো অফার পেয়ে অন্ধের মতো বুকিং দিয়ে ফেললাম কেন! এ রিসোর্টটা প্যারিস সিটি থেকে বেশ দূরে। আমরা যেসব জায়গায় যাব, যেমন ডিজনিল্যান্ড, আইফেল টাওয়ার ও লুভর মিউজিয়াম এসব স্থান এই রিসোর্ট থেকে অনেক দূরে। রিসোর্ট থেকে এসব জায়গায় যেতে-আসতে যে খরচ পড়বে, সে টাকায় আরেকটা হোটেল নেওয়া যায় দর্শনীয় স্থানগুলোর পাশেই। তাতে কষ্ট ও সময় দুই–ই বাঁচবে। শুরুতেই ভুল করে ফেললাম! হোটেল টাকাও ফেরত দেবে না। শর্ত এ রকমই ছিল। ভুল হওয়ায় বউ খিটমিট শুরু করল। কী আর করা! সহ্য করলাম। ভুল করেই তো মানুষ শিখে, শিখলাম। তারপর আবার বুকিং দিলাম তিন তারকা একটি হোটেলে। আইভিস হোটেল। গচ্ছা গেল আরও ২৫০ পাউন্ড। ছেলের শখ, সে বাঙ্ক বেডে থাকবে। মানে দোতলা খাটে। বাঙ্ক বেড বুক করলাম।
হোটেল বুকিংয়ের পর চিন্তা। ফ্রান্সে কখনো যাইনি। ভাষাও জানি না। শুনেছি, ওই দেশের মানুষ ইংরেজিতে কথা বলতে পছন্দ করে না। কোনো সমস্যায় পড়ি কি না! আমার চিন্তা দেখে বউ বলল, জেসমিন আপাকে ফোন দেব? জেসমিন আপা স্ত্রীর খালাতো বোন। থাকেন প্যারিসেই। ডাক্তার। স্ত্রীকে বললাম, দাও ফোন।
স্ত্রী ফোন দিল জেসমিন আপাকে। আপা বললেন, ‘কী দরকার হোটেলে ওঠার, আমার বাসায় চলে এসো।’
না আপা, হোটেল কনফার্ম করে ফেলছি। পারলে কোনো ট্যাক্সিওয়ালার ফোন নম্বর দেন। আমাদের এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে নিয়ে যাবে।
সমস্যা নেই, তোমার দুলাভাই তোমাদের পিক করবে।
ধন্যবাদ আপা।
নির্ধারিত দিনে লন্ডনের বাসা থেকে বের হলাম, ট্যাক্সি দিয়ে। রেলস্টেশনের পথ ২৫ মিনিটের। সেখান থেকে গ্যাটউইক বিমানবন্দর। সেখানে পৌঁছালাম বেলা একটার দিকে। ফ্লাই করব ইজি জেট এয়ারলাইনসে। ইউরোপের অন্যতম জনপ্রিয় বাজেট এয়ারলাইনস। এখানে ফ্রি খাবার দেওয়া হয় না। কিনতে হয়। বিকেল পাঁচটার দিকে প্যারিস পৌঁছালাম। ফ্রান্সের রাজধানী। বিমানবন্দর থেকে বেরিয়েই পেয়ে গেলাম জেসমিন আপার স্বামীকে। তার সঙ্গে প্রথম দেখা। বিনয়ী মানুষ। ফ্রান্স আওয়ামী লীগ নেতা আশরাফ ইসলাম। আমাদের তার গাড়ি দিয়ে নিয়ে গেলেন হোটেলে। শুধু ড্রপ করে ক্ষান্ত হননি। কেএফসি রেস্তোরাঁয় নিয়ে খাওয়ালেন।
হোটেলে ঢুকেই বাঁধল সমস্যা। আইভিস হোটেলটা মোটামুটি ভালোই। কিন্তু ১০ বছর বয়সী যে ছেলের বাঙ্ক বেডের জন্য এত আগ্রহ ছিল, সে বাঙ্ক বেড দেখে ভয় পেয়ে গেল। সিঁড়ি বেয়ে ওপরের বিছানায় উঠতে হয়। এখন বলছে, সে দোতলায় থাকবে না।
তাহলে আমি থাকব?
হ্যাঁ।
আমি নিজেও এ রকম বিছানায় কখনো ঘুমাইনি। মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে ঘুমানোর লোক। শীতল পাটিতে ঘুমানোর লোক। এখন ঝুলে থাকা এক বিছানায় শুয়ে পড়ব? আমারও ভালো লাগছে না। কী আর করা! অনিচ্ছা সত্ত্বেও দোতলা বিছানায় আমিই থাকলাম। পিতা মানেই তো ত্যাগ।
সমস্যা বাঁধল রাত ১২টায়। অস্বাভাবিক বিছানায় ঘুমানোর চেষ্টা করছি, হঠাৎ বউ কথা বলে উঠল—কী একটা হোটেল নিয়েছ, এইটা একটা হোটেল অইল!
সমস্যা কী!
আরে, বালিশগুলো রাবারের মতো।
হোটেলের বালিশ তো এ রকমই হয়।
আমি শিমুল তুলার বালিশে অভ্যস্ত, ওই রকম বালিশ দিতে বলো।
কাকে বলব?
রিসিপশনে বলো।
এত রাতে বালিশ খুঁজতে যাব! বলি আমি।
হ্যাঁ, যাও।
পড়লাম মহা সমস্যায়। এ নিশিরাতে, প্যারিস শহরে কেমনে পাব আমি শিমুল তুলার বালিশ! বিছানা থেকে সরছি না, ছেলে ঘুমাচ্ছে। বউ বকবক করে যাচ্ছে বালিশের জন্য। মাঝেমধ্যে আক্ষেপ করে বলছে, কেন যে বালিশ নিয়ে এলাম না।
আচ্ছা, বিদেশ গেলে কেউ কি বালিশ নিয়ে যায়? ভালোই মসিবতে পড়লাম দেখছি। একসময় বউয়ের ঘ্যান ঘ্যান সংগীতের মূর্ছনায় ঘুম এসে গেল। আহা ঘুম। ক্লান্তির ঘুম।
২.
সকালে ঘুম ভাঙল আটটায়। ছেলে উঠি উঠি করে উঠল ৯টায়। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে গেলাম রেস্তোরাঁয়। নাশতা খেতে। নাশতা পর্ব বন্ধ হয়ে যায় সকাল ১০টায়। হোটেলের রেস্তোরাঁ বেশ সুন্দর, পরিপাটি। সেখানে ১৫ থেকে ১৬ জন পর্যটক নাশতা খাচ্ছেন। রেস্তোরাঁয় কফির ধোঁয়া উড়ছে। সুগন্ধও। বউ-ছেলে রেস্তোরাঁয় এসে খুশি। ছেলে লেগে গেল দুই পর্যটকের সঙ্গে গল্পে। সে খুব বন্ধুপ্রিয়। জনপ্রতি নাশতা ৮ ইউরো। ১ হাজার ২০০ টাকা। যত ইচ্ছা খাও। নাশতা খেয়ে গেলাম আইফেল টাওয়ার দেখতে, মেট্রোতে।
আমার ছেলে অনুভব গুগল ম্যাপ দেখে দেখে বলে দিল, কীভাবে যাব। তার নির্দেশনা ঠিক। এ যুগের মানুষেরা অনলাইনের ওস্তাদ। প্যারিসের মেট্রো স্টেশন দেখে একটু অবাকই হলাম। লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ডের মতো নয়। স্টেশনগুলো যেন মাটি দিয়ে লেপা। হয়তো এটাই তাদের ঐতিহ্য। তবে ট্রেনের কামরাগুলো খুব টেকসই। জার্মানির জিনিসের মতো ভারী। যথাসময়েই পৌঁছে গেলাম, দৃষ্টিনন্দন টাওয়ারে। সপ্তম আশ্চর্যের একটি। এই টাওয়ারের উচ্চতা ১ হাজার ৮৩ ফুট। ১৮৮৯ সালের ৩১ মার্চ এর নির্মাণকাজ শুরু হয়। এর স্থপতি Stven Savester। আইফেল টাওয়ারে আসতে পেরে নিজেকে সফল মনে হলো। হঠাৎ খেয়াল করলাম দুই জায়গায় মানুষের দীর্ঘ লাইন। কোন লাইনে যাব? একটু এগোতেই এক ভদ্রলোক বললেন, এটি টিকিটের লাইন। ঢুকতে টিকিট লাগে! আকাশ থেকে পড়লাম। ভেবেছিলাম ঢুকতে পয়সা লাগে না। এখন? যাঁরা অনলাইনে টিকিট কেটেছেন, তাঁরা অন্য লাইনে দাঁড়িয়েছেন, ভেতরে ঢোকার লাইনে। ভেতরে ঢুকতে হলে, আমাদের প্রথমে টিকিটের লাইনে দাঁড়াতে হবে। টিকিট পেয়ে গেলে, দাঁড়াতে হবে ঢোকার লাইনে। দুই লাইন শেষ করতে সময় লাগবে আনুমানিক দুই ঘণ্টা। হতাশা ভর করল। আইফেল টাওয়ার দেখে আমাদেরকে যেতে হবে লুভর মিউজিয়াম দেখতে। হঠাৎ স্ত্রী বলল, আরে, ওই দিকে তো একটা মানুষও নেই। চলো, ওই দিকে। একটু এগোতেই খেয়াল করে দেখলাম, ওটা ডিজেবল মানুষের গেট। ছেলে তার মাকে বলল, মা ওই দিকে যাওয়া যাবে না, ওটা অটিস্টিকদের গেট। ছেলের মা ড্যামকেয়ার ভাব নিয়ে বলল, আসো আসো, সমস্যা নেই। সে ক্ষিপ্র বেগে এগোতে থাকল। আমরা পেছন থেকে তাকে যতই ডাকি, সে শুনে না, উল্টো আমাদের হাতের ইশারায় বলে—আসো, আসো।
আমাদের বাপ-ছেলের লজ্জা লাগছে। আমরা স্ত্রী গেটের মুখে যেতেই, বিশাল দেহের এক কালো লোক তার পথ রোধ করে দাঁড়াল। ইংরেজিতে বলল, তোমার টিকিট কোথায়?
উত্তরে স্ত্রী খাঁটি নেত্রকোনার ভাষায় বলল, ভাইয়ু, আফনে এইডা কী কইতাছইন!
কালো লোকটা তার ভাষা বুঝতে না পেরে আবার ইংরেজিতে বলল, তোমার টিকিট কোথায়?
স্ত্রী আবার নেত্রকোনার ভাষায় উত্তর দিল—ভাই, এইডা একটা কথা কইলেন!
এবার কালো লোকটা তার ভাষা বুঝতে না পেরে হতাশা প্রকাশ করল। একনজর তাকে দেখে নিয়ে হয়তো ভাবল, দেখতে তো অটিস্টিক লাগে না, হতে পারে স্পিচ অটিস্টিক। ভাষা এলোমেলো। তারপর কী বুঝে হঠাৎ বলে উঠল, গো।
বউ গেট দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে আমাদেরকেও ডাকল। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা শরমিন্দা বাপ-ছেলে মুহূর্তেই ঢুকে গেলাম গেট দিয়ে, তার সঙ্গে। আমাদের টিকিট লাগল না। লাইনেও দাঁড়াতে হলো না। সময় বাঁচল। বউয়ের এই সাফল্য দেখে, যে ছেলে একটু আগেও লজ্জা বোধ করছিল, সে বলল, মা, তোমার বুদ্ধি খারাপ নয়, কী বলো বাবা?
বুদ্ধি আছে কিন্তু এভাবে ঢোকা ঠিক হয়নি।
ঘুরে ঘুরে আমরা আইফেল টাওয়ার দেখতে থাকলাম। টাওয়ার দেখে মনে হলো, এ রকম বিশাল টাওয়ার বানানো হয়তো সে যুগে বিস্ময়ই ছিল, কিন্তু এ যুগে চাইলে কোনো ব্যাপারই নয়। আইফেল টাওয়ার থেকে বেরিয়ে হঠাৎ আমার প্রস্রাব ধরল। একটু এগোতেই পেয়ে গেলাম পাবলিক টয়লেট। বেশ বড়সড়।
গোলাকার। বাটন টিপতেই বিশাল দরজা খুলে গেল। ঢুকে দরজা বন্ধ করতে যাব, অমনি পড়লাম সমস্যায়। সুইচ বোর্ডে অনেকগুলো বাটন। কোনটায় টিপব! বাটনের গায়ে ফরাসি ভাষায় কোন বাটনের কী কাজ লেখা আছে, কিন্তু আমি তো ফরাসি ভাষা জানি না। হঠাৎ আন্দাজ করে একটা বাটনে টিপ দিলাম। ও মা, পড়লাম মহাবিপদে, সুনামির মতো পানি গ্রাস করছে আমাকে। ভিজে গেল জুতা, প্যান্টের নিচ। এসব দেখে কিসের আর প্রস্রাব, দৌড়ে বেরিয়ে এলাম। জান বাঁচাও।
ঘটনা কী! ঘটনা কী!
বউ-ছেলে উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা করে। ঘটনা বললাম, ভুল বাটনে টিপ দিয়ে দিছি, ফ্লোর ক্লিন বাটনে, পানি এসে আস্ত ফ্লোর ভিজিয়ে দিয়ে গেছে। আমার এই মুরগি–ভেজা দেখে বউ-ছেলে হাসতে হাসতে শেষ। ছেলেকে বললাম, চলো, কোনো রেস্তোরাঁয় ঢুকে প্রস্রাব করে ফেলব। ঢুকলাম এক রেস্তোরাঁয়। ও মা, এখানেও জ্বালা। টয়লেটের দরজায় লিখে রেখেছে—রেস্তোরাঁর কাস্টমার ব্যতীত ব্যবহার নিষেধ। ছেলেকে বললাম, চাপ সামলানো তো সমস্যা, চলো বসেই পড়ি। কিছু খাই।
ওকে।
চাপ থামালাম। খেলাম টুকটাক। তারপর রওনা দিলাম লুভর মিউজিয়ামের দিকে। তখন বেলা প্রায় একটা। চমৎকার আবহাওয়া। না ঠান্ডা, না গরম। চারদিকে পর্যটক আর পর্যটক। ভালোই লাগছে হাঁটতে। নতুন কিছু দেখার মধ্যে আনন্দ থাকে। আর এই প্যারিস তো ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির শহর। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসে এই শহরে। চলবে....
**দূর পরবাসে লেখা, গল্প, ভ্রমণ অভিজ্ঞতা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। মেইল অ্যাড্রেস [email protected]